পার্ক ভেঙে ভাগাড়

পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে দৃষ্টিনন্দন পার্কটি (বাঁয়ে) ভেঙে ময়লা ফেলার 'এসটিএস' নির্মাণের জন্য টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে সমকাল
অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১৩:৫১
এক বছর আগেও সেখানে ছিল দৃষ্টিনন্দন একটি পার্ক। ছিল সবুজের সমারোহ। ফুল, গাছপালা-লতাগুল্মের ভেতরে ছিল পানির ফোয়ারা। স্বচ্ছ পানির তলদেশে মাছ ঘোরাফেরা করতে দেখা যেত, ভেসে বেড়াত হাঁস। টিলার মতো স্থাপনার ওপর থেকে ঝরনাধারা গড়িয়ে পড়ত নিচে পাথরের মধ্যে। ঘিঞ্জি পুরান ঢাকায় এই মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশে জড়ো হতে শুরু করেছিল পাখপাখালি।
কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, 'নগরে নিসর্গ' নামের সেই সুন্দর পার্কটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে তৈরি করা হচ্ছে ময়লার ভাগাড়। আশপাশের বাসিন্দাদের বাসাবাড়ির বর্জ্য ফেলার জন্য এ পার্ক ভেঙে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
রাজধানীর তাঁতীবাজারের প্রবেশমুখের এই 'নগরে নিসর্গ'কে এখন টিন দিয়ে ঘিরে ফেলে চলছে এসটিএস নির্মাণের কার্যক্রম। আশপাশে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক বেহাল অবস্থা, যা নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন এলাকাবাসী।
তাঁতীবাজার মোড়ের এই পার্ক এলাকা থেকেই প্রতি বছর যাত্রা শুরু করে তাঁতীবাজার-শাঁখারীবাজার-লক্ষ্মীবাজারের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ১৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা। তাঁতীবাজারের হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পূজা-পার্বণ বা উৎসবে এখানেই তৈরি করা হয় দৃষ্টিনন্দন গেট ও সাজসজ্জা। এসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মানুষ গাড়ি থেকে এখানে নেমেই তাঁতীবাজারে প্রবেশ করে। দেশি-বিদেশি মন্ত্রী-এমপিসহ যেসব অতিথি উৎসবে আসেন, তারাও পার্কের পাশে গাড়ি রেখে তাঁতীবাজারে ঢুকতেন। সাবেক মেয়র
সাঈদ খোকন সর্বশেষ রথযাত্রা উৎসবের উদ্বোধন করেছিলেন ওখান থেকেই।
বাবুবাজার দিয়ে বা সদরঘাট দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে চলাচলকারীদেরও মুগ্ধ করত এই পার্ক। কিন্তু এসটিএস তৈরি হলে রাজধানীতে আসার সময় যেমন, তেমনই যাওয়ার সময়ও তাদের চোখে স্থান করে নেবে বিশাল ময়লার ভাগাড়। রাজধানী ঢাকা সম্পর্কে শুরুতেই নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে তাদের। আর এলাকার বাসিন্দাদের কষ্টের কথা তো বলাই বাহুল্য।
এসব বিষয় নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা ইতোমধ্যে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। এ ছাড়া হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, তাঁতীবাজার সার্বজনীন পূজা কমিটি, তাঁতীবাজার বণিক সমিতি ও ইংলিশ রোড স্টিল অ্যাসোসিয়েশন ডিএসসিসি মেয়রের কাছে লিখিত আবেদনও দিয়েছে।
অন্য কোথাও এসটিএস নির্মাণের অনুরোধ জানিয়ে এসব আবেদনে তারা বলেছেন, পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মহল্লা তাঁতীবাজারে বহু মানুষের বসতি। যেখানে ডাস্টবিন তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও পূজা-অর্চনার আয়োজন করেন। শতাব্দীপ্রাচীন বার্ষিক রথযাত্রার রথ চলার সময় রথটি এখানেই রাখা হয়। শারদীয় দুর্গাপূজার সময় স্থানটি মিলনমেলায় পরিণত হয়। আশপাশের মহল্লা বিশেষত শাঁখারীবাজার, গোয়ালনগর, কোতোয়ালি রোড, ঝুলনবাড়ি অঞ্চলের লোকজন কোথাও যেতে চাইলে তাঁতিবাজারের মোড়ে এসে যানবাহনে ওঠেন। অথচ এমন স্থানে ডাস্টবিনটি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সিটি করপোরেশন। এটি তৈরি করা হলে মানুষের পূজা-পার্বণে যেমন সমস্যা হবে, তেমনই অন্য কোনো সময়েও সেখানে আর একত্রিত হওয়া সম্ভব হবে না। সার্বিক বিবেচনায় তারা বর্জ্য সংগ্রহের কক্ষ নির্মাণ সেখানে না করে অন্য কোথাও সুবিধাজনক স্থানে নির্মাণের অনুরোধ জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, জায়গাটি পার্কের জন্যই মানানসই, এসটিএসের জন্য কোনোভাবেই নয়।
জায়গাটিকে এসটিএস নির্মাণের জন্য চূড়ান্ত করার কারণ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর বদরুল আমিন সমকালকে বলেন, অনেক দেখেশুনে বিচার-বিশ্নেষণ করেই এ স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। মেয়রও জায়গাটি দেখেছেন। তার পরই এটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, জায়গাটা বেদখল হয়ে গেলে রক্ষা করা যাবে না। এক সময় এ জায়গা তো প্রায় বেদখলই হয়ে গিয়েছিল। এখন সেখানে একটি এসটিএস তৈরি করা হচ্ছে। পাশের জায়গায় পার্কটি তৈরি করা হবে।
অবশ্য এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুন্সি আবুল হাশেম জানান, পার্কটিতে এসটিএস তৈরির ব্যাপারে মিটিং হয়েছিল। তার যতটুকু মনে পড়ে, স্থানীয় কাউন্সিলরদের পরামর্শেই জায়গাটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাকিটা প্রকল্প পরিচালক বলতে পারবেন। তবে তারও অভিমত, এসটিএসের জন্য জায়গা নির্বাচনটা সঠিক হয়নি।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক কাজী বোরহান উদ্দিন বলেন, ওই ওয়ার্ডে জায়গা পাওয়া যায়নি। একজন কাউন্সিলর নবাব ইউসুফ মার্কেটের পাশে একটি জায়গার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেখানে এসটিএস হলে পুরো মার্কেটটাই নষ্ট হয়ে যায়। মেয়র চাইছেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি এসটিএস থাকবে। রাস্তায় কোনো ডাস্টবিন থাকবে না। পরে কাউন্সিলর ও আমরা সবাই বসেই জায়গাটা চূড়ান্ত করি। অবশ্য একটা কাজ করা যেত- এটি প্রবেশমুখে না করে পূর্বদিকে করা যেত। কিন্তু যখন সিদ্ধান্ত হয়, তখন চিত্রটা এরকম ছিল না।
অবশ্য এ প্রসঙ্গে ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের (তাঁতীবাজার এলাকা) কাউন্সিলর রঞ্জন বিশ্বাস সমকালকে বলেন, এসটিএস তৈরির জন্য আরও দুটি জায়গা দেখিয়েছিলাম। পাশের ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও মেয়রকে বলেছিলেন এখানে এসটিএস না করতে। কিন্তু পিডি হয়তো মেয়রকে ভুল বুঝিয়ে ওই জায়গাটাই চূড়ান্ত করেছেন। এখন মেয়র এটা সেখানেই করতে চান।
পাশের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের (ইংলিশ রোড এলাকা) কাউন্সিলর আবু সাঈদ বলেন, এমন একটা সুন্দর জায়গার মধ্যে এসটিএস হলে দৃষ্টিকটু দেখা যায়। পার্কের জায়গায় ময়লার এসটিএস হবে- এটা হয় না। আমরা দু'জন কাউন্সিলরই আপত্তি করেছিলাম। মেয়র বললেন, তাহলে ময়লা কোথায় রাখা হবে? এসব নিয়ে অনেকে আবেদনও করেছেন। পূজা কমিটি, ব্যবসায়ী সমিতিও আবেদন করেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, ইংলিশ রোডের দক্ষিণ পাশে তাঁতীবাজার মোড় থেকে পূর্বমুখে পপুলার ডায়াগনস্টিক পর্যন্ত লম্বাকৃতির প্রায় তিন বিঘা জায়গা। এর মধ্যে তাঁতীবাজার মোড়ের অংশে প্রায় ১৫ কাঠা জমি টিন দিয়ে ঘিরে চলছে এসটিএসের কাজ। বাকি জায়গাও টিন দিয়ে ঘেরা। ভেতরে দু-একটি গাছ এখনও পার্কের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
এই পুরো জায়গাই একসময় পার্ক ছিল বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা ও বৃন্দাবন স্বর্ণকুঞ্জের মালিক মিলন চন্দ্র শীল। তিনি বলেন, এক সময় সিটি করপোরেশন তাঁতীবাজার মোড়ে একটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করতে চেয়েছিল। তখন এলাকাবাসী আপত্তি জানায়। তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে জানালে তিনি সঙ্গে সঙ্গে পাবলিক টয়লেটের কাজ বন্ধ করে দেন। অথচ সেখানে এখন তৈরি করা হচ্ছে ময়লা ফেলার জায়গা!
স্থানীয় বাসিন্দা ইউরেকা গোল্ড হাউসের মালিক সুজন সরকার বলেন, ডিএসসিসির এই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে এলাকাবাসী প্রতিবাদ জানিয়ে পুরো এলাকায় ব্যানার টানায়। একদিন রাত ১২টার সময় সিটি করপোরেশনের ৩০-৩৫ জন লোক এসে সেগুলো খুলে নিয়ে যায়। কিছুদিন আগে কাজ শুরু করলে এলাকাবাসী বাধা দেয়। তখন থেকে কাজের গতি কম। তিনি বলেন, এই এসটিএস তৈরি করার অর্থ তাদের ওপর পরোক্ষভাবে আঘাত করা।
তাঁতীবাজার পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি প্রদীপ দে খোকন বলেন, চার রাস্তার মোড়ের মতো জনবহুল স্থানে ডাস্টবিন স্থাপন করলে এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। পূজা-পার্বণ উদযাপনে তো ব্যাঘাত ঘটবেই; সার্বিক দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ করেন তিনি।
মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জ্যোতির্ময় দাস বলেন, তারা তিনবার মেয়রের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে গেছেন। একবার দেখা দিয়েছেন। তখন মেয়র বলেছেন, সেখানে এমনভাবে ঘেরা হবে, যাতে কোনো দুর্গন্ধ ছড়াতে না পারে। কিন্তু যেখানেই এ ধরনের ময়লা ফেলার জায়গা করা হয়েছে, সেখানেই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। এরকম একটি জায়গায় এসটিএস তৈরি করা কোনোভাবেই মানানসই নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের মন্তব্য জানতে করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছেরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, সেখানে এসটিএস নির্মাণ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেওয়ার কথা তিনি নিজেও জানতে পেরেছেন। স্থানীয় কাউন্সিলর বা এসটিএস নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ হয়তো মেয়রকে ভুল বুঝিয়ে জায়গাটি চূড়ান্ত করেছেন। বিষয়টি তিনি মেয়রকে জানাবেন। কোনো প্রতিক্রিয়া থাকলে পরে জানাবেন।
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান সমকালকে বলেন, এমনিতেই ঢাকা শহরে পার্ক-খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানের বড় অভাব। কাজেই যেগুলো আছে, সেগুলো আমাদের রক্ষা করতে হবে। তাঁতীবাজার মোড়ের পার্ক ভেঙে সেখানে এসটিএস তৈরি করা মোটেই যৌক্তিক নয়। করপোরেশন প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করে সুবিধাজনক স্থানে এসটিএস তৈরি করতে পারে।
কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, 'নগরে নিসর্গ' নামের সেই সুন্দর পার্কটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে তৈরি করা হচ্ছে ময়লার ভাগাড়। আশপাশের বাসিন্দাদের বাসাবাড়ির বর্জ্য ফেলার জন্য এ পার্ক ভেঙে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
রাজধানীর তাঁতীবাজারের প্রবেশমুখের এই 'নগরে নিসর্গ'কে এখন টিন দিয়ে ঘিরে ফেলে চলছে এসটিএস নির্মাণের কার্যক্রম। আশপাশে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক বেহাল অবস্থা, যা নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন এলাকাবাসী।
তাঁতীবাজার মোড়ের এই পার্ক এলাকা থেকেই প্রতি বছর যাত্রা শুরু করে তাঁতীবাজার-শাঁখারীবাজার-লক্ষ্মীবাজারের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ১৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা। তাঁতীবাজারের হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পূজা-পার্বণ বা উৎসবে এখানেই তৈরি করা হয় দৃষ্টিনন্দন গেট ও সাজসজ্জা। এসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মানুষ গাড়ি থেকে এখানে নেমেই তাঁতীবাজারে প্রবেশ করে। দেশি-বিদেশি মন্ত্রী-এমপিসহ যেসব অতিথি উৎসবে আসেন, তারাও পার্কের পাশে গাড়ি রেখে তাঁতীবাজারে ঢুকতেন। সাবেক মেয়র
সাঈদ খোকন সর্বশেষ রথযাত্রা উৎসবের উদ্বোধন করেছিলেন ওখান থেকেই।
বাবুবাজার দিয়ে বা সদরঘাট দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে চলাচলকারীদেরও মুগ্ধ করত এই পার্ক। কিন্তু এসটিএস তৈরি হলে রাজধানীতে আসার সময় যেমন, তেমনই যাওয়ার সময়ও তাদের চোখে স্থান করে নেবে বিশাল ময়লার ভাগাড়। রাজধানী ঢাকা সম্পর্কে শুরুতেই নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে তাদের। আর এলাকার বাসিন্দাদের কষ্টের কথা তো বলাই বাহুল্য।
এসব বিষয় নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা ইতোমধ্যে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। এ ছাড়া হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, তাঁতীবাজার সার্বজনীন পূজা কমিটি, তাঁতীবাজার বণিক সমিতি ও ইংলিশ রোড স্টিল অ্যাসোসিয়েশন ডিএসসিসি মেয়রের কাছে লিখিত আবেদনও দিয়েছে।
অন্য কোথাও এসটিএস নির্মাণের অনুরোধ জানিয়ে এসব আবেদনে তারা বলেছেন, পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মহল্লা তাঁতীবাজারে বহু মানুষের বসতি। যেখানে ডাস্টবিন তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও পূজা-অর্চনার আয়োজন করেন। শতাব্দীপ্রাচীন বার্ষিক রথযাত্রার রথ চলার সময় রথটি এখানেই রাখা হয়। শারদীয় দুর্গাপূজার সময় স্থানটি মিলনমেলায় পরিণত হয়। আশপাশের মহল্লা বিশেষত শাঁখারীবাজার, গোয়ালনগর, কোতোয়ালি রোড, ঝুলনবাড়ি অঞ্চলের লোকজন কোথাও যেতে চাইলে তাঁতিবাজারের মোড়ে এসে যানবাহনে ওঠেন। অথচ এমন স্থানে ডাস্টবিনটি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সিটি করপোরেশন। এটি তৈরি করা হলে মানুষের পূজা-পার্বণে যেমন সমস্যা হবে, তেমনই অন্য কোনো সময়েও সেখানে আর একত্রিত হওয়া সম্ভব হবে না। সার্বিক বিবেচনায় তারা বর্জ্য সংগ্রহের কক্ষ নির্মাণ সেখানে না করে অন্য কোথাও সুবিধাজনক স্থানে নির্মাণের অনুরোধ জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, জায়গাটি পার্কের জন্যই মানানসই, এসটিএসের জন্য কোনোভাবেই নয়।
জায়গাটিকে এসটিএস নির্মাণের জন্য চূড়ান্ত করার কারণ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর বদরুল আমিন সমকালকে বলেন, অনেক দেখেশুনে বিচার-বিশ্নেষণ করেই এ স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। মেয়রও জায়গাটি দেখেছেন। তার পরই এটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, জায়গাটা বেদখল হয়ে গেলে রক্ষা করা যাবে না। এক সময় এ জায়গা তো প্রায় বেদখলই হয়ে গিয়েছিল। এখন সেখানে একটি এসটিএস তৈরি করা হচ্ছে। পাশের জায়গায় পার্কটি তৈরি করা হবে।
অবশ্য এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুন্সি আবুল হাশেম জানান, পার্কটিতে এসটিএস তৈরির ব্যাপারে মিটিং হয়েছিল। তার যতটুকু মনে পড়ে, স্থানীয় কাউন্সিলরদের পরামর্শেই জায়গাটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাকিটা প্রকল্প পরিচালক বলতে পারবেন। তবে তারও অভিমত, এসটিএসের জন্য জায়গা নির্বাচনটা সঠিক হয়নি।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক কাজী বোরহান উদ্দিন বলেন, ওই ওয়ার্ডে জায়গা পাওয়া যায়নি। একজন কাউন্সিলর নবাব ইউসুফ মার্কেটের পাশে একটি জায়গার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেখানে এসটিএস হলে পুরো মার্কেটটাই নষ্ট হয়ে যায়। মেয়র চাইছেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি এসটিএস থাকবে। রাস্তায় কোনো ডাস্টবিন থাকবে না। পরে কাউন্সিলর ও আমরা সবাই বসেই জায়গাটা চূড়ান্ত করি। অবশ্য একটা কাজ করা যেত- এটি প্রবেশমুখে না করে পূর্বদিকে করা যেত। কিন্তু যখন সিদ্ধান্ত হয়, তখন চিত্রটা এরকম ছিল না।
অবশ্য এ প্রসঙ্গে ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের (তাঁতীবাজার এলাকা) কাউন্সিলর রঞ্জন বিশ্বাস সমকালকে বলেন, এসটিএস তৈরির জন্য আরও দুটি জায়গা দেখিয়েছিলাম। পাশের ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও মেয়রকে বলেছিলেন এখানে এসটিএস না করতে। কিন্তু পিডি হয়তো মেয়রকে ভুল বুঝিয়ে ওই জায়গাটাই চূড়ান্ত করেছেন। এখন মেয়র এটা সেখানেই করতে চান।
পাশের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের (ইংলিশ রোড এলাকা) কাউন্সিলর আবু সাঈদ বলেন, এমন একটা সুন্দর জায়গার মধ্যে এসটিএস হলে দৃষ্টিকটু দেখা যায়। পার্কের জায়গায় ময়লার এসটিএস হবে- এটা হয় না। আমরা দু'জন কাউন্সিলরই আপত্তি করেছিলাম। মেয়র বললেন, তাহলে ময়লা কোথায় রাখা হবে? এসব নিয়ে অনেকে আবেদনও করেছেন। পূজা কমিটি, ব্যবসায়ী সমিতিও আবেদন করেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, ইংলিশ রোডের দক্ষিণ পাশে তাঁতীবাজার মোড় থেকে পূর্বমুখে পপুলার ডায়াগনস্টিক পর্যন্ত লম্বাকৃতির প্রায় তিন বিঘা জায়গা। এর মধ্যে তাঁতীবাজার মোড়ের অংশে প্রায় ১৫ কাঠা জমি টিন দিয়ে ঘিরে চলছে এসটিএসের কাজ। বাকি জায়গাও টিন দিয়ে ঘেরা। ভেতরে দু-একটি গাছ এখনও পার্কের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
এই পুরো জায়গাই একসময় পার্ক ছিল বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা ও বৃন্দাবন স্বর্ণকুঞ্জের মালিক মিলন চন্দ্র শীল। তিনি বলেন, এক সময় সিটি করপোরেশন তাঁতীবাজার মোড়ে একটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করতে চেয়েছিল। তখন এলাকাবাসী আপত্তি জানায়। তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে জানালে তিনি সঙ্গে সঙ্গে পাবলিক টয়লেটের কাজ বন্ধ করে দেন। অথচ সেখানে এখন তৈরি করা হচ্ছে ময়লা ফেলার জায়গা!
স্থানীয় বাসিন্দা ইউরেকা গোল্ড হাউসের মালিক সুজন সরকার বলেন, ডিএসসিসির এই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে এলাকাবাসী প্রতিবাদ জানিয়ে পুরো এলাকায় ব্যানার টানায়। একদিন রাত ১২টার সময় সিটি করপোরেশনের ৩০-৩৫ জন লোক এসে সেগুলো খুলে নিয়ে যায়। কিছুদিন আগে কাজ শুরু করলে এলাকাবাসী বাধা দেয়। তখন থেকে কাজের গতি কম। তিনি বলেন, এই এসটিএস তৈরি করার অর্থ তাদের ওপর পরোক্ষভাবে আঘাত করা।
তাঁতীবাজার পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি প্রদীপ দে খোকন বলেন, চার রাস্তার মোড়ের মতো জনবহুল স্থানে ডাস্টবিন স্থাপন করলে এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। পূজা-পার্বণ উদযাপনে তো ব্যাঘাত ঘটবেই; সার্বিক দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ করেন তিনি।
মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জ্যোতির্ময় দাস বলেন, তারা তিনবার মেয়রের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে গেছেন। একবার দেখা দিয়েছেন। তখন মেয়র বলেছেন, সেখানে এমনভাবে ঘেরা হবে, যাতে কোনো দুর্গন্ধ ছড়াতে না পারে। কিন্তু যেখানেই এ ধরনের ময়লা ফেলার জায়গা করা হয়েছে, সেখানেই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। এরকম একটি জায়গায় এসটিএস তৈরি করা কোনোভাবেই মানানসই নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের মন্তব্য জানতে করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছেরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, সেখানে এসটিএস নির্মাণ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেওয়ার কথা তিনি নিজেও জানতে পেরেছেন। স্থানীয় কাউন্সিলর বা এসটিএস নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ হয়তো মেয়রকে ভুল বুঝিয়ে জায়গাটি চূড়ান্ত করেছেন। বিষয়টি তিনি মেয়রকে জানাবেন। কোনো প্রতিক্রিয়া থাকলে পরে জানাবেন।
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান সমকালকে বলেন, এমনিতেই ঢাকা শহরে পার্ক-খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানের বড় অভাব। কাজেই যেগুলো আছে, সেগুলো আমাদের রক্ষা করতে হবে। তাঁতীবাজার মোড়ের পার্ক ভেঙে সেখানে এসটিএস তৈরি করা মোটেই যৌক্তিক নয়। করপোরেশন প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করে সুবিধাজনক স্থানে এসটিএস তৈরি করতে পারে।
- বিষয় :
- পার্ক ভেঙে ভাগাড়