জিজ্ঞাসাবাদ চলছে
কে নেই মনিরের দুষ্টচক্রে!

সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২০ | ১৪:৫৬
মনির হোসেন ওরফে 'গোল্ডেন মনির' গ্রেপ্তার হওয়ার পর চমকপ্রদ নানা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সুপারসনিক গতিতে অনেকটা রূপকথার মতো তিনি জীবনটা বদলে ফেলেন। পুরান ঢাকায় কাপড়ের ফেরিওয়ালা থেকে কয়েক বছরের মধ্যে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হন মনির। একটি দুষ্টচক্রের 'আশীর্বাদ' তার উত্থানের পেছনে আলাদিনের চেরাগের মতো ভূমিকা পালন করেছে। এর বিনিময়ে তারাও অর্থ কামিয়েছেন সমানতালে; আর মনিরও ধনকুবের হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে অদ্যাবধি যারা খুব কাছ থেকে মনিরকে দেখেছেন, তাদের কাছেও তার জীবন যেন একটি সিনেমার গল্প। হকারি আর চোরাই স্বর্ণের কারবার থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে রাজউক ও গণপূর্তে নিজের 'ঘাঁটি' তৈরি করেন আলোচিত-সমালেচিত এই মনির। সমকালের তথ্যানুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে গোল্ডেন মনিরের দুষ্টচক্রের অন্তত ৪০-৪৫ জনের নাম। কে নেই তার দুষ্টচক্রে! এ তালিকায় রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব, রাজউক ও গণপূর্তের বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা-কর্মচারী। একাধিক সরকারি কর্মকর্তা মনির ও তার সিন্ডিকেট থেকে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। সূত্র জানায়, নানামুখী কারবারে জড়িয়ে মনির নিজে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মালয়েশিয়ায় তার 'সেকেন্ড হোম' থাকার তথ্য মিলেছে। অন্তত তিনটি মানি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে নামে-বেনামে সংশ্নিষ্ট মনির। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশেও টাকা পাচার করতেন বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
তিন মামলায় ১৮ দিনের রিমান্ডে নিয়ে মনির হোসেনকে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এর আগে গত ২০ নভেম্বর মনিরকে তার মেরুল বাড্ডার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এখন মনিরের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরই মধ্যে সিআইডির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা তার নামে-বেনামে সম্পদ ও অর্থের খোঁজ নিচ্ছেন।
জানা গেছে, রাজউকের তিন শাখায় প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল মনিরের। এগুলো হলো- লিজ দলিল, প্ল্যান ও স্টেট শাখা। রাজউকের দায়িত্বে থাকাকালে উপপরিচালক মোহাম্মদ উল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল মনিরের। এ ছাড়া রাজউকের আরও অন্তত ৪৫ জন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে গোল্ডেন মনিরের সখ্য ছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- আবু মুসা, মাহমুদুল হক, ওদুদ, ইফতেখার, আলম, আমজাদ, আবদুল হাই, মনির হোসেন, আখতারুজ্জামান, মো. হারুন, মোহাম্মদ রফিক, তরিকুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক সামসুল হক মিল্ক্কী প্রমুখ। এ ছাড়া রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমানের সঙ্গে সখ্য ছিল মনিরের। এমনকি বর্তমানে রাজউক ও গণপূর্তের আরও কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে 'নিজের লোক' বানিয়ে ফেলেছেন তিনি। তাদের মধ্যে আছেন- রাজউকের 'এ', 'ন' 'হ' 'আ' আদ্যাক্ষরের চার কর্মকর্তা, গণপূর্তের 'ন' ও 'শ' আদ্যাক্ষরের দু'জন কর্মকর্তা।
তবে রাজউকের এক কর্মকর্তাকে কখনোই 'কিনতে' পারেননি মনির। ওই কর্মকর্তার নাম আনিসুর রহমান মিয়া। তিনি রাজউকের পরিচালক (এস্টেট) ছিলেন। এক সময় তিনি নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের ডিসি ছিলেন। এই কর্মকর্তা বর্তমানে একটি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন।
রাজউকের বর্তমান পরিচালক শেখ শাহিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল গোল্ডেন মনিরের। এ ছাড়া 'র' আদ্যাক্ষরের আরেক রাজউক কর্মকর্তার নাম জানা গেছে। যাকে বর্তমান পদে পোস্টিং করিয়ে আনতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন মনির। মূলত ওই কর্মকর্তাকে এই পদে আনার নেপথ্য কারণ হলো, তার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেওয়া। এ ছাড়া ওই কর্মকর্তার একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আবাসন ব্যবসায় জড়িত। মনির তাকে সঙ্গে নিয়ে রাজউক থেকে প্লট বাগিয়ে আবাসন ব্যবসাও বিস্তৃত করার ছক আঁকেন।
গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক নেতার সখ্য ছিল। গ্রেপ্তার হওয়ার পরও মনিরের পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়েছেন একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে না পারায় সমবেদনাও জানান তিনি।
জানা গেছে স্বদেশ প্রপার্টিজ নামে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন পাওয়ার চমকপ্রদ তথ্য। ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন ছিল না। প্রতিষ্ঠানের ফাইলটি রাজউক থেকে পাস করে গণপূর্তে পাঠানো হয়। কমিশনের টানাপোড়েন নিয়ে ফাইলটা বেশ কিছুদিন ঝুলে ছিল। ফাইলটি পাস করাতে স্বদেশ প্রপার্টিজের অন্যতম মালিক সাবেক একজন মন্ত্রীর 'ঘনিষ্ঠ' লোকের শরণাপন্ন হন। তবে ফাইল পাস করাতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন তিনি। এরপর ফাইলটি পাস করানোর দায়িত্ব বর্তায় গোল্ডেন মনিরের ওপর। কারণ মনির স্বদেশ প্রপার্টিজের প্রায় ২১ শতাংশ শেয়ারের মালিক। বিএনপি সমর্থক সাবেক কাউন্সিলর একেএম কাইয়ুম কমিশনার স্বদেশ প্রপার্টিজের শেয়ার পুরোটাই মনিরের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এরপর বিদেশে পালিয়ে যান কাইয়ুম। সূত্রমতে, ২০১৮ সালে স্বদেশের ফাইল পাসের দায়িত্ব পাওয়ার পর গণপূর্তের এক বড় কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মনির। এক পর্যায়ে তিনি তাকে ঘুষের প্রস্তাব দেন। পরে ফাইলটি পাস করার বিনিময়ে ২৫ লাখ টাকা ওই কর্মকর্তার বাসায় পৌঁছে দেন মনির।
জানা গেছে, একটি বড় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান পূর্বাচলে বড় জায়গা বরাদ্দ পাওয়ার তৎপরতা চালাচ্ছে। মূলত রাজউক থেকে যে কোটায় তারা ওই জায়গাটি বরাদ্দ নিতে চান, তা সাধারণত সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের পাওয়ার কথা। যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো জমি নেই, তারা এ রকম প্লট পেতে পারে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক প্লট হিসেবে ওই জায়গাটি পাইয়ে দিতে ওই নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জোট বাঁধেন গোল্ডেন মনির। সব টেবিলের কর্মকর্তারা একমত হলেও এক বড় কর্মকর্তা ওই প্লট বরাদ্দে বাধা হয়ে দাঁড়ান। এরপর নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে ওই কর্মকর্তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন গোল্ডেন মনির। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভালো চেয়ার পাইয়ে দেওয়া ও পদচ্যুত করতে নিজের প্রভাব ও অর্থ ব্যয় করতেন মনির।
জানা গেছে, রাজউক ও গণপূর্তে কোনো কাজের জন্য অনেক সময় সহকারী পরিচালক ও উপপরিচালকদের সঙ্গে এক ধরনের মৌখিক চুক্তি করতেন মনির। তাদের মাধ্যমে টেবিলে টেবিলে তার ঘুষের টাকা পৌঁছে যেত। রাজউকের সিবিএ কার্যালয়ে বিরাট প্রভাব ছিল তার। কারণ, অনেক কর্মচারী দেখতেন উঁচুতলার লোকজনের সঙ্গে মনিরের খুব ভালো সম্পর্ক। তাই মনির রাজউকে গেলে এক ধরনের 'ভিআইপি মর্যাদা' পেতেন। সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানে 'জামাই আদর' পেতেন মনির।
উত্তরায় রাজউক কল্যাণ সমিতির নামে একটি বড় জায়গা রয়েছে। সেখানে ভবন তৈরির জন্য প্রথমে ভিএনএস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়। পরে সেই চুক্তি বাতিল হয়। একই জায়গায় ভবন তৈরির জন্য জমজম টাওয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী ৬০ শতাংশ পাবে ডেভেলপার আর ৪০ শতাংশ জমির মালিক। চুক্তির সময় সাইনিং মানি হিসেবে রাজউক পেয়েছিল ২৮ কোটি টাকা। ওই কাজ পেতেও প্রভাব রাখেন জমজম টাওয়ারের ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক গোল্ডেন মনির।
জানা গেছে, রাজউকে দুষ্টচক্র অত্যন্ত প্রভাবশালী। মূলত এই চক্রের সহযোগিতা ছাড়া প্লট হস্তান্তর কার্যক্রম বা নকশা পাস করা সম্ভব নয়। নানা অজুহাতে ফাইল আটকে থাকে তাদের কাছে। অনেকেই দ্রুত ফাইল পাস করানোর জন্য মনিরের শরণাপন্ন হতেন। এমনও ফাইল আছে, যেটা বছরের পর বছ ঘুরত। কিন্তু গোল্ডেন মনিরের কাছে গেলে এক মাসে পাস করিয়ে দিতেন তিনি। এতে নির্দিষ্ট কমিশন দেওয়া লাগত তাকে। আবার অনেক সময় আবাসিক প্লট বাণিজ্যিক প্লটে রূপ দিতেও মনির অনেককে সহযোগিতা করেছেন। রাজউক ও গণপূর্তের কাজ আদায় করতে অনেক কর্মকর্তাকে নামিদামি সামগ্রী অগ্রিম 'উপঢৌকন' দিতেন তিনি। মনিরের বাণিজ্যের আরেকটি ক্ষেত্র ছিল ভালো জায়গায় প্লট পাইয়ে দেওয়া। এ জন্য তিনি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতেন।
জানা গেছে, রাজউক থেকে বিভিন্ন ফাইল বের করতে নিচের সারির সদস্যদের টোপ দিতেন তিনি। এক সময় রাজউকের কর্মচারী পারভেজ তাকে এ কাজে সহায়তা করতেন। মনিরের ভাষ্য, রাজউক ও গণপূর্ত হলো 'গরম জায়গা'। সেখানকার কিছু অসাধু সদস্য মনে করেন, ফাইল পাস করার জন্য টাকা নেওয়া কোনো 'অপরাধ' নয়। অনেক কাজে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকায় 'সিস্টেমের' মধ্যে থেকেই সব আদায় করতে হয়।