ধর্ষণ মামলা তদন্তে দেরি কেন

সাহাদাত হোসেন পরশ আতাউর রহমান
প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২১ | ১৬:২৭
রাজধানীর খিলগাঁওয়ে গত বছরের ২০ মার্চ এক তরুণী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। এ ঘটনায় থানায় মামলার পর অভিযুক্ত দু'জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নিয়ম অনুযায়ী ওই তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়। আসামিদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেও পরীক্ষা করাতে পাঠানো হয়। কিন্তু তদন্তের সব কাজ পুলিশ গুছিয়ে আনলেও এখনও আদালতে চার্জশিট দাখিল করা যায়নি। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩ অনুযায়ী৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দেওয়ার কথা।
শুধু খিলগাঁওয়ের এই কেসস্টাডি নয়, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় করা ১০টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলার তদন্ত কার্যক্রম সম্পর্কে সমকালের পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সবক'টি মামলাই চাঞ্চল্যকর; অথচ একটি মামলারও সময়মতো চার্জশিট দাখিল করা যায়নি।
ধর্ষণ মামলার তদন্তেও এত দেরির কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন কাঙ্ক্ষিত সময়ে মিলছে না। ডিএনএ রিপোর্ট দিতে দেরির কারণেও আটকে রয়েছে অনেক মামলার চার্জশিট। রি-এজেন্ট সংকট থাকায় ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন দ্রুত মিলছে না। দিনের পর দিন এসব কারণে ধর্ষণের মামলার তদন্ত স্থবির হয়ে থাকছে। এ সময় অনেক আলামত নষ্ট হচ্ছে। তদন্তের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিচ্ছে আসামিরা।
ধর্ষণের মামলা করে এখনও বিচার পাননি- এমন দুটি পরিবার হতাশা প্রকাশ করে সমকালকে বলেন, এখনও অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনার পর নারীকেই সন্দেহ বা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখা হয়। অনেকে ধরেই নেন, ভুক্তভোগী নারী মিথ্যা বলছেন। সেখানে এমন মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ হওয়ার পর ন্যায়বিচার পেলে সমাজে অন্তত ভুক্তভোগী ও তার পরিবার সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে।
২০২০ সালে পরপর কয়েকটি ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মুখে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধনী এনে অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা এরই মধ্যে কার্যকরও করা হয়েছে। তবে তদন্ত ও বিচারের প্রক্রিয়ায় গলদ বা ফাঁকফোকর থাকলে আইন কঠোর করার পরও ভুক্তভোগীরা কাঙ্ক্ষিত সুফল পাবে না- এমন আশঙ্কা সংশ্নিষ্টদের। মাসের পর মাস মামলা ঝুলিয়ে না রেখে দ্রুত চার্জশিট পর্যায়ে নেওয়ার দিকে মনোযোগী হওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তারা।
মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ভুক্তভোগীর বয়স চার বছরের কম হলে বা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে সঠিক সময় নমুনা সংগ্রহ না করলে ডিএনএ রিপোর্ট পাওয়া যায় না। ডিএনএ পরীক্ষা দরকার, তবে এটা সব ঘটনায় অত্যাবশকীয় করা ঠিক হয়নি। কোনো কারণে ডিএনএ রিপোর্ট না পেলে আসামি পক্ষ পার পাওয়ার সুযোগ পাবে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হেড অব প্রোগ্রাম নীনা গোস্বামী বলেন, নতুন আইনে প্রতিটি মামলায় ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অন্যদিকে আমরা প্রথম থেকেই বলছি, কেস টু কেস ডিএনএ রিপোর্ট করার ওপর জোর দিতে। সব ঘটনায় ডিএনএ রিপোর্ট করানোর প্রয়োজন হওয়ায় এক ধরনের জট তৈরি হচ্ছে। আবার ঘটনার ডাক্তারি রিপোর্টও সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না। এতে তদন্ত শেষ করতে দেরি হচ্ছে। তদন্তে দীর্ঘ সময় লাগার জন্য শুধু পুলিশকে দোষ দিলে হবে না। অনেক সময় তদন্ত শেষ হওয়ার পরও বিচার চলার সময় নানা অসঙ্গতি ধরা পড়ে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯৭ ভাগ মামলার আসামিরা কেন পার পাচ্ছেন- এর কারণ খোঁজা দরকার। পাবলিক প্রসিকিউটর ভুক্তভোগীর বিচার পাওয়া নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। অথচ তদন্তে ত্রুটি থাকলে পুলিশ দিয়ে ফের তদন্ত করানো যায়।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি শাহাদাত হোসেন বলেন, ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট না পাওয়ায় মামলার তদন্তে দেরি হচ্ছে- এটা তদন্ত কর্মকর্তাদের এক ধরনের অজুহাত। আদালতের কোনো নির্দেশনা পেলে আমরা ডিএনএ পরীক্ষা করে থাকি। এখানে প্রতিবেদন আটকে থাকার সুযোগ নেই।
ডাক্তারি পরীক্ষায় দেরি হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) যারা ভর্তি হন, তাদের শারীরিক পরীক্ষার প্রতিবেদন খুব দ্রুত দেওয়া হয়। তবে অন্য জায়গা থেকে প্রতিবেদন চেয়ে যে আবেদন আসে তা দাখিল করতে নানা কারণে কিছুটা দেরি হয়। যেমন- যে চিকিৎসকের কাছে রোগী চিকিৎসা নিয়েছিলেন তিনি বদলি হয়ে গেলে প্রতিবেদন দিতে সময় কিছুটা বেশি লাগে।
নাজমুল হক জানান, তাদের কাছে প্রতিদিন গড়ে ৫০টির বেশি ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদনের জন্য আবেদন আসে। এখনও তিন হাজারের বেশি আবেদন রয়েছে। একজন চিকিৎসক তার দৈনন্দিন কাজ সেরেই এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করে সরবরাহ করেন। নানা কারণে ২-৪টি ঘটনা বাদে ডাক্তারি রিপোর্ট যথাসময়ে দেওয়া হয়। যে ২-৪টি দ্রুত দেওয়া যায় না, দেখা যায় সেগুলো নিয়ে কথা হয়।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি কারখানায় কাজ শেষে সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ীর বাসায় ফেরার সময় এক কিশোরী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। চার ব্যক্তি একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে। এ ধর্ষণের মামলা হওয়ার পর পুলিশ গত ১০ মাসে দু'জন আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে। এর মধ্যে ঘটনার শিকার কিশোরীর মেডিকেল প্রতিবেদনও পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার হওয়া দুই আসামির ডিএনএ প্রতিবেদনও মিলেছে। এরপরও পুলিশ নির্ধারিত সময়ে চার্জশিট না দিয়ে আদালত থেকে বারবার সময় নিচ্ছে।
তদন্ত শেষ হলেও সময়মতো কেন চার্জশিট দেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহীনুর রহমান বলেন, আরও দু'জন আসামি পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে না পারায় ডিএনএ টেস্ট করানো যায়নি। ওই টেস্টের প্রতিবেদন ছাড়া চার্জশিট জমা দিলে এবং বিচার কাজ শুরু হয়ে গেলে পলাতক দুই আসামি সুযোগ পেয়ে যাবে। এ জন্যই তদন্ত শেষ হলেও চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে না।
খিলগাঁও থানার অন্য একটি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলার তদন্ত নির্দিষ্ট সময়ের পরও শেষ না হওয়ার ব্যাপারে সেখানকার পরিদর্শক (তদন্ত) সুজিত কুমার সাহা বলেন, ডিএনএ রিপোর্ট পেতে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু টেস্টের রি-এজেন্ট না থাকায় প্রতিবেদন দিতে দেরি হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।
ঢাকায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের যে ১০টি মামলার তদন্ত নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায়নি, সেগুলোর মধ্যে বাড্ডা থানায় তিনটি, খিলগাঁও থানায় দুটি, কামরাঙ্গীরচর, ভাটারা, যাত্রাবাড়ী, কাফরুল ও দারুস সালাম থানায় একটি করে মামলা রয়েছে। অনেক চেষ্টায় নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পর বাড্ডা থানার তিনটি মামলায় গত ডিসেম্বরে আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। খিলগাঁও থানার দুটি মামলার একটিতে ডিএনএ রিপোর্ট পাওয়ার পর আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। কামরাঙ্গীরচর থানার মামলাটিরও সম্প্রতি চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এসব মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা বলেছেন, দীর্ঘদিন দৌড়ঝাঁপের পর তারা মেডিকেল রিপোর্ট সংগ্রহ করতে পারেন। এর পরই মামলার চার্জশিট দেন।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণ মামলায় ঘটনার শিকার তরুণীর ডিএনএ প্রতিবেদনের সঙ্গে অভিযুক্তের ডিএনএ প্রতিবেদন না মিললে শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন। তবে আসামি গ্রেপ্তার না হলে চার্জশিট দেওয়া যাবে না- এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। চার্জশিট জমা দেওয়ার পর পলাতক আসামি আদালতে হাজিরা দিলে বা তাকে গ্রেপ্তার করা গেলে তখন আদালতের অনুমতি নিয়ে ওই আসামির ডিএনএ পরীক্ষা করা সম্ভব।
জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ধর্ষণ বা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলাগুলোর তদন্ত পুলিশ নানা কারণে নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারছে না। এ জন্য বারবার আদালত থেকে সময় নিয়েও চার্জশিট জমা দেওয়া যাচ্ছে না। এতে নানা আলামত নষ্ট হওয়ায় আসামিদের শাস্তিও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সময়মতো মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় ক্ষমতাশালী আসামিরা ঘটনার শিকার নারী বা তার পরিবারের সঙ্গে মীমাংসায় চলে যাচ্ছে।
ঢাকার বিভিন্ন থানায় করা সংঘবদ্ধ মামলাগুলোর মধ্যে একটি ছিল কামরাঙ্গীরচরে। এ থানার পরিদর্শক শিকদার মুহিতুল আলম বলেন, গত বছরের জানুয়ারিতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলায় ৬ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মামলার তদন্তও শেষ হয় নির্ধারিত সময়েই। কিন্তু সময়মতো ডিএনএ রিপোর্ট না পাওয়ায় আদালতে চার্জশিট দিতেও দেরি হয়। সম্প্রতি তিনি মামলাটির চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছেন। গত বছরের ১ জানুয়ারি কাফরুলে বাসার ভেতর স্বামীকে বেঁধে নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ চালায় দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনায় তিন আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেন ঘটনার শিকার নারী। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় তিন আসামি গ্রেপ্তার হলেও নির্ধারিত সময়ে আদালতে চার্জশিট দিতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা।
এ প্রসঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তা কাফরুল থানার উপ-পরিদর্শক রবিউল ইসলাম জানান, তিনি আসামি গ্রেপ্তার করেছিলেন দ্রুততম সময়ে। মামলার তদন্তও শেষ হয়েছিল। কিন্তু ডিএনএ প্রতিবেদন না পাওয়ায় নির্ধারিত ৬০ কার্যদিবসে চার্জশিট জমা দিতে পারেননি। অবশ্য সম্প্রতি তিনি মামলার চার্জশিট জমা দিয়েছেন।
তদন্তের বিষয়ে আইনে যা আছে :নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩-এ বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনের সময় হাতেনাতে ধরা পড়লে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। অপরাধী হাতেনাতে ধরা না পড়লে অপরাধ সংঘটনের প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার পর বা তদন্তের আদেশ পাওয়ার ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। তবে যুক্তিসংগত কারণে আদালতের অনুমতি নিয়ে প্রথম দফায় এক মাস ও পরের দফায় আরও এক মাস সময় পেতে পারেন তদন্ত কর্মকর্তা।
আইনে বলা আছে, নির্ধারিত সময়ে তদন্ত শেষ না হওয়ার জন্য সংশ্নিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা দায়ী হলে তা ওই কর্মকর্তার অদক্ষতা ও অসদাচরণ বলে বিবেচিত হবে এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
একই আইনে অপরাধের শিকার ব্যক্তির মেডিকেল পরীক্ষার বিষয়ে বলা হয়েছে, যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে কোনো মেডিকেল পরীক্ষা সম্পন্ন না হওয়ার জন্য সংশ্নিষ্ট চিকিৎসক দায়ী হলে তা ওই কর্মকর্তার অদক্ষতা ও অসদাচরণ বলে বিবেচিত হবে এবং এই অসদাচরণ তার বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে লেখা হবে। পাশাপাশি উপযুক্ত ক্ষেত্রে চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, আইনে তদন্ত শেষ করার উল্লেখ থাকলেও কতদিনের মধ্যে মেডিকেল প্রতিবেদন দিতে হবে, তা উল্লেখ নেই। এই সুযোগটিই মেডিকেল থেকে নেওয়া হয়। এতে পুলিশের তদন্তও আটকে থাকে।
- বিষয় :
- রাজধানী
- ধর্ষণ
- ধর্ষণ মামলা
- মামলা তদন্ত
- তদন্ত