ফোনালাপ ফাঁস
চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রীকে রাবি প্রোভিসি বলেন, 'কত টাকা দিতে প্রস্তুত'

প্রতীকী ছবি
রাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০১৯ | ০৯:২৭ | আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৯ | ১০:০০
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপ-উপাচার্য (প্রোভিসি) অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়ার সঙ্গে এক চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রীর মোবাইল ফোনে কথপোকথনের একটি অডিও ফাঁস হয়েছে।
সোমবার রাতে ৫৫ সেকেন্ডের এ অডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কথপোকথনে কত টাকা দিতে প্রস্তুত, চাকরি প্রত্যাশীর স্ত্রীকে এমন প্রশ্ন করেন অধ্যাপক জাকারিয়া। এছাড়াও তিনি তাকে আশ্বস্ত করে বলেন- 'উপরে আল্লাহ তায়ালা আর নিচে আমি'।
অডিওটি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। দু'জনের কথপোকথনটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
অধ্যাপক জাকারিয়া: হ্যাঁ, সাদিয়া (চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রী)। আমি প্রফেসর জাকারিয়া, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর।
সাদিয়া: আসসালামু আলাইকুম স্যার।
অধ্যাপক জাকারিয়া: ওয়ালাইকুমুস সালাম। আচ্ছা মা, একটা কথা বলতো, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা, তোমরা কয় টাকা দেওয়ার জন্য রেডি?
সাদিয়া: স্যার, সত্যি কথা বলতে...
অধ্যাপক জাকারিয়া: না না, সত্যি কথাই তো বলবা। উপরে আল্লাহ তায়ালা, নিচে আমি।
সাদিয়া: অবশ্যই, অবশ্যই। স্যার, আপনি যেহেতু তার অবস্থা জানেন, আরেকটা বিষয় এখানে স্যার, সেটা হচ্ছে, আপনি হুদার (সাদিয়ার স্বামী)... মানে, এমনিতে সে কতটা স্ট্রিক আপনি বোধহয় এটাও জানেন স্যার, একটু রগচটা ছেলে।
অধ্যাপক জাকারিয়া: আচ্ছা রাখো রাখো, এখান থেকে কথা বলা যাবে না। ... এরপর ফোনটি কেটে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষক পদে তিনজনকে নিয়োগের জন্য জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। এতে নুরুল হুদা নামে একজন আবেদন করেন। তিনি বিভাগের সাবেক ছাত্র এবং তার স্ত্রী সাদিয়া একই বিভাগের চতুর্থ বর্ষে পড়েন।
বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নুরুল হুদা স্নাতকে সিজিপিএ ৩.৬৫ ও স্নাতকোত্তরে ৩.৬০ পান। আইন অনুষদে সেরা হওয়ায় ২০১৭ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক এবং পরের বছর প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পান। তার বাড়ি উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার এলাকা লালমনিরহাটে।
বিভাগ সূত্রে আরও জানা যায়, তিনটি প্রভাষক পদের বিপরীতে মোট আবেদন করেন ৪১ জন। তাদের মধ্যে ৯ জনের স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে সিজিপিএ ৩.৫০ বা এর উর্ধ্বে রয়েছে। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৩৩ জন আবেদনকারীর ফল ৩.৫০ বা এর উর্ধ্বে। গত বছরের ১৩ নভেম্বর নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ নভেম্বর সিন্ডিকেট সভায় নিয়োগ অনুমোদন হয়। বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান সাইমুন তুহিন নামে একজন। নিয়োগের কিছুদিন পর তার সঙ্গে অধ্যাপক জাকারিয়ার মেয়ের বিয়ে হয়। নিয়োগ পাওয়া অন্য দু'জন হলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম ঠান্ডুর মেয়ে নূর নূসরাত সুলতানা ও বিভাগের সাবেক ছাত্রী বনশ্রী রাণী। নিয়োগপ্রাপ্তরা সিন্ডিকেট সভার পরদিনই বিভাগে যোগদান করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সিন্ডিকেট সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিয়োগ বোর্ডে ৫ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বোর্ডে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক জাকারিয়াও ছিলেন। এছাড়াও উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান, আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল হান্নান, সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ডা. রুস্তম উদ্দিন আহমেদ ও এক্সপার্ট হিসেবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মন্ডল উপস্থিত ছিলেন।
আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল হান্নান বলেন, নিয়োগ বোর্ডে বিভাগের সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। বোর্ডে ফলাফলের ভিত্তিতে যোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিন্ডিকেটের এক সদস্য অভিযোগ করেন, 'নিয়োগ বোর্ড ও তার আগেই (ব্যক্তিগত প্রভাবে) ঠিক হয়- কে নিয়োগ পাবে। সিন্ডিকেটে চূড়ান্ত নির্বাচিতদের উপস্থাপন করা হয়। এখানে সদস্যরা শুধু সম্মতি দেয় এবং তাদের যোগ্যতা দেখে। নিয়োগ নিয়ে সিন্ডিকেটে যা হয়, তাকে আসলে এক ধরনের তামাশা বলা চলে।'
নিয়োগ বোর্ডের এপপার্ট ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মন্ডল সমকালকে বলেন, 'নিয়োগ বোর্ড বসার আগে আমাকে কয়েকজন শিক্ষক বলেছিল সতর্ক থাকতে। এখানে আর্থিক লেনদেন হতে পারে। আমরা সতর্ক ছিলাম। নিয়োগ নিয়ে আগে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনের চুক্তি হয়েছিল কি-না জানি না।' নুরুল হুদার আবেদনের বিষয়টি তারও জানা আছে বলে জানান অধ্যাপক মণ্ডল। তবে হুদা স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী এটা তার জানা ছিল না বলে জানান।
নিয়োগ বোর্ডের এক্সপার্টকে সতর্ক থাকতে বলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র এক অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য এসেছিল নিয়োগটি নিয়ে আর্থিক লেনদেন হচ্ছে। এমন সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমি উনাকে সতর্ক থাকতে বলেছিলাম। একজন নিয়োগ পেতে আর্থিক লেনদেন করেছিল বলে জেনেছিলাম, তবে ওই প্রার্থীর ফল ভালো না থাকায় নিয়োগ হয়নি।' তবে নুরুল হুদার সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তার কাছে কোনো তথ্য নেই বলে জানান তিনি।
উপ-উপাচার্যের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথপোকথনকারী সাদিকাকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা ধরেননি।
নুরুল হুদার ফোনে কল করা হলে কোনো মন্তব্য করতে চান না বলে সংযোগ কেটে দেন। এরপর তাকে একাধিকবার কল করলেও তিনি আর ধরেননি।
তবে ফাঁস হওয়া রেকর্ডকে আংশিক ও খন্ডিতভাবে উপস্থাপন করে তার সম্মানহানির চেষ্টা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক জাকারিয়া। এ ব্যাপারে তিনি তার বক্তব্য সাংবাদিকদের কাছে মেইল করেন। অধ্যাপক জাকারিয়া তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, 'নুরুল হুদা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার ছাত্র জীবনের শুরু থেকে আমি স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে দেখভাল করছি। তার লেখাপড়া চলমান রাখতে তাকে দু'টি স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি, হুদা চাকরি পেতে অসাধু কিছু ব্যক্তির কবলে পড়ে আর্থিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়েছে। নীলফামারীর সৈয়দপুরে ইসলামী ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার একটি স্লিপও আমাদের নজরে আসে। স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে তার এহেন অসাধুকর্ম রোধকল্পে খোঁজ নেওয়ার জন্য তার স্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলাম। কারণ হুদার স্ত্রীর বাড়ি সৈয়দপুরে। হুদার স্ত্রী সে সময় ব্যাংক লেনদেনের বিষয়টি স্বীকারও করে, তবে বিস্তারিত বলতে রাজি হয়নি।'
স্বর্ণপদক পাওয়া শিক্ষার্থী নুরুল হুদার নিয়োগ কেন হলো না, এমন প্রশ্নে উপ-উপাচার্য বলেন, হুদার টাকার লেনদেনের বিষয়টি নিয়োগ বোর্ড জেনে যায়। ফলে তারা আর তার বিষয়টি বিবেচনা করেনি।
এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান।