ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

‘ভালো খাওন’ চাইতেই পৌঁছে গেল ইয়াবা

‘ভালো খাওন’ চাইতেই পৌঁছে গেল ইয়াবা

.

 বকুল আহমেদ

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৫ | ০১:০৬ | আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৫ | ০৮:৫২

রাজধানীর অন্যতম প্রবেশদ্বার ডেমরা। ঘনবসতির এলাকাটি দিনরাতই থাকে কোলাহলপূর্ণ। তার মাঝেই একাধিক স্থানে বসে মাদকের ‘বাজার’। এলাকায় অন্তত পাইকারি ২৫ মাদক বিক্রেতা রয়েছে। তারা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা ও ফেনসিডিল বিক্রি করে। পাইকারি কিংবা খুচরা বিক্রেতারা কীভাবে ইয়াবা কেনাবেচা করে, তা জানতে সরেজমিন অনুসন্ধান চালায় সমকাল। দেখা যায়, দিনদুপুরেই বিক্রেতারা ক্রেতার কাছে মাদক পৌঁছে দিচ্ছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চলছে লেনদেন। এ কাজে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে মোবাইল ফোন। কথোপকথনে সরাসরি মাদকদ্রব্যের নাম উল্লেখ করে না তারা। একেক মাদকের জন্য রয়েছে একেক সাংকেতিক নাম। অনলাইন কিংবা মোবাইল ফোনে অর্ডার পাওয়ার পর নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয় নেশাদ্রব্য। 

এলাকা ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলছেন, রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যেই মাদক সেবন করতে দেখা যায়। বছরের পর বছর এমন চলছে। মাদক-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। গত বছরের ২৭ মে মাদকাসক্ত ছেলের হাতে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারে উন্মেষ সরকার নামে এক বৃদ্ধ খুন হন। 

ডেমরা এলাকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কার্যালয়ের আওতাধীন। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণ কার্যালয়ের এই এলাকায় মাদকবিরোধী বড় ধরনের অভিযান ছিল না। তারা ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র চারটি অভিযান চালিয়েছে এবং এ-সংক্রান্ত চারটি মামলা হয়েছে ডেমরা থানায়। 

থানা সূত্র জানায়, জানুয়ারি মাসে পৃথক তিনটি অভিযানে তিনজন গ্রেপ্তার ও ৩ হাজার ৭৭৫ পিস ইয়াবা উদ্ধার এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ৬০০ পিস ইয়াবাসহ একজনকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। 

ডেমরা থানা পুলিশ জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে মাদক-সংক্রান্ত ২৬টি মামলা করেছে। আসামি গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৩০। তাদের কাছ থেকে ৪৬০ পিস ইয়াবা, ৫ কেজি ৬৫০ গ্রাম গাঁজা, চার গ্রাম হেরোইন ও ১৪ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়। 

সরেজমিন যা পাওয়া গেল

২১ ফেব্রুয়ারি, বিকেল সাড়ে ৪টা। ডেমরার হাজী মোয়াজ্জেম আলী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের গলিতে এক যুবক মাদক কারবারি সোহেল ওরফে পেটুকে ফোন করে। সে সোহেলের কাছে জানতে চাইল, ‌‘ভালো খাওন আছে?, খাওন ভালো হবে?’ অপর প্রান্ত থেকে আছে জবাব পেয়ে সে বলল, পাঁচটা লাগবে। 

মিনিট দেড়েকের কথোপকথনে যুবক একবারের জন্যও ‘ইয়াবা’ শব্দটি উচ্চারণ করেনি। অথচ ঠিকই বিক্রেতা বুঝে নিল, যুবক ইয়াবা নিতে চাইছে। ইয়াবা ক্রেতা-বিক্রেতাদের কাছে ‘ভালো খাওন আছে’ কথার অর্থ ইয়াবা। 

যুবককে রসুলনগর ব্যাংক কলোনি এলাকায় যেতে বলে সোহেল। বামৈল পূর্বপাড়া ও ব্যাংক কলোনির সীমানায় তিন রাস্তা মোড়ে মাইন উদ্দিন স্টোর নামের মুদি দোকানের পাশে সোহেলের জন্য অপেক্ষা করে সে। ১০-১২ মিনিট পার হলেও সোহেল ইয়াবা নিয়ে না আসায় যুবক ফের ফোন করে। যুবককে জানাল, সে সারুলিয়া এলাকায় চলে গেছে। মুদি দোকান থেকে দক্ষিণ দিকের রাস্তায় যেতে বলা হয় যুবককে। যথারীতি প্রায় ২০০ গজ দক্ষিণে গিয়ে দাঁড়াল সে। প্রায় ১৫ মিনিট অপেক্ষা, এবারও এলো না সোহেল। আবারও ফোন করে সে। এবার তাকে বামৈল ফ্যান ফ্যাক্টরির গলিতে অপেক্ষা করতে বলে জানানো হয়, সে (সোহেল) আসবে না। তার এক সহযোগী ভালো খাওন পৌঁছে দেবে। 

ফ্যান ফ্যাক্টরির গলির ৩/৪ নম্বর বাড়ির পাশে ফাঁকা স্থানে দাঁড়ানোর তিন মিনিট পরই যুবকের ফোনে অচেনা নম্বর থেকে কল আসে। রিসিভ করা মাত্র যুবকের নাম জানতে চায় অচেনা ব্যক্তি। নিশ্চিত হওয়ার পর রাস্তার পূর্বদিকে তাকাতে বলে। এর পরই  ২০-২২ বছরের এক সুদর্শন তরুণ দ্রুত এসে যুবকের হাতে পাঁচ পিস ইয়াবা দিয়ে টাকা নিয়ে সটকে পড়ে। 

জানা গেল, এলাকার অলিগলিতে নতুন কোনো মানুষ ঢুকলে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে তথ্য পৌঁছে যায় এবং মাদক বেচাকেনায় সতর্ক হয় তারা। যে কারণে ওই যুবকের হাতে ইয়াবা পৌঁছাতে আধা ঘণ্টার বেশি সময়ক্ষেপণ এবং একাধিকবার স্থান পরিবর্তন করানো হয়। 

সোহেল স্থানীয় মাদক ক্রেতাদের কাছে পেটু নামে পরিচিত। সোহেল ওরফে পেটু বামৈল ও রসুলনগর এলাকার খুচরা বিক্রেতা। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০ পিস ইয়াবা বিক্রি করে। ফোনে অর্ডার নেওয়ার পর সোহেল নিজে কিংবা সহযোগীদের মাধ্যমে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেয়। ডেমরায় ৭০ জনেরও বেশি খুচরা বিক্রেতা আছে বলে জানিয়েছে মাদক-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। আলামিন রোড ও ডগাইর বাজার এলাকায় কয়েকজন বিক্রেতা ঘুরে ঘুরে ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রি করে। ডগাইর বাজার এলাকায় ফেনসিডিল বিক্রি করে আমির হোসেন, সারুলিয়ায় গাঁজা বিক্রি করে জিন্নাহ, বামৈল বাজার এলাকায় সাইফুল, লিটন, নুরু ও মকবুল গাঁজা এবং ইয়াবা বিক্রি করে। ছোট পাইটি এলাকায় মিছির আলী, আব্দুল লতিফ ও নুর বানু অন্যতম ইয়াবা বিক্রেতা।

সফুর উদ্দিন মার্কেট এলাকায় পাইকারি বিক্রেতা হিসেবে চিহ্নিত দুই সহোদর জুনু ও সোহেল। বছরখানেক আগে তারা অটোরিকশা তৈরির গ্যারেজ দিয়েছে। এর আড়ালে ইয়াবা কারবার করছে। একাধিক মাদক মামলার আসামি তারা। পাইকারি বিক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম বক্সনগরের তালেব আলী, মিরাজ মোল্লা, ইকবাল, দোলন ও কাকা ফয়সাল, ক্যানালপাড়ের জাহাঙ্গীর ওরফে ডিজুস জাহাঙ্গীর, বামৈল এলাকায় কামাল, নুরু ও রবিন, সারুলিয়ার মো. পোকারামা এবং পেন্দা জাকির। এ ছাড়া মীরপাড়ার মিঠু ও মেন্দিপুরে পারভেজ বড় ডিলার।  

জানতে চাইলে ডিএনসির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের উপপরিচালক মানজুরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ডেমরায় মাদকের নির্দিষ্ট স্পট নেই। কিছু মাদক কারবারি ভ্রাম্যমাণভাবে বিভিন্ন জায়গায় মাদক সরবরাহ করছে। এ বিষয়ে তালিকা তৈরি করে অভিযান অব্যাহত আছে। 

ডেমরা থানার ওসি মাহমুদুর রহমান বলেন, পুলিশ নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। গত সোমবারও সারুলিয়া থেকে ৩৫ পিস ইয়াবাসহ একজন পেশাদার মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 


 

আরও পড়ুন

×