বিনা পারিশ্রমিকে ৩ হাজারের বেশি কবর খোঁড়া মনু মিয়া মারা গেছেন

ছবি: সংগৃহীত
কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫ | ১৪:১৪ | আপডেট: ২৮ জুন ২০২৫ | ১৪:৪৮
কিশোরগঞ্জের ইটনায় বিনা পারিশ্রমিকে তিন হাজারের বেশি কবর খোঁড়া সেই মনু মিয়া (৬৭) মারা গেছেন। মনু মিয়ার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। জীবনের প্রায় অর্ধশত বছর তিনি ব্যয় করেছেন কবর খননের কাজে, বিনিময়ে কখনো কিছু চাননি। আশপাশের গ্রাম ও জেলাজুড়েও পরিচিত ছিলেন ‘শেষ ঠিকানার কারিগর’ নামে।
শনিবার সকালে জয়সিদ্দি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
মনু মিয়ার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে তার ভাতিজা শফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি (মনু মিয়া) দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। ছয় দিন আগে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে তাকে বাড়িতে আনা হয়।
মনু মিয়ার স্বজনেরা বলেন, কবর খোঁড়ার কাজ করতে গিয়ে নিজের দিকে খেয়াল হয়নি নিঃসন্তান মনু মিয়ার। ফলে শরীরে নানা জটিল রোগ বাসা বাঁধে। রোগে কাবু হয়ে সম্প্রতি শয্যাশায়ী হন তিনি। গত ১৪ মে তাকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থতাবোধ করলে তাকে বাড়িতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ সকাল থেকে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে যান।
ইটনার চিকিৎসক ডা. ফেরদৌস আহমেদ চৌধুরী লাকী বলেন, তাকে বলা হতো শেষ ঠিকানার কারিগর। তার মৃত্যুত এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
ড. লাকী জানান, মনু মিয়া স্ত্রী রেখে গেছেন। কোনও সন্তান নেই। জীবনের প্রায় ৫০ বছর তিনি বিনা পয়সায় মানুষের কবর খনন করে গেছেন। দূরদূরান্তে যাতায়াতের সুবিধার জন্য তিনি নিজের নিজের ধানি জমি বিক্রি করে কয়েক বছর আগে একটি ঘোড়া কিনেছিলেন। কারও মৃত্যুর খবর পেলেই মনু মিয়া কবর খননের যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ছুটে যেতেন। কিন্তু মাসখানেক আগে যখন মনু মিয়া ঢাকায় চিকিৎসাধীন ছিলেন তখন কিছু দুর্বৃত্ত তার ঘোড়াটিকে মেরে ফেলে।
ডা. লাকী জানান, তার বাবা ফরহাদ আহমেদ চৌধুরী কাঞ্চন দ্বিতীয় সংসদে কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের বিএনপির এমপি ছিলেন। গত বছর ৮ জুন তার কবরও খনন করেন মনু মিয়া। কিন্তু একটি টাকাও তিনি মনু মিয়াকে দিতে পারেননি। অনেকেই তাকে আবারও একটি ঘোড়া কিনে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মনু মিয়া কারও কাছ থেকেই সাহায্য নিতে রাজি হননি। ঘোড়াটি মেরে ফেলার জন্য কারও ওপর তিনি ক্ষোভও প্রকাশ করেননি। বরং বলেছেন, আমার কবর খননের পথ চলা হয়ত সৃষ্টিকর্তা এ পর্যন্তই লিখে রেখেছিলেন।
মনু মিয়ার ছোট ভাই সাঈদ মিয়া জানান, সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে মনু মিয়া নিজ ঘরে মারা গেছেন। স্ত্রী রহিমা বেগম এসময় পাশে ছিলেন। কোনও সন্তান নেই তার। তার জীবনে বেশি কিছু চাহিদা ছিল না। বিনা পারিশ্রমিকে বিভিন্ন এলাকায় তিনি প্রিয় ঘোড়ায় চড়ে কবর খনন করতে যেতেন। কিছু কৃষি জমি আছে। এর আয় দিয়েই কোনও রকমে সংসার চলে যেত।
তিনি জানান, ভাইয়ের জন্য তারা পরিবারের লোকজন গর্ববোধ করতেন। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন সবাই কান্নাকাটি করছে।
স্থানীয় ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য প্রজেশ চন্দ্র বণিক জানান, তার ওয়ার্ডের সাদা মনের মানুষ মনু মিয়ার মৃত্যুর খবর শুনেই বাড়িতে ছুটে গিয়েছেন। মনু মিয়া জীবনের বিরাট সময় অন্যের কবর খনন করেছেন। আজ এলাকার লোকজন তার কবর খনন করেছেন। বিকেলে আসরের নামাজের পর এলাকার গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হবে বলে ইউপি সদস্য প্রজেশ চন্দ্র বণিক জানিয়েছেন।