লাবণ্য এই ঘরেই আছে...

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লাবণ্যর ছবি হাতে মা ফারজানা হক ও বাবা এমদাদুল হক- প্রতিবেদক
সাজিদা ইসলাম পারুল
প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০১৯ | ১৪:০৬ | আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৯ | ১৪:২৬
'যেখানে যা ছিল, সব ঠিকই আছে। প্রতিদিনকার মতো টেবিল, কাপড়-চোপড়সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখি। এক ইঞ্চিও সরাইনি। আমার মিষ্টি মেয়ের জিনিসপত্রগুলো সবাই সরিয়ে ফেলতে চায়। কিন্তু আমি তো জানি, আমার লাবণ্য এখনও এই ঘরেই আছে। সে সব দেখে ...!' কথাগুলো বললেন ফারজানা হক। তারপর একটু থামলেন গত ২৫ এপ্রিল অ্যাপসভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা প্রতিষ্ঠান উবার দুর্ঘটনায় নিহত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাহমিদা হক লাবণ্যর মা। মেয়ে নেই, ১৮০তম দিন পার হয়েছে গতকাল সোমবার। তার ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকেন তিনি তবুও।
রোববার পড়ন্ত বিকেলটা একটু ঘোলাটে। শ্যামলীর ৩নং রোডের ৩৩ নম্বর ভবনে লাবণ্যদের ফ্ল্যাট। ঢুকতেই দেখা যায়, অচেনা আগন্তুকের দিকে চেয়ে আছেন মা, নীরব দৃষ্টি, স্থির চোখ। শব্দ নেই মুখে। পরিবেশ শান্ত। একটু পর মেয়ের সফলতার গল্প বলা শুরু করলেন লাবণ্যর বাবা এমদাদুল হক। তখনই নীরবতা ভাঙলেন ফারজানা হক। শুরু করলেন একের পর এক গল্প। এ গল্প যেন অনন্তকালের। কখনও কখনও মেয়ের দুরন্তপনার। নিজের অজান্তেই মৃদু হাসছিলেন তিনি তখন। একটু পরেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন। তখন পাশে বসা আরেক সন্তান মৃদুল জড়িয়ে ধরেন মাকে।
লাবণ্যর মা বলেন, 'এই দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেলেও বিচার হয় না। বিচার হলে আজ আমার সন্তানকে হারাতে হতো না! সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিচার ব্যবস্থাকে কঠোর করতে হতে হবে সরকারকে। আর কোনো মায়ের কোল খালি হবে না তখন।'
গান গাইতে পছন্দ করতেন লাবণ্য। বসার ঘরের ডান পাশেই তার রেখে যাওয়া হারমোনিয়াম আর তবলা। সাজিয়ে রেখেছেন মা। পাশেই আলমারিতে সাজানো অসংখ্য পুরস্কার ও ক্রেস্ট। দেয়ালে টানানো গত বছরের ৯ মে, জন্মদিনে পাওয়া বন্ধুদের উপহার- ছবির ফ্রেম। যেখানে শুধু তার হাসিমাখা আর চঞ্চলা সব স্মৃতিবিজড়িত ছবি। ফারজানা হক মেয়ের এসব স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন। নিভৃতে কাঁদেন। আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেন- এই বুঝি ফিরে এলো মেয়েটি!
বাইশ বছর আগে একই ধরনের দুর্ঘটনায় ফারজানা হক তার একমাত্র ভাই মো. আল মামুনকেও হারিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। একমাত্র মেয়েটাকেও হারালেন এই সড়ক দুর্ঘটনায়। লাবণ্যর মা কেঁদে বলেন, 'মৃত্যুর আগেও আমার মেয়ে বলেছে, সে বিদেশে চলে যেতে চায়। যে দেশে রাস্তায় হাঁটতে গেলে ছেলেসহ মধ্যবয়সী পুরুষ পর্যন্ত গায়ে ধাক্কা দেয়, বাসে চড়তে গেলে ইচ্ছে করে গায়ের ওপর পড়ে, সে দেশে থাকতে চায়নি আমার মেয়ে। লাবণ্য প্রায়ই বলত, মা, এ দেশের মানুষ ভালো নয়। এ দেশে থাকব না আমি। এ দেশেরই মানুষ আমার নিরপরাধ মেয়েকে পিষে মেরেছে। তাকে এ দেশ কেন, এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। এমন দেশে চলে গেল আমার মেয়ে, যেখানে আর কখনও দেখতে পাব না!'
দুই সন্তানের মধ্যে লাবণ্য ছিলেন বড়। বাবাকে যেমন শাসন করতেন, তার চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। বাবার কাছেই ছিল তার সব আবদার। মৃত্যুর আগে সেই আবদারেই মেয়েকে ৭৫ হাজার টাকা দিয়ে স্কুটি কিনে দিয়েছিলেন এমদাদুল হক। হেলমেটটি রাখা হয়েছে বসার ঘরেই। ওটা দেখিয়ে বাবা বলেন, 'রাজধানীতে মেয়েরা নিরাপদে চলতে পারে না। তাই আমার মেয়ে স্কুটি চালানো শিখেছিল। বায়না ধরে স্কুটি কিনেছেও; কিন্তু চালাতে পারেনি। নতুন স্কুটিটা এখন পড়ে আছে।'
টিফিনের টাকা জমিয়ে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছিল লাবণ্য নিজেই। সেই টাকার পরিমাণ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। মৃত্যুর পর মেয়ের পড়ার টেবিলে পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। মেয়েটা সবসময় টাকা জমাত। ব্যাংকে নমিনি হিসেবে দিয়েছিল বাবার নাম। এমদাদুল হক বলেন, 'বাবা হিসেবে মেয়ের জমানো টাকাগুলো উঠিয়েছি। সে টাকা দিয়েই ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার হরিপুর গ্রামে অনাথ শিশুদের দেখভালের জন্য 'ফাহমিদা হক লাবণ্য এতিমখানা' প্রতিষ্ঠা করা হবে। দ্রুতই শুরু হবে এ এতিমখানার কাজ।'
ফারহানুল হক মৃদুল লাবণ্যর ছোট ভাই। এ বোন তার আদর্শ। ভীষণ ভালোবাসতেন তিনি তাকে। মত্যুর আগেও লাবণ্য মৃদুলকে বলেছিলেন, 'এসএসসিতে পড়াতে পারিনি তোমাকে। কিন্তু এইচএসসির সব পড়া পড়াব আমি।'
ভাইয়ের জন্য সব নোট, বই ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমিয়ে রেখেছিলেন লাবণ্য। মৃদুল এখন ঢাকা কমার্স কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। বোন নেই, কিন্তু বোনের রেখে যাওয়া নোটগুলো প্রতি রাতে হাতড়ে বেড়ায় সে। পাঁচ বছরের ছোট হলেও দুই ভাইবোনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো।
লাবণ্য খুব চঞ্চল ছিল, পুরো বাসা মাতিয়ে রাখত। আর মুদ্রার ওপিঠ ছেলে মৃদুল। খুব শান্ত। পড়ালেখা ছাড়া তার অন্য কিছুতে তেমন আগ্রহ নেই। অথচ মৃদুল এখন বোনের মতোই কলেজের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। মৃদুল বলে, 'এ শহরের রাস্তাঘাটে, সর্বত্র ময়লা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। আমার বোন এসব পছন্দ করত না। নিজের ব্যবহারের ময়লাগুলো, যেমন কোথাও গিয়ে চিপস খেলে বা বিস্কুট কিংবা পানি খেলে ওই প্যাকেট, বোতল আপু তার ব্যাগেই রেখে দিত। দু-তিন দিন পরেও তার ব্যাগ থেকে এসব ময়লা বের করতে দেখেছি। সে কখনও বাইরে ময়লা ফেলত না। এমন বোনটা চলে গেছে!'
ছয় বন্ধুর মধ্যে লাবণ্য ছিলেন সবার মধ্যমণি। সবাই 'লেবু' বলে ডাকতেন তাকে। প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে সবাই ভারাক্রান্ত। মাঝে মাঝেই বাড়িতে ছুটে আসেন তারা। তাকিয়ে থাকেন দেয়ালে টানানো তার ছবির দিকে। নীরবে চোখ মোছেন হাতের চেটোতে।
শ্যামলীর বাসা থেকে উবারে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাচ্ছিলেন লাবণ্য। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল চালক। হৃদরোগ ইনস্টিটউটের সামনে এলে দ্রুতগতিতে আসা ইনফোর্ট (রেকর্ডস অ্যান্ড ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সলিউশন প্রোভাইডার) প্রতিষ্ঠানের একটি কাভার্ডভ্যান পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। লাবণ্য পড়ে যান সড়কে। ভ্যানটি তাকে চাপা দিয়ে আরও দ্রুতগতিতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পেছন দিয়ে বাণিজ্য মেলামুখী বিকল্প সড়ক হয়ে তেজগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠানটির আঞ্চলিক কার্যালয়ে চলে যায়। ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ দেখে পরে কাভার্ডভ্যানটির গায়ে লেখা প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হয় চালক আনিসুর রহমানকে। সেই হত্যাকারী চালক এখন জামিনে মুক্ত। লাবণ্যর বাবা এমদাদুল হক বলেন, 'বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই এ দেশে অন্যায়কারীরা পার পেয়ে যায় এবং অন্যরাও অন্যায় করতে ভয় পায় না। পেশিশক্তি আর টাকার জোরে মুক্ত হয়ে যায় তারা।'
- বিষয় :
- সড়ক দুর্ঘটনা
- লাবণ্য
- রাজধানী