ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

মশক নিধন কার্যক্রম শিকেয়

মশক নিধন কার্যক্রম শিকেয়

প্রতীকী ছবি

 অমিতোষ পাল

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:৩৬

রাজধানীসহ সারাদেশে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। মৃত্যুর সংখ্যাও ঊর্ধ্বমুখী। অথচ ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নিধনে নেই কোনো কার্যক্রম। তিন মাস ধরে কার্যত বন্ধ রয়েছে মশক নিধন। কাগজ-কলমে কিছু ‘রুটিনওয়ার্ক’ চললেও মাঠ পর্যায়ে ছিটেফোঁটা নেই। 

মশক নিধন কার্যক্রম তদারকি করার কথা পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের। কিন্তু গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কাউন্সিলরদের বরখাস্ত করেছে সরকার। এ অবস্থায় মাঠ পর্যায়ে মশক কর্মীদের কাজ তদারকির কেউ নেই। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার ‘হটস্পট’ সম্পর্কেও তথ্য আসছে না মন্ত্রণালয়ে। 
ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা কাগজ-কলমে থাকলেও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী হওয়ায় তারা অনেকে রয়েছেন আত্মগোপনে। ফলে রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ভেঙে পড়েছে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম। 
গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত চলতি বছর সারাদেশে ৬৭ হাজার ১৩৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, আর মারা গেছেন ৩২৬ জন। 
মশক বিশেষজ্ঞ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘এবার একটা অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, যে কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কম। সবকিছুই তো ঢিলেঢালা চলছে। তবে এটা স্পষ্ট যে, নভেম্বর-ডিসেম্বরে দেশে ডেঙ্গু বাড়বে।’ 

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি হচ্ছে। এতে ডেঙ্গু পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে গত বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গু ভয়ংকর হতে পারে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দেশে যে ধরনের কার্যক্রম প্রয়োজন ছিল, তা দেখা যায়নি উল্লেখ করে ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘মাঝেমধ্যে হয়তো কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু এবার তাও নেই। এবার দেরিতে বৃষ্টি হচ্ছে। সব মিলিয়ে ডেঙ্গুর অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে। তবে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এর প্রকোপ কমতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কাজ হলে হয়তো মশা নিয়ন্ত্রণ করা যেত। মার্চ-এপ্রিলে ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে শুধু এডিস নিধন করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, ভাইরাসটিও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’ 
নেই মশক নিধন কার্যক্রম

অতীতে ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর আগে সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম দেখা যায়। লিফলেট বিতরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, মসজিদে সচেতনতামূলক বয়ান, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কমিটি করে মশক নিধন, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে ও গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়। গত ৫ আগস্টের পর এসব দেখা যায়নি। গত দুই মাসে স্থানীয় সরকার বিভাগে ডেঙ্গু নিয়ে দুটি সভা হয়েছে। বৈঠক শেষে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ সাংবাদিকদের জানান, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঢাকার শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা গৌতম বসু বলেন, ‘আগে মাঝেমধ্যে সন্ধ্যার দিকে সিটি করপোরেশন কর্মীদের ধোঁয়া ছিটাতে দেখা যেত। এখন সেটা দেখা যাচ্ছে না।’ মশার উপদ্রপ অনেক বেড়ে গেছে বলে জানান তিনি।

সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন নেই
ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে ২০২১ সালের আগস্টে স্থানীয় সরকার বিভাগ একটি জাতীয় নির্দেশিকা প্রণয়ন করে, যেখানে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দিকনির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও বিভাগীয় পর্যায় থেকে প্রতি মাসে এডিস মশার ঘনত্ব ও ঝুঁকির তথ্য এবং চাহিদাপত্র স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে। এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালনের কথা জনপ্রতিনিধিদের। কিন্তু তিন মাসে কোনো তথ্যই মন্ত্রণালয়ে আসেনি। জনপ্রতিনিধি না থাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঝুঁকিতে রাজধানী
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, রাজধানীতে প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। রাজধানীর বাইরেও ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ভেঙে পড়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। কাউন্সিলররা আগে মশার ওষুধের চাহিদা দিতেন। কাউন্সিলর অফিসে সেই ওষুধ থাকত। সেখান থেকে মশককর্মীরা প্রতিদিন ওষুধ নিয়ে সকালে লার্ভিসাইডিং ও সন্ধ্যায় এডাল্টিসাইডিং করতেন। কাউন্সিলর কার্যালয় নিষ্ক্রিয় থাকায় ওষুধ নিতে হচ্ছে সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে। কিন্তু কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা এ দিকে যথেষ্ট নজর দিতে পারছেন না। ফলে সারাদেশে মশক নিধন কার্যক্রমে চলছে হযবরল অবস্থা। গুলশান-১-এর ১৩ নম্বর রোডের বাসিন্দা আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘গত এক মাসে আমাদের এলাকায় দুই দিনও মশার ওষুধ ছিটানো হয়নি। সকালে কিংবা বিকেলে কোনো সময়ই কেউ আসেনি মশার ওষুধ দিতে।’ 
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খাইরুল আলম বলেন, ‘পাড়া-মহল্লা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দিরে কোথাও তিন দিনের বেশি যেন পানি জমে না থাকে, সে বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে। এসব তদারকি ও অভিযানের জন্য প্রত্যেক অঞ্চলে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘মশা নিধনে বর্ষা মৌসুমের জন্য অপেক্ষা না করে বছরের শুরু থেকে পাড়া-মহল্লায় সচেতনতা তৈরির কাজ চলছে। সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। কোথাও পানি জমে থাকলে তা সেটি করপোরেশনকে জানাতে বলা হয়েছে।’ কীটনাশক, যন্ত্রপাতি ও জনবলের কোনো সংকট নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।

আরও পড়ুন

×