ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

'বাসায় ফিরলে চাপা কষ্টগুলো জেগে ওঠে'

'বাসায় ফিরলে চাপা কষ্টগুলো জেগে ওঠে'

আবরার আহমেদ চৌধুরী

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০১৯ | ১৪:০২ | আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৯ | ১৪:২৮

'দিনভর কাজের ব্যস্ততায় দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করি। সন্ধ্যার পর যখন বাসায় ফিরি, তখন ভেতরের চাপা কষ্টগুলো আবার জেগে ওঠে। একটা শূন্যতা ঘিরে ধরে। বাসাজুড়ে হারানোর নীরব বেদনা অনুভূত হয়।'

কেমন কাটছে দিন- এ প্রশ্নের জবাবে ভারী কণ্ঠে এভাবেই যাপিত জীবনের বর্ণনা দিলেন মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আবরার আহমেদ চৌধুরীর বাবা আরিফ আহমেদ চৌধুরী। গত ১৯ মার্চ রাজধানীর প্রগতি সরণি এলাকায় সুপ্রভাত বাসের চাপায় আবরার নিহত হন। তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আরিফ আহমেদ ছেলের স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'নিজের ছেলে বলেই বলছি এমন নয়। শিক্ষক, সহপাঠী, বন্ধু, ছোট-বড় সবার কাছে ও যে কত প্রিয় ছিল, তার মৃত্যুর আগে সেটা এত বেশি উপলব্ধি করিনি। আবরার শুধু ভালো ছাত্র ছিল তা নয়, মেধার পাশাপাশি মানবিক গুণের অধিকারী ছিল। তার বিশেষ কোনো চাহিদা ছিল না। সহজ-সরল জীবনযাপন করত। পরীক্ষায় ভালো ফল করলে ছেলেমেয়েরা নানা রকম আবদার করে। আবরারকে কিছু দিতে চাইলেও নিত না। বলত, তার প্রয়োজন নেই। এ বিষয়টা ভীষণ পীড়া দেয়।'

ছেলের মিতব্যয়িতার উদাহরণ দিতে গিয়ে আরিফ আহমেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পকেট খরচ হিসেবে প্রতিদিন তাকে ২০০ টাকা দেওয়া হতো। রাতে বাসায় ফিরে সে সারাদিনের খরচের হিসাব করে বেঁচে যাওয়া অর্থ তার মাকে ফেরত দিত। যদি বলা হতো বাবা, টাকাটা রেখে দাও তোমার কাজে লাগবে, সে রাখত না।

ছেলের গুণাবলির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, একবার তার ছোট ছেলে আবিদ আহমেদ জানায়, বড় ভাইয়া (আবরার) কবিতা লেখে, এই বলে একটা ডায়েরি এনে দেখায়। তাতে একটি কবিতা ছিল এমন- 'এক নাবিক জাহাজ ডুবে একটা বিজন দ্বীপে আটকে যায়। একদল ক্ষুধার্ত হাঙর দ্বীপের আশপাশে রয়েছে। তারা নাবিককে খেতে চায়। নাবিক বলে, যেহেতু তার উদ্ধারের আশা নেই। তাই হাঙররা তাকে খেয়ে নিজেদের জীবন বাঁচাতে পারে।' আরিফ আহমেদ বলেন, তার ছেলের এমন মানবিক বোধের পরিচয় পেয়ে সেদিন পিতা হিসেবে খুব গর্ববোধ হয়েছিল।

আবরার শুধু নিজেই ভালো ছাত্র ছিল না, তার সহপাঠীদেরও সহযোগিতা করত। এ বিষয়ে আরিফ আহমেদ বলেন, 'বাসায় ফেরার পর প্রায়ই দেখতাম মোবাইল নিয়ে বসে আছে। ভাবতাম গেমস খেলছে বা অন্য কোনো কাজে সময় ব্যয় করছে। তার মৃত্যুর পর এ ভুল ভাঙে। আবরারের সহপাঠীরা কিছু ভিডিও পাঠায় মোবাইল ফোনে। তাতে দেখি সে আন্তর্জাতিক নানা বিষয়, কূটনৈতিক সম্পর্ক, বিভিন্ন অর্থনৈতিক মতবাদ, ইতিহাসের নানা ঘটনার ওপর সহপাঠীদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করছে। আবরার লেকচার দিচ্ছে অন্যরা তা শুনছে।' তিনি বলেন, "একবার দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে আবার বের হচ্ছে, জিজ্ঞেস করলে জানায় এক বন্ধুর ছোট ভাই 'ও' লেভেল পরীক্ষা দেবে। বন্ধুর অনুরোধে তাকে গাইড করতে যাচ্ছে।"

আরিফ আহমেদ বলেন, তার ছেলেটি খুব বিনয়ী ছিল। বাসার গৃহসহকারী, গাড়ির চালক সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলত। আগেই সালাম দিত। বাসা তৈরির কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের সঙ্গে খেতে বসে যেত। এই ভালো গুণগুলো তাকে শেখাতে হয়নি। নিজে থেকেই আত্মস্থ করেছে।

তিনি বেদনাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আবরারের মৃত্যুর পর তার জুনিয়র অনেক ছেলে জানায়, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আবরার তাদের শুধু ভুল ধরিয়ে দিত না, কীভাবে যুক্তি, তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে হবে, তা শিখিয়ে দিত।

ছেলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে আরিফ আহমেদ বলেন, ওর ইচ্ছা ছিল চিকিৎসক হবে। তবে মেডিকেলে চান্স পায়নি। দুর্ঘটনার কয়েকদিন আগে সে সারপ্রাইজ দেয়। বলে, 'বাবা আমিতো সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। এখন আইএসবি পরীক্ষায় অংশ নেব।' তার কথা শুনে সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি বিমান বাহিনীর ২৩০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে সে টপ স্কোর করেছে। সেনাবাহিনীর পরীক্ষাতেও ভালো করেছে। কান্না জড়ানো কণ্ঠে আরিফ আহমেদ বলেন, তার আর আইএসএসবিতে যাওয়া হলো না। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে শতাধিকবার বনানী কবরস্থানে গিয়েছি বিভিন্ন জনকে শেষ বিদায় জানাতে। কখনও ভাবিনি নিজের সন্তানের জন্য এখানে আসতে হবে।

বড় সন্তানকে হারিয়ে পাগলপারা মা ফরিদা ফাতেমী। তার দিনও কাটছে বেদনার ঘেরাটোপে। আরিফ আহমেদ জানান, আবরার ও তার ছোট ভাই আবিদ এক সঙ্গেই ঘুমাত। তারা এক সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। ভাইকে হারিয়ে আবিদ অনেকটা ভেঙে পড়েছে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শে তারা তিনজন (বাবা মা ছেলে) এক সঙ্গে ঘুমাতে যান।

আরিফ আহমেদ বলেন, প্রিয়জন হারিয়ে ফেলার এ কষ্ট আসলে ভোলা যায় না। তবু জীবন থেমে থাকে না। দম আটকানো সময় টেনে নিয়ে যেতে হয়।

আরও পড়ুন

×