শেয়ার ব্যবসায় বেপরোয়া আইডিআরএ চেয়ারম্যান

আনোয়ার ইব্রাহীম
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২২ | ১৫:০০
বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেনের শেয়ার ব্যবসার খবর নতুন নয়। বীমা খাতের সবচেয়ে বড় 'ইনসাইডার' (গোপন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য জানতে পারেন, এমন ব্যক্তি) হয়েও বছরের পর বছর বীমা কোম্পানিরই শেয়ার কেনাবেচা করেছেন তিনি। নতুন খবর হলো- শেয়ার ব্যবসায় ড. মোশাররফ এতটাই মরিয়া যে, বিনিয়োগের বিপরীতে বড় অঙ্কের মুনাফা পেতে আইপিওতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কোটায় বড় অঙ্কের শেয়ার পেতে চেয়েছিলেন তিনি। এ জন্য জাল-জালিয়াতি করে বেসরকারি খাতের ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নামে বিও অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে প্রতারণা করে ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খোলেন তিনি। অথচ ওই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে কোনোভাবেই সংশ্নিষ্ট ছিলেন না।
আইডিআরএর সদস্য থাকাকালে ড. মোশাররফের এ জালিয়াতি ধরা পড়ে। পরে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নামে খোলা অবৈধ অ্যাকাউন্ট থেকে নিজের কোম্পানি লাভস অ্যান্ড লাইভস অর্গানিকসের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা সরিয়ে নেন তিনি। ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের নামে খোলা ব্যাংক এবং বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেন। আইডিআরএ চেয়ারম্যানের দুর্নীতির তথ্য অনুসন্ধানে সম্প্রতি এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। বড় এ জালিয়াতির ঘটনাসহ তার অবৈধ শেয়ার ব্যবসার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গত সপ্তাহে তার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। একের পর এক জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তি কী করে আইডিআরএতে প্রথমে সদস্য এবং পরে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়েছেন এবং এখনও এ পদে বহাল আছেন- তা নিয়ে বীমা খাতের অনেকে বিস্মিত।
অভিযোগ আছে, ড. মোশাররফ আইডিআরএর শীর্ষ পদে যোগ দেওয়ার পর কিছু বীমা কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন। ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কয়েকজন উদ্যোক্তার অর্থ লোপাটের ঘটনা ধামাচাপা দিতে নানা সময়ে ঘুষ নিয়েছেন। ঘুষ চেয়ে না পাওয়ায় প্রচলিত সব বিধিবিধান ভেঙে ডেলটা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মতো বৃহৎ বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ স্থগিত করে নিজের পছন্দের লোককে প্রশাসক হিসেবে বসিয়েছেন। যাদের প্রশাসক হিসেবে বসিয়েছেন, তারাও অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। এ কারণে মাত্র ৯ মাসে একের পর একজনকে সরিয়ে তিনজনকে প্রশাসক নিয়োগ দেন। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে একাধিক মামলা হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের মোবাইল ফোনে কয়েক দফায় ফোন এবং এসএমএস করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার সদস্য ও চেয়ারম্যান পদে থেকে ব্যবসা পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। এর আগে অন্য রিপোর্টের বিষয়ে সমকালকে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ওই দুই কোম্পানির কোনো ব্যবসা এখন নেই। আইডিআরএতে যোগ দেওয়ার কয়েক মাসে আগে খোলা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা কার্যক্রম কখনোই শুরু করেননি। কিন্তু এ দুই কোম্পানির নামে কী করে প্রভিডেন্ট ও গ্র্যাচুয়িটি ফান্ড গঠন হয় এবং সেগুলোর নামে বিও অ্যাকাউন্ট খুলে কীভাবে ব্যবসা করেছেন- এমন প্রশ্নের উত্তর তার কাছ থেকে মেলেনি।
ট্রাস্ট লাইফের নামে জালিয়াতির অ্যাকাউন্ট: আইপিও প্রক্রিয়ায় শেয়ার বিক্রি করে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানির শেয়ারদর এক থেকে দুই মাসে দুই থেকে দশ গুণ হওয়ার বহু নজির আছে শেয়ারবাজারে। আইপিও শেয়ার পেলেই এক কোটি টাকার বিনিয়োগ অনেক সময় দশ কোটি টাকা হয়ে যায়। আইডিআরএ চেয়ারম্যান শেয়ার ব্যবসায় এ সুযোগ নিতে চেয়েছিলেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধভাবে আইপিও শেয়ার পেতে ২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথমে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেন। এ জন্য বীমা কোম্পানিটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহফুজুল বারী চৌধুরীর স্বাক্ষর জাল করেন। এ জন্য বীমা কোম্পানিটির পর্ষদ সভার সিদ্ধান্তের (রেজুলেশন) ভুয়া নথি তৈরি করেন। ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ট্রান্সকন সিকিউরিটিজ নামে ব্রোকারেজ হাউসে বিও অ্যাকাউন্ট খোলেন। বিও অ্যাকাউন্ট নম্বর ১২০৪৩৯০০৬৩৬৩১৪৮১। বিও অ্যাকাউন্টটিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে যোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে নিবন্ধন দেয়। ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের তৎকালীন পরিচালক মো. আব্দুল ওয়াদুদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন ড. মোশাররফ। এরপর নাহী অ্যালুমিনিয়াম নামের কোম্পানির আইপিও শেয়ার পেতে ডিএসইর নামে ১৫ লাখ টাকার পে-অর্ডার করেন তিনি। ড. মোশাররফ হোসেন ২০১৮ সালের এপ্রিলে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। এরপরও তিনি ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নামে খোলা অবৈধ ওই ব্যাংক এবং বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেননি।
ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স যোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর নিবন্ধন নিতে ডিএসইতে গিয়ে ড. মোশাররফের এ জালিয়াতির বিষয়ে জানতে পারে। বীমা কোম্পানিটি ড. এম মোশাররফ হোসেনকে অবৈধভাবে খোলা ব্যাংক এবং বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে অনুরোধ করে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি তিনি অ্যাকাউন্ট দুটি বন্ধ করেন। এর আগে অবৈধ ব্যাংক হিসাবে থাকা ১৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা নিজের মালিকানাধীন লাভস অ্যান্ড লাইভস অর্গানিকসে সরিয়ে নেন। বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ পদে থাকায় বীমা কোম্পানিটি তার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলা করেনি। তবে অবৈধ এ অ্যাকাউন্ট খোলার সহযোগী ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের সাবেক পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদের কাছে জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, এ বিষয়ে তার কিছু মনে নেই। ড. মোশাররফের এমন জালিয়াতি জানার পর ট্রাস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিল কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরেও তার জবাব, 'মনে নেই'।
অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির মালিকানায় ড. মোশাররফ: বীমা কোম্পানির নামে জাল-জালিয়াতি করে ব্যাংক ও বিও অ্যাকাউন্ট খুলে ক্ষান্ত হননি ড. মোশাররফ। পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় পিএফআই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট নামে খোলেন এবং ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে মালিকানা নেন নিজ কোম্পানির নামে। এ প্রতিষ্ঠানও শেয়ার ব্যবসা কার্যক্রমে জড়িত।
শেয়ারবাজারের বড় জুয়াড়ির সঙ্গে সখ্য: শেয়ারবাজারে গত দুই বছর ধরে সবচেয়ে আলোচিত নাম আবুল খায়ের হিরো। অভিযোগ আছে, সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে কর্মরত সরকারি এ কর্মকর্তার কারসাজিতে একের পর এক বীমা কোম্পানির শেয়ারদর এক সময় হু হু করে বেড়েছিল। জানা গেছে, হিরোর সঙ্গে মিলে ড. মোশাররফ অনেক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা করেছেন। এ ছাড়া সর্বশেষ আইপিও প্রক্রিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক কোটায় একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বড় অঙ্কের শেয়ার কিনেছেন।
শুধু বীমার শেয়ার নয়, হিরোর কারসাজিতে রাতারাতি দর বেড়ে যাওয়া বেশকিছু কোম্পানির শেয়ারে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেন ড. মোশাররফ। আবুল খায়ের হিরো নিজ নাম ছাড়াও তার স্ত্রী, শ্যালিকা ও বাবার নামে ডেলটা লাইফের প্রায় ৯ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছিলেন। এ ঘটনায় ড. মোশাররফ হোসেন তার কোম্পানির নামে খোলা বিও অ্যাকাউন্ট থেকে ডেলটা লাইফের ৩৪ হাজারেরও বেশি শেয়ার কিনেছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল খায়ের হিরো সমকালের কাছে দাবি করেন, আইডিআরএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার সখ্য নেই। শেয়ারবাজারে তার নাম প্রচারের পর নানাজন নানাভাবে গল্প তৈরি করে। এগুলো তারই অংশ হতে পারে। ড. মোশাররফ কী করে তার আইটেমগুলোতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন, জানতে চাইলে আবুল খায়ের হিরো বলেন, এটা কাকতালীয় হতে পারে। বা অনেকে তথ্য জেনে শেয়ার কেনে- তেমনটিও হতে পারে।
- বিষয় :
- শেয়ার ব্যবসা
- আইডিআরএ
- শেয়ার বাজার