ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সরষের ভূত চিনতে হবে

সরষের ভূত চিনতে হবে

ড. চঞ্চল খান

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২০ | ১৩:৪২

বাঙালি হিসেবে আমার প্রেরণার উৎস দু'জন- রবীন্দ্রনাথ ও শেখ মুজিব। প্রথমজনের কাছ থেকে পেলাম ভাষা, আর দ্বিতীয়জনের কাছ থেকে পেলাম দেশ। যখন আমাদের দুর্দিন ছিল, যখন এদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণে ছিল কঠোর বারণ, তখন অন্তত চিনতে ভুল হতো না- কে আমাদের শত্রু আর কে আমাদের নয়। আজ আমরা কাউকে আলাদা করতে পারি না। সবাই বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। সবাই এক কাতারে চলে এসেছে। মনে হয়, একই নদীতে হাঙর, তিমি, সাপ, তাবত ভয়ংকর প্রাণীর সঙ্গে আমিও সাঁতার কেটে হয়রান হচ্ছি।

এখন সেই দুঃসময়ের কিছু কথা বলি। আশির দশক। আমি কাজ করতাম ঢাকায় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির দপ্তরে। আমার চেয়ারের পেছনের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর একটি প্রতিকৃতি টাঙিয়ে ছিলাম। অনেকে আমার ঘরে ঢুকে আঁতকে উঠত। কেউ কেউ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করত, এটা কেন? আমার বস ছিলেন মার্কিন নাগরিক ডেভিড বেকার। তার ঘরে আমেরিকার জাতির পিতা জর্জ ওয়াশিংটনের ছবি টানানো থাকত। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন একদিন, 'হোয়াই ডু ইউ হ্যাভ টু হ্যাং দিস পিকচার অন ইওর ওয়াল?' আমি বললাম, 'ইট ইজ ফর দ্য সেম রিজন ইউ হ্যাভ পুট জর্জ ওয়াশিংটন অন ইওর ওয়াল।' এর পর আর এই বিষয়ে কথা বাড়েনি। ভদ্রলোকের প্রশ্নের হেতু সহজেই অনুমেয়। ওই একই সময়ের আরেকটি ঘটনা। আমার কাছে শিল্পী অলকেশ ঘোষের আঁকা রবীন্দ্রনাথের এক অসাধারণ জীবন্ত ছবি ছিল। আমি চাইছিলাম বঙ্গবন্ধুরও তেমনই একটা জীবন্ত ছবি আমার বাসার দেয়ালে থাকবে। গেলাম একজন প্রথিতযশা শিল্পীর কাছে। সেই বিশিষ্ট শিল্পী তখন আমাকে বলেছিলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি আমি বরং আপনাকে এমন একটা ছবি এঁকে দিই যাতে শুধু মুজিবের তর্জনী দেখা যাবে আর তাঁর সামনে আবছা কিছু দিয়ে একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবি হবে। আপনি ঠিকই বুঝে নেবেন এটি মুজিবের ছবি। আমি সেই ছবিটির ফরমায়েশ থেকে বিরত থাকি।

এবার বলি বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে প্রবাস জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠান করেছি গুটিকয়েক জন আমরা ঘরোয়াভাবে। দূতাবাস আমাদের জাতীয় অনুষ্ঠানে (যথা শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস) নিমন্ত্রণ করত না। যদি আমাদের মুখ ফসকে হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হয়! ২০০২ সালে মাওলানা সাঈদী এলো মেলবোর্নে এক ঝাঁক পুরোনো ও নতুন রাজাকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। ১০ জনের মতো আমরা সাঈদীর সভাস্থলে প্রতিবাদ মিছিল করলাম ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে। সিডনি থেকে এসে আমাদের দল ভারি করলেন আরও ১০ জন। এই ক'জনই আমরা। আজকে দূর থেকে দেখি, একদা চরম মুজিববিরোধী মানুষগুলো মুজিব মুজিব করে গলা ফাটায়। পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে ফেলে চারদিক।

মনে পড়ে, আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ঘোর দুর্দিন '৭৫-পরবর্তী সময়। বঙ্গবন্ধুকন্যা তখনও দেশে ফেরেননি। সে সময় যারা বঙ্গবন্ধুর নিবেদিতপ্রাণ কর্মী তাদের অন্যতম ওবায়দুল কাদের, নুরুল ইসলাম সুজন, অসীম কুমার উকিল, মহিউজ্জামান ময়না, কামাল চৌধুরী, জাফর ওয়াজেদ, বাহালুল মজনুন চুন্নুসহ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের অনেক অকৃত্রিম কর্মী। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতাকারী চীনপন্থি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও তথাকথিত সর্বহারা দলের নেতারা জাসদের সঙ্গে এক হয়ে ডানে-বাঁয়ে সারাক্ষণ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে বেড়াত। তারাই আজ শতবর্ষ পালনে সরব।

আমরা এখন যারা জীবনের পরিণত পর্যায়ে এসেছি; আমরা যারা একাত্তর দেখেছি; '৭৫-পরবর্তী কঠিন সময় দেখেছি; যারা '৮১-তে বঙ্গবন্ধুকন্যার দেশে প্রত্যাবর্তন দেখেছি; তাদের জন্য বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের এক বিরাট সুযোগ এসেছিল। আমিও চাই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন করতে; সেটা আমার মতো করে; আমার একার অন্তরের অনুভূতি দিয়ে। কিন্তু আমাদের চিনতে হবে সরষের ভেতর যে ভূতরা লুকিয়ে আছে, তাদেরকে।
রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও গবেষক

আরও পড়ুন

×