সরকারের কম্বলে শীত যায় না গরিবের

দেলওয়ার হোসেন
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১১:৪৪
'ইউএনও স্যার খুবই পাতলা একটা কম্বল দিছে, বাবা। মায়ে বিটির শীত মরে না। একজনের গায়ে কোনো রকমে হয়'- বললেন মায়া দাস। রাজশাহীর বাঘমারা উপজেলার মহব্বতপুর গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা তিনি। সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছ থেকে কম্বলটি পেয়েছিলেন। ওই গুচ্ছগ্রামেরই আরেক বাসিন্দা রঞ্জনা বললেন একইভাবে, 'পাতলা কম্বলে শীত যায় না। এই শীতে পরিবার নিয়ে খুবই কষ্টে দিন যাচ্ছে।'
সরকারিভাবে দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা কম্বল নিয়ে অভিযোগ সারাদেশেই। কারণ, এসব কম্বলে শীত নিবারণের মূল উপাদান উলের অস্তিত্ব নেই। আগে প্রায় আড়াই কেজি ওজনের কম্বল বিতরণ হতো। এবার তা কমিয়ে দেড় কেজি নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু বিতরণ করা হয়েছে ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের কম্বল। ফলে সরকারি কম্বল পেয়েও শীত কাটছে না শীতার্তদের।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার পেগোরিয়া এলাকার নুর হোসেন বলেন, 'দুই পাটের (স্তর) হলে ভালো হতো। এ কম্বল কাজে আসছে না।' চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারী ইউনিয়নের নুরুল ইসলাম বলেন, 'বিনামূল্যে দেওয়া কম্বল খুবই পাতলা, আর সাইজেও অনেক ছোট। একজনের বেশি থাকা যায় না।' এ গ্রামেরই বাসিন্দা পত্রিকা বিক্রেতা রাজীব বলেন, কম দামি ও নিম্নমানের কম্বল দেওয়া হয়েছে।
সংশ্নিষ্টদের অভিযোগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা, সেই সঙ্গে তদারকির অভাবে কল্যাণকর উদ্যোগটি কাজে আসেনি। কম টাকায় কম্বল ক্রয়ের নামে হয়েছে অনিয়ম। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ অধিদপ্তর কম্বলের যে উপাদান তালিকা (স্পেসিফিকেশন) তৈরি করেছিল, তাও মানা হয়নি। ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিধি মানেননি সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী ও ডিসি-ইউএনরা। জেলা-উপজেলায় যেসব কম্বল ২৫০ থেকে ৪০০ টাকায় কেনা হয়েছে; বাজার যাচাই করে দেখা যায়, সে কম্বলের দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। যদিও কম্বলপ্রতি সরকারি বরাদ্দ ছিল ৭০০ টাকা।
জানা যায়, শীতার্তদের জন্য কম্বল কিনতে অর্থবছরের শুরুতে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু দরপত্র আহ্বানে দেরি করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। পরে সব দরপত্র বাতিল করে দিয়ে ৬৪ জেলার ৪৯২টি উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহীদের (সিইও) অনুকূলে সরাসরি সে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জের ইউএনওর অনুকূলে গত বছর ১৭ নভেম্বর ১২ লাখ ৮৩ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু এখনও কম্বল কেনা হয়নি। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, জামালপুরের মাদারগঞ্জসহ শতাধিক উপজেলায় কিছু কম্বল কেনা হলেও বিতরণ করা হয়নি।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কম্বল ক্রয়ের চাহিদায় দৈর্ঘ্য ছিল ৭ ফুট। সরবরাহ করা কম্বলগুলো পাওয়া গেছে ৬ ফুট। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলায় কোটেশন বিজ্ঞপ্তি দিলেও কম্বলের ওজন কত হবে, তা উল্লেখ করা হয়নি। ত্রাণের কম্বল কী দিয়ে তৈরি ও কতটুকু মোটা হবে, তা কেউ উল্লেখ করেনি। অনেক জেলা-উপজেলায় বিজ্ঞপ্তিই দেওয়া হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, ত্রাণ অধিদপ্তর কম্বলের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ওজন, পুরুত্ব, উপাদান, রংসহ ৯টি শর্ত দিয়েছিল। কম্বলের ওজন ধরা হয়েছিল ১৫০০ গ্রাম। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এর একটি শর্তও না মেনে কেনা হয়েছে সর্বনিম্নমানের কম্বল।
ছয়টি জেলার ২৫টি উপজেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ৭ উপজেলায় কম্বল বিতরণ করা হয়নি। যেসব উপজেলায় বিতরণ করা হয়েছে, তারা সঠিক পরিসংখ্যান জানাতে পারেননি।
মানা হয়নি সরকারি নীতিমালা: যেসব কর্মকর্তা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন তারা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধিমালা অনুসরণ করেননি। বিধিমালার ৭১ এর ২ ধারায় বলা হয়েছে- কোটেশন প্রচারের লক্ষ্যে ক্রয়কারীর নোটিশ বোর্ড এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু কোনো জেলা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের ওয়েবসাইটে এ বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। সুনামগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহীসহ আরও কয়েকটি জেলা-উপজেলার ডিসি-ইউএনও এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কাছে সমকালের স্থানীয় প্রতিনিধিরা কোটেশন বিজ্ঞপ্তি একাধিকবার চেয়েও পাননি।
কেরানীগঞ্জের ইউএনও মো. মেহেদী হাসান সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণভাণ্ডার থেকে কিছু কম্বল এসেছিল, সেগুলো বিতরণ করা হচ্ছে। যে অর্থ বরাদ্দ আছে সেগুলো দিয়ে আগামী সপ্তাহে ক্রয়ের কার্যক্রম শুরু হবে।
পঞ্চগড়ের ডিসি মো. জহুরুল ইসলাম দাবি করেন, শীত নিবারণের মূল উপাদান উল দেখে তারা কম্বল ক্রয় করেছেন। তবে পঞ্চগড়ের একাধিক কম্বল যাচাই করে দেখা যায়, তাতে কোনো উল নেই।
কম্বলের সরবরাহকরী পঞ্চগড়ের শারজা বস্ত্র বিতানের মালিক মো. আব্দুল্লাহ সমকালকে বলেন, 'কম্বলে গরমের কোনো উপাদান আছে কিনা, সেটা জানি না। চট্টগ্রাম থেকে কম্বল এনে দিয়েছি।'
সুনামগঞ্জের ডিসি জাহাঙ্গীর হোসেন সমকালকে বলেন, 'কম্বল ক্রয়ে শীত নিবারণের উপাদান দেখা হয়নি। কারণ, যে টাকা পেয়েছি তাতে কম্বল গরম করার উপাদান দেখে নেওয়া অসম্ভব বিষয়। আমার ধারণা, কোনো জেলায় এটি করা হয়নি।'
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলা ও চারটি পৌরসভায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৮৪ লাখ ১ হাজার ১৬১ টাকা। গড়ে প্রতিটি উপজেলা বা পৌরসভা পেয়েছে ৫ লাখ ৬০ হাজার, যা দিয়ে সরকার নির্ধারিত ৭০০ টাকা দরের ৮০০টি কম্বল কেনা সম্ভব। দেশের অন্য উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই রকম।
শীত কাটে না: একাধিক উপজেলার ইউএনও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উত্তরাঞ্চল ও হাওরাঞ্চলের শীত নিবারণে আরও ভালোমানের কম্বল প্রয়োজন।
নিম্নমানের কম্বলের বিষয়টি স্বীকার করে রাজশাহীর বাঘমারা উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রাজিব রানা বলেন, 'এ কম্বল মোটা কাপড়ের শার্টের মতো। তীব্র শীত নিবারণের জন্য এটি যথেষ্ট নয়। যদি একটু দাম বেশি দিয়ে ভালোমানের কম্বল নেওয়া যেত, তাহলে হয়তো সংখ্যাটা কমে যেত, কিন্তু মানুষের শীত নিবারণ হতো।' তবে ইউএনও ফারুক সুফিয়ান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রহিমানপুর পাইকপাড়া গ্রামের ভিক্ষুক সুফিয়া বেগম বলেন, সরকারি কম্বল গ্রামে আসে না। কম্বলের জন্য ডিসি অফিসে গেলে হয়তো পাব, কিন্তু ২০০ টাকার কম্বল নিতে ৩০০ টাকা লোকসান। সে জন্য কম্বলের পেছনে না ছুটে কষ্টে দিন পার করছি। ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুরসহ অনেক জেলার দিনমজুর, অসহায় ব্যক্তি নিম্নমানের এ কম্বল সংগ্রহ করতে যাননি।
এক ধোয়াতেই নষ্ট: সরকারের মানবিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে- দুস্থ ও অতিদরিদ্র ব্যক্তি/পরিবার যারা প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র কিনতে পারে না এবং শীতপ্রধান এলাকার শীতার্ত ব্যক্তি/পরিবার, যাদের পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র নেই তাদের এই শীতবস্ত্র দিতে হবে। তবে গত ৫ বছরে সরকার থেকে যেসব ব্যক্তি/পরিবার কম্বল/চাদর গ্রহণ করেছে, তারা অযোগ্য বিবেচিত হবে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, বিধি অনুযায়ী কেউ একবার কম্বল পেলে পরের পাঁচ বছরে তার আর পাওয়ার সুযোগ নেই। অথচ বিতরণ করা কম্বলগুলো একবার ধোয়ার পরই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে একদিকে সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার কম্বল বিতরণ করছে, অন্যদিকে দরিদ্র মানুষ শীতে কষ্টে দিন পার করছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেওয়ান মোর্শেদ আহমেদ সমকালকে বলেন, এ জন্য আগে উপাদান ঠিক করতে হবে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ না থাকলে অনেক বিষয় ধরা যাবে না। যে প্রক্রিয়ায় কম্বল কেনা হয়েছে, তাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা খুবই কঠিন। তবে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত শিথিল করাই এখানে বড় অনিয়ম। তারা কৌশলে বড় অন্যায় করেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, অদক্ষতা এবং সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে এটা হয়েছে, যা প্রত্যাশিত নয়। গরিবদের ত্রাণসামগ্রী বিতরণে যদি মানসম্পন্ন পণ্য দেওয়া না হয়, তাহলে পুরো অর্থই নষ্ট। দায়িত্বে অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে সংশ্নিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি।
সমন্বয়হীনতা: কম্বল ক্রয় করে জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শক্রমে বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। কিন্তু বেশিরভাগ ডিসি-ইউএনও এ নির্দেশনা মানেননি। ঢাকা জেলার ডিসি শীতবস্ত্র বিতরণের ছবি ফেসবুকে প্রচার করেছেন। অনুষ্ঠানে তিনি নিজেই প্রধান অতিথি ছিলেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন এডিসিরা। কোনো জনপ্রতিনিধি তাদের সঙ্গে ছিলেন না। বেশিরভাগ জেলায় এমন দৃশ্য দেখা যায়। এ জন্য একাধিক এমপি ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীর কাছে অভিযোগও করেছেন। এর পর ডিসি-ইউএনওদের তাগাদাপত্রও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি।
ঢাকা-৮ আসনের এমপি রাশেদ খান মেনন বলেন, ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে তার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেননি। এমপিদের চেয়ে এখন ডিসিরা বেশি ক্ষমতাবান। ফলে ত্রাণ বিতরণসহ প্রায় সব কাজ তারা নিজেরাই করেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান সমকালকে বলেন, কম্বলের জন্য দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেউ সরবরাহ করতে পারেনি। এর মধ্যে শীত চলে আসছে। তাই ডিসি, ইউএনও এবং সিটি করপোরেশনের সিইওদের অনুকূলে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বিতরণ করা নিম্নমানের কম্বল বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এটা একটা সংকট। অধিদপ্তরের স্পেসিফিকেশনই তাদের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ডিসিদের বক্তব্য- অধিদপ্তরে যে দামে কেনা হয়, তার চেয়ে তারা কম দামে কিনছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক বলেন, 'অধিদপ্তরের জনবল সংকটের কারণে কম্বল বিতরণের কোনো তথ্য নেওয়া হয়নি। তাই ক্রয় করেছে কিনা বা বিতরণ করেছে কিনা, তার তথ্য আমাদের কাছে নেই।'
- বিষয় :
- কম্বল
- শীত
- কম্বল বিতরণ
- পাতলা কম্বল
- শীতের প্রকোপ