সচেতনতা দিবস আজ
ফিরবে শকুনের 'সুদিন'

শকুনকে বলা হয় প্রকৃতির 'পরিচ্ছন্নতাকর্মী'- সংগৃহীত
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৬:৪৩
কয়েক যুগ আগেও গ্রামে-গঞ্জে যেখানে-সেখানে দেখা যেত শকুন। মাঠে গরু মরে পড়ে থাকলে ঝাঁক বেঁধে নামত শকুন। দিনে দিনে প্রকৃতির এ 'পরিচ্ছন্নতাকর্মী' বিলুপ্তির পথে। ১৯৯০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৯৯ শতাংশ শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন। তবে গত ১০ বছরে শকুন রক্ষায় সরকারের বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত এবং আইইউসিএনের নানা উদ্যোগে সেই পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। বিশেষজ্ঞদের আশা, শকুনের সুদিন ফিরে আসবে। সঠিকভাবে শকুনের পরিচর্যা করলে বাংলাদেশের আকাশে আবার তাদের দেখা মিলবে।
পরিবেশবিদেরা বলছেন, প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করা বর্জ্যভুক প্রাণী শকুন। এটি শুধু প্রকৃতিকে পরিস্কারই রাখে না, জীবাণুমুক্তও রাখে। মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে শকুন। বিভিন্ন রোগের জীবাণু যেমন অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্ণা রোগের সংক্রমণসহ অন্তত ৪০টি রোগের ঝুঁকি থেকে মানুষ ও পশু-পাখিকে রক্ষা করে। শকুন আকাশে উড়ে বেড়ানোর সময় নিচের সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পায় বলে প্রাণীর মৃতদেহ দেখে নেমে আসে। একদল শকুন মাত্র ২০ মিনিটে একটি গরুর মরদেহ খেয়ে শেষ করে দিতে পারে।
বন বিভাগ ও আইইউসিএনের জরিপে দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে পরিযায়ীসহ মোট শকুনের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। ২০১২ সালে তা মাত্র ৫৫০টিতে নেমে আসে। ২০১৬ সালে দেশে শকুন দেখা যায় ২৪০টি। ২০১৮ সালের বন বিভাগ ও আইইউসিএনের সর্বশেষ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে শকুন দেখা গেছে ২৬০টি।
শকুন রক্ষায় বন বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছে আইইউসিএন। ২০১৩ সালে 'বাংলাদেশ জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি' গঠন করা হয়েছে। হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে সীমান্তঘেঁষা রেমা-কালেঙ্গা বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য কেন্দ্র দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনাঞ্চল হিসেবেই পরিচিত। ২০১৪ সাল থেকে রেমা-কালেঙ্গায় আইইউসিএন বাংলাদেশের শকুন গবেষণা প্রকল্প গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। শকুনের জন্য একটি ফিডিং সেন্টার খুলেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখানে ২০১৪ সালে শকুনের প্রজনন সফলতা ছিল ৪৪ শতাংশ। ২০২০ সালে তা বেড়ে ৫৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৬ সালে অসুস্থ ও আহত শকুনদের উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দিনাজপুরের বীরগঞ্জের সিংড়ায় একটি শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া সুন্দরবনে দুটি ফিডিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে।
পাখিটির বিচরণ দর্শন এখন দুর্লভ হলেও ঢাকার জাতীয় চিড়িয়াখানায় গেলে তা দেখার সুযোগ রয়েছে। ১৯৭৯ সালে মিরপুর চিড়িয়াখানায় প্রথম শকুন সংরক্ষণ শুরু হয়। তিনটি শকুনের মাধ্যমে সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছিল কর্তৃপক্ষ। পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষের হাতে ধরা পড়া আরও চারটি শকুন এখানে আসে। ২০১৬ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে একটি পুরুষ শকুন মারা যাওয়ার পর এখন টিকে আছে ছয়টি। কিন্তু আয়ুস্কাল ফুরিয়ে আসা সেই শকুনগুলোর প্রজনন সক্ষমতা নেই। এদের প্রজনন সক্ষমতার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসেনি বলে জানান চিড়িয়াখানার পরিচালক আব্দুল লতিফ।
আইইউসিএনের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমিন বলেন, লাখ লাখ শকুন ছিল, সেখানে ২৬০টিতে নেমেছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত শকুন ফিরে আসার জন্য ক্ষতিকর ওষুধ ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশই প্রথম দেশ, যারা ক্ষতিকর কিটোপ্রোফেন ওষুধও নিষিদ্ধ করেছে। এটা আমাদের জন্য বড় সফলতা। সরকার আইইউসিএন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ওষুধ কোম্পানি ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এটার পেছনে কাজ করেছে। নতুন করে কোনো ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে না।
তিনি বলেন, শকুন রক্ষায় এখন দরকার নজরদারি। বড় গাছ রক্ষা করতে হবে। রেমা-কালেঙ্গা অংশের বন যেন নষ্ট না হয়। এর পাশে ভারতের কিছু অংশে এখনও কিছু ক্ষতিকর ওষুধ নিষিদ্ধ হয়নি। এ বিষয়ে আন্তঃসরকার পর্যায়ে আলোচনা করা দরকার।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, ২০১৬ সালে ১০ বছর মেয়াদি (২০১৬-২৫) শকুন সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে, যা দেশের শকুন রক্ষা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কাঠামো হিসেবে কাজ করছে। ২০১৭ ও ২০১৯ সালে দেশে সপ্তম ও অষ্টম আঞ্চলিক পরিচালনা কমিটির সভায় শকুন সংরক্ষণে বিভিন্ন কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার শকুন সংরক্ষণের জন্য একটি মাইলফলক। সরকার শকুন সংরক্ষণে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সবাই সচেতন হলে হারিয়ে যাওয়া শকুন আবার ফিরে আসবে।
আজ শকুন সচতেনতা দিবস :৪ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের প্রথম শনিবার দিবসটি পালন করা হয়। এবার দিবসটি উপলক্ষে বন বিভাগ এবং আইইউসিএনের উদ্যোগে ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। আইইউসিএন ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশে দিবসটি পালন করে আসছে।
- বিষয় :
- সচেতনতা দিবস আজ
- শকুন
- সচেতনতা দিবস