ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলা

খুনের বিশদ বর্ণনা ডা. হাসান ও তাঁর স্ত্রীর জবানবন্দিতে

খুনের বিশদ বর্ণনা ডা. হাসান ও তাঁর স্ত্রীর জবানবন্দিতে

গৃহবধূ সগিরা মোর্শেদ- ফাইল ছবি

ইন্দ্রজিৎ সরকার

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৪ | ১৬:৫২

রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে গৃহবধূ সগিরা মোর্শেদকে গুলি করে হত্যার মামলায় অভিযুক্ত দুই পরিকল্পনাকারীর জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর ঘটনাটির বিশদ বর্ণনা উঠে আসে। তারা হলেন সগিরা মোর্শেদের ভাশুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিন। জবানবন্দিতে তারা দাবি করেন, সগিরা অপমানজনক কথা বলতেন। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে প্রায়ই তাদের কলহ হতো। একপর্যায়ে তাঁকে ‘শায়েস্তা’ করার পরিকল্পনা করা হয়। জবানবন্দিতে তারা নিজেদের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট করেছেন। তবে রায়ে তারা খালাস পান।

১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই সগিরা মোর্শেদ খুন হন। ওই মামলায় গত বুধবার ঢাকার তৃতীয় বিশেষ দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আলী হোসাইন দু’জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। তারা হলেন ভাড়াটে খুনি মারুফ রেজা ও আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান। অপরাধে সম্পৃক্ততা প্রমাণ না হওয়ায় ডা. হাসান, তাঁর স্ত্রীসহ তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়। অপরজন হলেন মন্টু মণ্ডল।

সর্বশেষ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এ মামলার তদন্ত করে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এর আগে ২০১৯ সালের নভেম্বরে সংস্থাটি ডা. হাসান ও তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তারের পর তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তদন্তে পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত ডা. হাসান জবানবন্দিতে বলেন, ‘রাজধানীর রাজারবাগে একই বাসার তৃতীয় তলায় আমার পরিবার এবং দোতলায় ছোট ভাইয়ের পরিবার থাকত। ওপর থেকে ময়লা ফেলা, সিঁড়িতে থুতু ফেলা, ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে প্রথমে গৃহকর্মীর মধ্যে এবং পরে আমার স্ত্রী শাহিনের সঙ্গে আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী সগিরা মোর্শেদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সগিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পাস করেন। আমার স্ত্রী সাধারণ বিএ পাস ছিলেন। সম্পর্কে আমার স্ত্রী তাঁর বড় জা হওয়ার পরও তাঁকে অসম্মান ও অবজ্ঞা করতেন সগিরা। তিনি আমাকেও প্রচ্ছন্নভাবে অসম্মান করতেন। তিনি ইগো সমস্যায় ভুগতেন। তাঁর আচরণ আমার স্ত্রীর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে তিনি আমার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেন। আমরা তাঁকে শায়েস্তা করার বিষয়ে মনস্থির করি। এ নিয়ে ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আমার শ্যালক আনাস মাহমুদ রেজওয়ানের সঙ্গে কথা বলি। এর আগে তাঁর সঙ্গেও অসম্মানজনক আচরণ করেছিলেন সগিরা। তিনিও আমাদের সঙ্গে একমত হন।’

ডা. হাসান বলেন, ‘লিবিয়া থেকে ফিরে ১৯৮৬ সালে বারডেম হাসপাতালে যোগ দিই। আর ইস্কাটনে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতাম। তখন মারুফ রেজা (২০) নামের একজন আমার রোগী ছিলেন। তিনি শহরে মাস্তানি করতেন। সগিরাকে শায়েস্তা করার জন্য তাঁর সঙ্গে ২৫ হাজার টাকার চুক্তি করি। তিনি টার্গেট নারীকে চিনতেন না বলে আমার শ্যালককে চিনিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঘটনার দিন বিকেলে সগিরা বড় মেয়ে সারাহাতকে স্কুল থেকে আনার জন্য রিকশায় সিদ্ধেশ্বরীতে পৌঁছান। তখন মারুফ রেজার মোটরসাইকেলে বসে থাকা আমার শ্যালক তাঁকে চিনিয়ে দেন। মারুফ রিকশা থামিয়ে সগিরার হাতের বালা ও ব্যাগ ধরে টানাটানি শুরু করেন। ওই সময় আমার শ্যালককে চিনে ফেলেন সগিরা। এ পর্যায়ে ভয় পেয়ে মারুফ তাঁকে গুলি করেন। প্রথম গুলি তাঁর হাতে ও দ্বিতীয় গুলি বুকে লাগে। তিনি রিকশা থেকে পড়ে যান। এর পর মারুফ ফাঁকা গুলি করতে করতে আমার শ্যালককে নিয়ে মোটরসাইকেলে পালিয়ে যান। ওই সময় আমি চেম্বারে ছিলাম। সেখানে বসে আমি টেলিফোনে স্ত্রীর কাছ থেকে সব খবর পাই।’

প্রায় একই রকম জবানবন্দি দেন সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন। তিনি বলেন, ‘সগিরা মোর্শেদ আমার বড় খালাতো বোনের বান্ধবী ছিলেন। তিনি আমার দেবরের স্ত্রী হলেও বয়সে আমার তিন বছরের বড়। আমাদের দুই বাসার গৃহকর্মীর মধ্যে মাঝেমধ্যে ঝগড়া হতো। দুই গৃহকর্মীর কর্মকাণ্ড নিয়ে আমাদের দুই জায়ের মধ্যেও ঝামেলা হতো। একসময় এসব ঝামেলা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। আমি বিষয়টি নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করি। আমরা একমত হই যে কিছু একটা করতে হবে। ...সগিরাকে ভয় দেখানোর জন্য মারুফকে ঠিক করা হয়। তবে তিনি খুন করায় আমার স্বামী তাঁকে চুক্তির টাকা দেননি। ...ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ভাশুরের স্ত্রী নিগার সুলতানার কাছ থেকে আমি বিষয়টি জেনে মর্মাহত হয়ে 
পড়ি। এরপর ভাইও বাসায় এসে যাবতীয় বিষয় আমাকে জানায়।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মহানগর দক্ষিণের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আমরা চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিলাম। এর মধ্যে ডা. হাসান ও তাঁর স্ত্রী ছিলেন পরিকল্পনাকারী। আর মন্টু মণ্ডল এর আগের তদন্তকারীদের দেওয়া চার্জশিটে অভিযুক্ত ছিলেন।

আরও পড়ুন

×