ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

আইনের বাস্তবায়ন ও অভিভাবকের সচেতনতা শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে পারে

আইনের বাস্তবায়ন ও অভিভাবকের সচেতনতা শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে পারে

গুলশানের একটি হোটেলে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় - সমকাল

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৪:০০ | আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৪:১৬

‘আমার বয়স যখন ১২, তখন বাবা মারা যান। আমি স্কুলে পড়তাম। হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে এসে শুনি, মা আমাকে বিয়ে দিবেন। পড়াশোনা করার ইচ্ছেটা মাকে জানাই। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছিল না। পরে ‘গার্ল শাইন’ কর্মসূচিতে মাকে নিয়ে যাাই। আমি নিজেও ১৬টা সেশন করি। তখন মা বুঝতে পারেন ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।’ কথাগুলো বলছিলেন কক্সবাজারের রামু থেকে আসা কিশোরী শাওরিন সুলতানা টুম্পা। সে আরও বলে, ‘কম বয়সে বিয়ে দিলে মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক নানা ক্ষতির সম্মুখীন হয়।’ 

সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল রেস্কিউ কমিটি (আইআরসি) বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকায় শিশু অধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে গবেষণা প্রতিবেদন উন্মোচন অনুষ্ঠানে টুম্পা এসব কথা বলে। 

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এই প্রতিবেদন উন্মোচন করেন মহিলা ও শিশু সুরক্ষাবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি এমপি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক পরিবার মনে করে শিশুদের লেখাপড়ার প্রয়োজনই নেই। বিশেষত মেয়ে শিশুদের। বিশেষ করে দারিদ্র্যের কারণে ১৮ বছরের অনেক আগেই শিশুদের কাজে নামতে হয়। এদিকে মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বাবা মাকে শাস্তির আওতায় আনা কোনও সমাধান নয়, বরং তাদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে বুঝাতে হবে শিশুদের লেখাপড়া এবং সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তা কতখানি। এর জন্য সরকার এবং মানবাধিকার উন্নয়নসংস্থাগুলোর একত্রে কাজ করতে হবে।’

শিশু অধিকারবিষয়ক এই জরিপে উঠে এসেছে, দুই থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও প্রতিবেলা ঠিকমতো খাবার না পাওয়া, পুষ্টিকর খাবার না পাওয়াসহ কম বয়সে মাদক সেবন এবং মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত হওয়ার প্রবণতাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, যা উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। বৃহত্তর কক্সবাজারের কিছু অঞ্চল দূর্গম হওয়ায় সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা।

সাইক্লোন, বন্যা, অতিবৃষ্টি, পাহাড় ধ্বসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কক্সবাজার অঞ্চলে নিয়মিত হওয়ায় দুর্যোগের সময় এখানকার শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়ে থাকে। জরিপে ৬৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ শিশু জানিয়েছে, তারা তাদের জীবনে কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে। এদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানসিক চাপ, শিক্ষা উপকরণ হারিয়ে ফেলা, ক্ষুধার্ত থাকা, শারীরিক আঘাত, যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথাও বলেছেন শিশুরা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেশি হওয়ার কারণে শিশুদের পড়াশুনার খরচ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যায় অনেক পরিবারের জন্য। এছাড়া অনেক সময়ই দেখা যাচ্ছে, শিশুশ্রমে নিয়োজিত হচ্ছে অনেক শিশু। ফলে ৪৩ দশমিক ২৬ শতাংশ শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিশুরা কাজ করতে গিয়ে চাকরিদাতার নিকট নানা ধরণের নিপীড়নের তথ্যও পাওয়া গেছে এই প্রতিবেদনে।

এমন অবস্থায় জরিপের উপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটিতে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- শিশু অধিকার এবং সুরক্ষা সম্পর্কিত আইন সংস্কারের মাধ্যমে অন্যান্য প্রচলিত আইনের সাথে সামঞ্জস্য এনে আইনগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা; শিশুর অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও যথাযথ বাস্তবায়নের পাশাপাশি দক্ষ জনবল (সমাজকর্মী) নিশ্চিত করা; কমিউনিটি বেইজড শিশু সুরক্ষা মেকানিজম শক্তিশালী করা, যেন শিশুরা তাদের মতামত প্রকাশ করার মাধ্যমে তাদের অধিকারগুলো ভোগ করতে পারে এবং ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে সরকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে শিশু সুরক্ষা আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি-না, তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা।

অনুষ্ঠানে শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান আইআরসির কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিনা রহমান। এছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চাইল্ড রাইটস কমিটির প্রধান রবিউল ইসলাম, সমাজসেবা অধিদপ্তরের জয়েন্ট সেক্রেটারি লাভলুর রহমান, ইউএসএইড ব্যুরো ফর হিউমানিটারিয়ান এসিস্টেন্স এর প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কোঅর্ডিনেটর ফারাহ নাজ প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আইআরসির হেড অফ এডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন সাবিরা সুলতানা নুপুর।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তায় ২৭টি ক্যাম্পে কাজ করছে ইন্টারন্যাশনাল রেস্কিউ কমিটি (আইআরসি)। শরণার্থী সহায়তার পাশাপাশি কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের জন্যও রিপ্রোডাক্টিভ হেলথকেয়ার, মাতৃস্বাস্থ্য, শিশু সুরক্ষা, শিশু শিক্ষা, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে আইআরসি।

আরও পড়ুন

×