চাকরির শর্তে নেই তবুও গাড়িবিলাস

অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ | ১৪:১৫
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজার স্টাফ অফিসার ওয়াহিদুজ্জামান। পদমর্যাদায় তিনি জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব। প্রেষণে ডিএনসিসিতে কর্মরত। সরকারি গাড়ি (ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, তার ব্যক্তিগতভাবে সার্বক্ষণিক সরকারি গাড়ি ব্যবহারের বা বরাদ্দ পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তিনি ১৫০০ সিসির একটি সরকারি প্রাইভেটকার (ঢাকা মেট্রো গ-২৮-৮৫৬১) ব্যবহার করছেন। পাশাপাশি তার জন্য দৈনিক বরাদ্দ ১৩ লিটার অকটেন বা পেট্রোল। সঙ্গে মাসিক প্রায় ৩০ হাজার টাকা বেতনের একজন চালক। সব মিলিয়ে সহকারী এই সচিবের গাড়ির জন্য প্রতি মাসে ডিএনসিসির ব্যয় প্রায় ৭৫ হাজার টাকা।
কেবল ওয়াহিদুজ্জামানই নন; ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে প্রায় ৬০ জন কর্মকর্তা আছেন, যারা গাড়ি ব্যবহারের প্রাধিকারভুক্ত নন, কিন্তু গাড়ি বরাদ্দ পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রেষণে আসা কর্মকর্তা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কর্মকর্তারাও। অনেকে পেয়েছেন ২৫০০ সিসির বিলাসবহুল জিপও, যার দাম প্রায় এক কোটি টাকা। আবার এমনও ঘটছে, যার একটি গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, তিনি ব্যবহার করছেন একাধিক গাড়ি। একজন বিভাগীয় প্রধান অতিরিক্ত গাড়ি বরাদ্দ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার করতে দিয়েছেন।
দুই সিটি করপোরেশনই যখন আর্থিক সংকটে পর্যুদস্ত, কখনও কখনও কর্মচারীদের ভবিষ্য তহবিলের টাকা ভেঙে যখন বেতন দিতে হয়, তখন সংস্থা দুটি এসব কর্মকর্তার পেছনে বছরে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা বাহুল্য ব্যয় করছে।
বিধান অনুযায়ী, সরকারের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা সরকারি গাড়ির সুযোগ পান। এ ছাড়া প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব পদে তিন বছর কাজ করার পর কোনো কর্মকর্তা গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা সরকার থেকে বিনা সুদে ঋণ পেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে জ্বালানি ও চালক বাবদ সরকার থেকে দেওয়া হয় মাসিক ২৫ হাজার ৬০০ টাকা। যারা এই ঋণ নিয়েছেন, তাদের গাড়ি বরাদ্দ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে প্রেষণে কর্মকর্তা বেশ কয়েকজন উপসচিব রয়েছেন, যারা সরকারি বিনা সুদের ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনে সেটা পরিবারের সদস্যদের দিয়েছেন। আর সিটি করপোরেশন থেকে গাড়ি বরাদ্দ নিয়ে নিজে ব্যবহার করছেন। তাদের বরাদ্দ দেওয়া গাড়িগুলোর বেশিরভাগই মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট, যার দাম প্রায় কোটি টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, এসব কর্মকর্তা ঢাকার ভেতরের কোনো সংস্থায় প্রেষণে কর্মরত থাকলে নৈমিত্তিক বেতন-ভাতার বাইরে বাড়তি কোনো সুবিধার প্রাধিকারভুক্ত নন।
প্রতিবছর ব্যয় অন্তত ৫ কোটি টাকা :সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই সংস্থায় অন্তত ৬০টি গাড়ি প্রাধিকারবিহীন কর্মকর্তারা ব্যবহার করছেন। প্রতিটি গাড়ির জন্য দৈনিক ১৩ থেকে ১৮ লিটার পর্যন্ত জ্বালানি বরাদ্দ করা হয়। আছেন ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতনের একজন করে চালক। এর সঙ্গে আছে গাড়ির যন্ত্রপাতি-মেরামত-লুব্রিকেন্টসহ ব্যবস্থাপনার খরচ। সব মিলিয়ে গড়ে একটি গাড়ির পেছনে সংস্থার মাসিক ব্যয় ৭৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে বছরে প্রতি মাসে করপোরেশনের এ খাতে ব্যয় হচ্ছে ৪৫ লাখ টাকা। বছরে তা দাঁড়ায় পাঁচ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ ছাড়া আছে গাড়ি কেনার জন্য সংস্থার বিনিয়োগ।
দুই সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, বেশ কয়েক বছর ধরেই সংস্থা দুটি আর্থিক সংকটে আছে। উত্তরের তুলনায় দক্ষিণের সংকট আরও বেশি। করোনাকালে রাজস্ব আদায়ে ধস নামে। তখন দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে জনবলের বেতন পরিশোধ করেছে। এ জন্য কয়েক মাসে বেতনও যথাসময়ে পাননি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
চালক-স্বল্পতার মধ্যেই এমন চিত্র :দুই সিটি করপোরেশনেই রয়েছে চালকের স্বল্পতা। এসব কর্মকর্তাকে গাড়ি দেওয়ার কারণে চালক সংকট আরও প্রকট হয়েছে। ফলে সংস্থার ক্লিনার-মশককর্মী ও বহিরাগত চালকদের দিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। সম্প্রতি দুই সিটি করপোরেশনের এ রকম দু'জন চালকের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী এবং একজন সংবাদকর্মী নিহত হন। দুই সিটি করপোরেশনের অর্গানোগ্রামে গাড়িচালকের পদ আছে ৩০৬টি করে। অথচ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে গাড়ি রয়েছে ৬০৯টি। বিপরীতে চালক আছেন ৪৬৬ জন। আর উত্তর সিটি করপোরেশনে গাড়ির সংখ্যা ৪৬৩টি। বিপরীতে চালক আছেন মাত্র ২৩৭ জন।
কারা ব্যবহার করছেন গাড়ি :ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক একজন উপসচিব। তিনি ব্যবহার করছেন ২৪৭৭ সিসির পাজেরো জিপ (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-৫২৬৯)। উপসচিব পদধারী এ রকমভাবে ৩ নম্বর অঞ্চলের নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল বাকি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-১২৯৫), ৪ নম্বর অঞ্চলের সালেহা বিনতে সিরাজ (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-১২৯৮), ১ নম্বর অঞ্চলের জুলকার নায়ন (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-১২৯৭), ২ নম্বর অঞ্চলের এ এস এম সফিউল আজম (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৯৪৯১), ৫ নম্বর অঞ্চলের মাসুদ হোসেন (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৬০৩৩)।
একইভাবে গাড়ি ব্যবহার করছেন সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মামুন উল হাসান, উপপ্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মফিজুর রহমান এবং পরিবহন মহাব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান। মিজানুর রহমান সরকারি ঋণ নেওয়ার পরও করপোরেশন থেকে দুই হাজার সিসির ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-৩২৪৭ নামের একটি জিপ গাড়ি ব্যবহার করছেন। প্রতিদিন তার জ্বালানি বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৫ লিটার। এ প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান বলেন, তিনি সরকারি ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু সরকার থেকে গাড়ির জন্য যে খরচ দেওয়া হয়, সেটা তিনি করপোরেশনে প্রতি মাসেই জমা দেন। তার বেতন থেকেই ২৫ হাজার ৬০০ টাকা কেটে নেওয়া হয়।
ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলী আমিরুল ইসলাম নিজে একটি বিলাসবহুল গাড়ি প্রাধিকারভুক্ত হিসেবে ব্যবহার করেন। আরেকটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো গ-১২-০৩৯৫) তার বাসায় ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে। আর নবগঠিত ওয়ার্ডের ৯ নম্বর অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের কোনো দপ্তর না থাকলেও তাকে দেওয়া হয়েছে একটি কার (ঢাকা মেট্রো খ-১৩-২০৫৮)। এভাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে অন্তত ৩০ জন প্রাধিকারভুক্ত না হয়েও গাড়ি বরাদ্দ পেয়েছেন।
এসব প্রসঙ্গে ডিএনসিসির পরিবহন বিভাগের প্রধান মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) মিজানুর রহমান বলেন, 'এখানে পদ বিষয় নয়। বিষয়টা হলো প্রয়োজন। অফিসের প্রয়োজনে, কাজের প্রয়োজন অনুযায়ী গাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। আইন এখানে মুখ্য বিষয় নয়। এ কারণে যাদের নূ্যনতম গাড়ি পাওয়ার সুযোগ নেই, তাদেরও কয়েকজনকে গাড়ি দেওয়া হয়েছে। এখানে কেউ তার পরিবারের কাজে ব্যবহার করছে কিনা, সেটাই বিষয়।'
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রাধিকার বহির্ভূত যেসব কর্মকর্তা গাড়ি ব্যবহার করছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন ১ নম্বর অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীন, ২ নম্বর অঞ্চলের সুয়ে মেন জো, ৩ নম্বর অঞ্চলের বাবর আলী মীর, ৪ নম্বর অঞ্চলের হায়দার আলী, ৫ নম্বর অঞ্চলের সাখাওয়াত হোসেন সরকার। এ ছাড়া নতুন এলাকা নিয়ে গঠিত ১৮টি ওয়ার্ডের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের আঞ্চলিক কার্যালয় না থাকলেও তারা ব্যবহার করছেন গাড়ি। তাদের মধ্যে চারজন রয়েছেন ৭ নম্বর অঞ্চলের মাহে আলম, ৮ নম্বর অঞ্চলের শহিদুল ইসলাম, ৯ নম্বর অঞ্চলের খায়রুল হাসান ও ১০ নম্বর অঞ্চলের মামুন মিয়া।
ডিএসসিসির বিভাগীয় প্রধানদের মধ্যে রয়েছেন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন, প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা আলীমুন রাজীব, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মুনান হাওলাদার, সিস্টেম অ্যানালিস্ট আবু তৈয়ব রোকন, প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দিন, প্রধান অডিট কর্মকর্তা রিজওয়ান বিন সাঈদ ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্টাফ অফিসার আলী নূর খান গাড়ি ব্যবহার করছেন। পরিবহন শাখার মহাব্যবস্থাপক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাসও এত দিন অবৈধভাবে গাড়ি ব্যবহার করেছেন। সম্প্রতি তিনি যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে গাড়ি ব্যবহারে প্রাধিকারভুক্ত হয়েছেন।
সব মিলিয়ে ডিএসসিসিরও কমপক্ষে ৩০ কর্মকর্তা প্রাধিকারভুক্ত না হয়েও গাড়ি ব্যবহার করছেন এবং কর্তৃপক্ষ তাদের নামে গাড়ি বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে। এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) বিপুল কুমার বিশ্বাস মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহম্মেদ বলেন, 'আমাদের পরিবহন শাখায় কিছু শৃঙ্খলার ঘাটতি আছে। বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বিষয়টি তার নজরে আসে। সমস্যাগুলো সংস্থার দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত। পর্যায়ক্রমে এগুলোর সমাধান করতে হবে।'
কেবল ওয়াহিদুজ্জামানই নন; ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে প্রায় ৬০ জন কর্মকর্তা আছেন, যারা গাড়ি ব্যবহারের প্রাধিকারভুক্ত নন, কিন্তু গাড়ি বরাদ্দ পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রেষণে আসা কর্মকর্তা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কর্মকর্তারাও। অনেকে পেয়েছেন ২৫০০ সিসির বিলাসবহুল জিপও, যার দাম প্রায় এক কোটি টাকা। আবার এমনও ঘটছে, যার একটি গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, তিনি ব্যবহার করছেন একাধিক গাড়ি। একজন বিভাগীয় প্রধান অতিরিক্ত গাড়ি বরাদ্দ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার করতে দিয়েছেন।
দুই সিটি করপোরেশনই যখন আর্থিক সংকটে পর্যুদস্ত, কখনও কখনও কর্মচারীদের ভবিষ্য তহবিলের টাকা ভেঙে যখন বেতন দিতে হয়, তখন সংস্থা দুটি এসব কর্মকর্তার পেছনে বছরে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা বাহুল্য ব্যয় করছে।
বিধান অনুযায়ী, সরকারের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা সরকারি গাড়ির সুযোগ পান। এ ছাড়া প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব পদে তিন বছর কাজ করার পর কোনো কর্মকর্তা গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা সরকার থেকে বিনা সুদে ঋণ পেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে জ্বালানি ও চালক বাবদ সরকার থেকে দেওয়া হয় মাসিক ২৫ হাজার ৬০০ টাকা। যারা এই ঋণ নিয়েছেন, তাদের গাড়ি বরাদ্দ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে প্রেষণে কর্মকর্তা বেশ কয়েকজন উপসচিব রয়েছেন, যারা সরকারি বিনা সুদের ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনে সেটা পরিবারের সদস্যদের দিয়েছেন। আর সিটি করপোরেশন থেকে গাড়ি বরাদ্দ নিয়ে নিজে ব্যবহার করছেন। তাদের বরাদ্দ দেওয়া গাড়িগুলোর বেশিরভাগই মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট, যার দাম প্রায় কোটি টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, এসব কর্মকর্তা ঢাকার ভেতরের কোনো সংস্থায় প্রেষণে কর্মরত থাকলে নৈমিত্তিক বেতন-ভাতার বাইরে বাড়তি কোনো সুবিধার প্রাধিকারভুক্ত নন।
প্রতিবছর ব্যয় অন্তত ৫ কোটি টাকা :সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই সংস্থায় অন্তত ৬০টি গাড়ি প্রাধিকারবিহীন কর্মকর্তারা ব্যবহার করছেন। প্রতিটি গাড়ির জন্য দৈনিক ১৩ থেকে ১৮ লিটার পর্যন্ত জ্বালানি বরাদ্দ করা হয়। আছেন ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতনের একজন করে চালক। এর সঙ্গে আছে গাড়ির যন্ত্রপাতি-মেরামত-লুব্রিকেন্টসহ ব্যবস্থাপনার খরচ। সব মিলিয়ে গড়ে একটি গাড়ির পেছনে সংস্থার মাসিক ব্যয় ৭৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে বছরে প্রতি মাসে করপোরেশনের এ খাতে ব্যয় হচ্ছে ৪৫ লাখ টাকা। বছরে তা দাঁড়ায় পাঁচ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ ছাড়া আছে গাড়ি কেনার জন্য সংস্থার বিনিয়োগ।
দুই সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, বেশ কয়েক বছর ধরেই সংস্থা দুটি আর্থিক সংকটে আছে। উত্তরের তুলনায় দক্ষিণের সংকট আরও বেশি। করোনাকালে রাজস্ব আদায়ে ধস নামে। তখন দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে জনবলের বেতন পরিশোধ করেছে। এ জন্য কয়েক মাসে বেতনও যথাসময়ে পাননি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
চালক-স্বল্পতার মধ্যেই এমন চিত্র :দুই সিটি করপোরেশনেই রয়েছে চালকের স্বল্পতা। এসব কর্মকর্তাকে গাড়ি দেওয়ার কারণে চালক সংকট আরও প্রকট হয়েছে। ফলে সংস্থার ক্লিনার-মশককর্মী ও বহিরাগত চালকদের দিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। সম্প্রতি দুই সিটি করপোরেশনের এ রকম দু'জন চালকের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী এবং একজন সংবাদকর্মী নিহত হন। দুই সিটি করপোরেশনের অর্গানোগ্রামে গাড়িচালকের পদ আছে ৩০৬টি করে। অথচ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে গাড়ি রয়েছে ৬০৯টি। বিপরীতে চালক আছেন ৪৬৬ জন। আর উত্তর সিটি করপোরেশনে গাড়ির সংখ্যা ৪৬৩টি। বিপরীতে চালক আছেন মাত্র ২৩৭ জন।
কারা ব্যবহার করছেন গাড়ি :ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক একজন উপসচিব। তিনি ব্যবহার করছেন ২৪৭৭ সিসির পাজেরো জিপ (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-৫২৬৯)। উপসচিব পদধারী এ রকমভাবে ৩ নম্বর অঞ্চলের নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল বাকি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-১২৯৫), ৪ নম্বর অঞ্চলের সালেহা বিনতে সিরাজ (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-১২৯৮), ১ নম্বর অঞ্চলের জুলকার নায়ন (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-১২৯৭), ২ নম্বর অঞ্চলের এ এস এম সফিউল আজম (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৯৪৯১), ৫ নম্বর অঞ্চলের মাসুদ হোসেন (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৬০৩৩)।
একইভাবে গাড়ি ব্যবহার করছেন সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মামুন উল হাসান, উপপ্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মফিজুর রহমান এবং পরিবহন মহাব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান। মিজানুর রহমান সরকারি ঋণ নেওয়ার পরও করপোরেশন থেকে দুই হাজার সিসির ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-৩২৪৭ নামের একটি জিপ গাড়ি ব্যবহার করছেন। প্রতিদিন তার জ্বালানি বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৫ লিটার। এ প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান বলেন, তিনি সরকারি ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু সরকার থেকে গাড়ির জন্য যে খরচ দেওয়া হয়, সেটা তিনি করপোরেশনে প্রতি মাসেই জমা দেন। তার বেতন থেকেই ২৫ হাজার ৬০০ টাকা কেটে নেওয়া হয়।
ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলী আমিরুল ইসলাম নিজে একটি বিলাসবহুল গাড়ি প্রাধিকারভুক্ত হিসেবে ব্যবহার করেন। আরেকটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো গ-১২-০৩৯৫) তার বাসায় ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে। আর নবগঠিত ওয়ার্ডের ৯ নম্বর অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের কোনো দপ্তর না থাকলেও তাকে দেওয়া হয়েছে একটি কার (ঢাকা মেট্রো খ-১৩-২০৫৮)। এভাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে অন্তত ৩০ জন প্রাধিকারভুক্ত না হয়েও গাড়ি বরাদ্দ পেয়েছেন।
এসব প্রসঙ্গে ডিএনসিসির পরিবহন বিভাগের প্রধান মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) মিজানুর রহমান বলেন, 'এখানে পদ বিষয় নয়। বিষয়টা হলো প্রয়োজন। অফিসের প্রয়োজনে, কাজের প্রয়োজন অনুযায়ী গাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। আইন এখানে মুখ্য বিষয় নয়। এ কারণে যাদের নূ্যনতম গাড়ি পাওয়ার সুযোগ নেই, তাদেরও কয়েকজনকে গাড়ি দেওয়া হয়েছে। এখানে কেউ তার পরিবারের কাজে ব্যবহার করছে কিনা, সেটাই বিষয়।'
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রাধিকার বহির্ভূত যেসব কর্মকর্তা গাড়ি ব্যবহার করছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন ১ নম্বর অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীন, ২ নম্বর অঞ্চলের সুয়ে মেন জো, ৩ নম্বর অঞ্চলের বাবর আলী মীর, ৪ নম্বর অঞ্চলের হায়দার আলী, ৫ নম্বর অঞ্চলের সাখাওয়াত হোসেন সরকার। এ ছাড়া নতুন এলাকা নিয়ে গঠিত ১৮টি ওয়ার্ডের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের আঞ্চলিক কার্যালয় না থাকলেও তারা ব্যবহার করছেন গাড়ি। তাদের মধ্যে চারজন রয়েছেন ৭ নম্বর অঞ্চলের মাহে আলম, ৮ নম্বর অঞ্চলের শহিদুল ইসলাম, ৯ নম্বর অঞ্চলের খায়রুল হাসান ও ১০ নম্বর অঞ্চলের মামুন মিয়া।
ডিএসসিসির বিভাগীয় প্রধানদের মধ্যে রয়েছেন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন, প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা আলীমুন রাজীব, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মুনান হাওলাদার, সিস্টেম অ্যানালিস্ট আবু তৈয়ব রোকন, প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দিন, প্রধান অডিট কর্মকর্তা রিজওয়ান বিন সাঈদ ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্টাফ অফিসার আলী নূর খান গাড়ি ব্যবহার করছেন। পরিবহন শাখার মহাব্যবস্থাপক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাসও এত দিন অবৈধভাবে গাড়ি ব্যবহার করেছেন। সম্প্রতি তিনি যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে গাড়ি ব্যবহারে প্রাধিকারভুক্ত হয়েছেন।
সব মিলিয়ে ডিএসসিসিরও কমপক্ষে ৩০ কর্মকর্তা প্রাধিকারভুক্ত না হয়েও গাড়ি ব্যবহার করছেন এবং কর্তৃপক্ষ তাদের নামে গাড়ি বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে। এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) বিপুল কুমার বিশ্বাস মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহম্মেদ বলেন, 'আমাদের পরিবহন শাখায় কিছু শৃঙ্খলার ঘাটতি আছে। বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বিষয়টি তার নজরে আসে। সমস্যাগুলো সংস্থার দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত। পর্যায়ক্রমে এগুলোর সমাধান করতে হবে।'
- বিষয় :
- গাড়িবিলাস