জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬
হঠাৎ করেই বিপ্লবী বাজেট হয় না
সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা

সালেহউদ্দিন আহমেদ- সমকাল
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫ | ০১:০৪ | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৫ | ০৬:৫১
সীমিত সম্পদের মধ্যে এবারের বাজেট জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব। তবে কখনোই পুরোপুরি ব্যবসাবান্ধব করা সম্ভব নয়। আবার হঠাৎ করেই বিপ্লবী বাজেট করে বাস্তবায়ন করা যায় না। একদিকে কর কমাতে গেলে আরেকদিকে বাড়াতে হবে। এর পরও এবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সীমিত সম্পদে ব্যাপক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করতে হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আগামী অর্থবছরের বাজেট পেশ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলেন অর্থ উপদেষ্টার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ; বিদ্যুৎ জ্বালানি, সড়ক সেতু ও রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান; স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী; বাণিজ্য, বিমান, বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ ও এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।
অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলন ছিল সংক্ষিপ্ত। অনেকের প্রশ্ন না নিয়েই সংবাদ সম্মেলন শেষ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বাজেট পাস হওয়ার এখনও সময় আছে। মতামত দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
সবার মতামত নিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী বা সংযোজন করা যাবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এত দিন আমরা প্রবৃদ্ধি প্রবৃদ্ধি করে এসেছি। তবে এই প্রবৃদ্ধি সব পর্যায়ের মানুষের কাছে সমানভাবে পৌঁছায়নি। এবারের বাজেটে সেই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এরই মধ্যে খাদ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। সব পণ্যের দর একবারে কমবে না।
তিনি বলেন, কথার ফুলঝুরি বাদ দিয়ে বাজেট বাস্তবভিত্তিক করার চেষ্টা করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার কমানো হয়েছে। বিগত সরকার ব্যাংক, পুঁজিবাজার এবং বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে যে জঞ্জাল রেখে গেছে, তা মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশ নেই, যেখানে ব্যাংকের মালিকপক্ষ ঋণের ৭০ শতাংশের বেশি নিয়ে গেছে। এ অবস্থায় আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার শেষ করে যেতে পারবে না। পরবর্তী সরকারের জন্য একটা ‘ফুটপ্রিন্ট’ রেখে যাবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের সম্পদ সীমিত, তবে চাহিদা অনেক। এ সরকার কঠিন সময়ে দায়িত্ব নিয়েছে। অনেকে বলেন, দেশ আইসিইউতে ছিল। বিশেষ করে আর্থিক খাত একেবারে খাদের কিনারায় পৌঁছে যায়। ওই সময়ে দায়িত্ব না নিলে দেশ হয়তো আরও দুরবস্থায় পড়ত। সবার চেষ্টায় আর্থিক খাতকে একটা পর্যায়ে আনা সম্ভব হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে।
বাজেটের খারাপ দিক কী– এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘খারাপ দিক বলব না। তবে আরও ভালো হতো যদি কর ফাঁকি বন্ধ করে রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব হতো। দুর্নীতি না থাকত। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে পারলে দাতা সংস্থার কাছ থেকে ধার করার প্রয়োজন হতো না।’ তিনি বলেন, পাচারকারীরা অনেক চালাক। তারা দেশ থেকে বাইরে অর্থ নিয়েই সম্পদ কিনে ফেলে; তেমন নয়। কয়েক স্তরের লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে এক দেশ থেকে আরেক দেশে নিয়ে সম্পদ গড়ে। ফলে অর্থ ফেরত আনা সহজ নয়।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অনেকে এবারের বাজেটকে গতানুগতিক বা আগের ধারাবাহিকতা বলছেন। এই মূল্যায়ন ঠিক না। এবারের বাজেটে তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ঋণনির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এখন প্রতিটি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করছে। সরকারের কাজ নিয়ে সমালোচনা থাকবে। তবে শুধু সমালোচনা না করে ভালো দিকগুলোও তুলে ধরতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের সহযোগিতা ও সহানুভূতি দরকার।
বাজেটে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ বিষয়ে অর্থ সচিব ড. মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার জানান, সরকারি চাকরিতে শূন্য পদে নিয়োগসহ বিশেষ বিসিএসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতেও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন স্টার্টআপদের জন্য বাজেটে ১০০ কোটি টাকা, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ১২৫ কোটি টাকা এবং তরুণদের জন্য ১০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা যা বললেন
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এই সরকার নতুন করে কোনো প্রকল্প নেয়নি। আগের প্রকল্প কাটছাঁট এবং পুনর্মূল্যায়ন করে চলমান রাখা হয়েছে। জঞ্জাল পরিষ্কার করতে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। কোনো সেতু বা রাস্তার কাজ বন্ধ করা হলে অর্থনৈতিকভাবে অনেক ক্ষতি হবে। এসব কারণে খুব ভালো কোনো নতুন প্রকল্প শুরু করার সুযোগ নেই। তবে পরবর্তী সরকারের জন্য কিছু প্রকল্প নথিভুক্ত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ভঙ্গুর অর্থনীতিকে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে এবারের বাজেট বাস্তবমুখী ও মিতব্যয়ী। ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধের দুষ্টু চক্র থেকে বেরিয় আসার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এক বাজেটে হবে না, অন্তত শুরু করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাজেট একটা চলমান প্রক্রিয়া। শূন্য থেকে শুরু করা যায় না। যে কর ব্যবস্থা আছে, সেখানে অনেক অসংগতি আছে। তার পরও একটা অসংগতি কমাতে গেলে আরেকটা অসংগতি তৈরি হয়।
তিনি বলেন, এখন যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে, তার সবই আগের সরকারের নেওয়া চলমান প্রকল্প। এসবের অধিকাংশই রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া। অর্থ সংস্থান বিবেচনা না করে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ১১৩টি প্রকল্পের মধ্যে শুধু ২০ থেকে ৩০টি নতুন, যা আগের এডিপিতে সবুজ পাতায় বরাদ্দহীনভাবে নথিভুক্ত। এই সরকার কোনো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে না। এর পরও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র, চট্টগ্রামের বে-টার্মিনাল ও মোংলা সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে ঋণ চুক্তি হয়ে যাওয়ায় শেষ না করে উপায় নেই।
গভর্নরের বক্তব্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির সাড়ে ৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অত্যন্ত রক্ষণশীল। প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতি আরও কমবে। আগামী জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নামবে বলে আশা করা যায়। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ বিনিময় হার। ৭ থেকে ৮ মাস ধরে ডলারের দর ১২২ থেকে ১২৩ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে। ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার পরও দর একই আছে। এখন ডলার পেতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সব ধরনের আমদানি বাড়ছে। মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানিও বাড়তে শুরু করেছে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পর্যালোচনা হবে
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে আমরা নই। আগের বেশির ভাগ সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। তবে এখনও বাজেট চূড়ান্তভাবে পাস হয়নি। ফলে পর্যালোচনা করার সুযোগ রয়েছে।’ এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা বৈধ করার বিশেষ সুযোগ ছিল, তা গত বছর আগস্টে পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। আরও কিছু ক্ষেত্রে এ সুযোগ ৩০ জুন শেষ হয়ে যাবে। এর মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি। তিনি জানান, বিভিন্ন কারণে অনেকের অর্থ অপ্রদর্শিত থেকে যায়। তাই বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে, কেউ যদি অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে কোনো ফ্ল্যাট বা জমি কেনেন, তাহলে প্রায় পাঁচ গুণ কর দিয়ে বৈধ করতে পারবেন। একই সঙ্গে যদি কেউ নিজের নামে থাকা জমিতে অপ্রদর্শিত অর্থে বাড়ি নির্মাণ করেন, তাহলে তাকে দ্বিগুণ হারে কর দিতে হবে। তবে এভাবে অর্থ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সরকারের অন্য কোনো সংস্থা প্রশ্ন তুলতে পারবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যে করের বোঝা কমানো হয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের ওপর নতুন করে কোনো কর আরোপ করা হয়নি। এটি একটি ভুল ব্যাখ্যা বা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য।
ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্ব
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কাউকে বিশেষ সুবিধা দিতে কোনো নীতি গ্রহণ করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘এক সময় দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছিলেন, ফেব্রুয়ারি-মার্চে দেশে দুর্ভিক্ষ হবে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আমরা সিন্ডিকেট ভেঙে প্রতিযোগিতামূলক মার্কেটপ্লেস তৈরি করেছি, যা অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা ফিরিয়েছে।’
জ্বালানি উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির বলেন, জ্বালানির দাম কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে পুলিশের সহায়তা মহাসড়ক বিভাগ রাস্তার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে। শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।
কৃষকের অধিকার দেখতে হবে
স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলা হলেও কৃষকদের নিয়ে কেউ কথা বলে না। ভোক্তারা অল্প দামে আলু পেলেও কৃষকরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।
তিনি আরও বলেন, এবার প্রায় ১৫ লাখ টন বেশি বোরো উৎপাদন হবে। এ ছাড়া আদা, পেঁয়াজ, ভুট্টার উৎপাদনও বাম্পার হয়েছে। সবজি সংরক্ষণের জন্য ১০০টির মতো ছোট কোল্ডস্টোরেজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খাবার আলু এবং বীজের আলু রাখার জন্য আলাদা করে কোল্ডস্টোরেজ করা হচ্ছে। এ ছাড়া পেঁয়াজ সংরক্ষণেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
- বিষয় :
- বাজেট
- গভর্নর
- অর্থ উপদেষ্টা
- বাজেট ২০২৫-২৬