সমাজ
সব ধর্মাবলম্বীর সমান নাগরিক অধিকার চাই

রণেশ মৈত্র
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২২ | ১২:০০
দেশে সংখ্যালঘু পীড়নের এক নতুন স্টাইল চালু হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে নানা জাতীয় পোস্টের মধ্যে কোথা থেকে যেন কোনো এক সংখ্যালঘু তরুণের নামে ধর্ম অবমাননাকর পোস্ট দেখা যায়। তারপর তা মুখে মুখে বা মোবাইল ফোনে বা মাইকে এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়- সংশ্নিষ্ট হিন্দু তরুণটি ধর্ম অবমাননা করেছে। কথা কয়টি মুখ থেকে বেরোনোর পর ফুরসত নেই; নিমেষেই এলাকাটি লোকে লোকারণ্য। সবাই উত্তেজিত। কারও হাতে লাঠি বা অন্য কোনো দেশীয় অস্ত্রও দেখা যায়। তারপর ভাঙচুর, হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হতাহতের ঘটনা।
দেশের বিভিন্ন হিন্দুপল্লি এমন জমায়েতের সঙ্গে পরিচিত। তারা সবাই আতঙ্কে শিউরে ওঠে। আতঙ্কিত বোধ করে। কারণ, তারা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতায় পাকিস্তান আমল থেকে আজতক এভাবে নিজেদের আক্রান্ত হতে দেখেছে। তখন হাজার ডাকলেও পুলিশ আসবে না; প্রশাসনের কেউ আসবে না। এমপি নন, চেয়ারম্যান নন- কেউ না। অসহায়ভাবে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের একতরফা হামলার শিকার হতে হবে। অথচ এই দেশে তো জন্ম হিন্দুদেরও। এই একই দেশের সমধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসম্পন্ন নাগরিক তো তারাও। তারা তো বেশি কিছু চাইছে না। চাইছে শুধু সংবিধান সব নাগরিকের যে অধিকার দিয়েছে সেটুকুই। সংবিধান তো বলেনি- হিন্দুরা এক ধরনের অধিকার ভোগ করবে; মুসলিমরা তার চেয়ে বেশি অধিকার ভোগ করবে; খ্রিষ্টানরা মুসলিমদের চেয়ে কম অধিকার ভোগ করবে; বৌদ্ধরাও তা-ই। না, এমন কোনো বিধান, এমন কোনো ধর্মীয় বৈষম্যমূলক বিধির অস্তিত্ব নেই আমাদের সংবিধানে। তবু রাষ্ট্র কেন বৈষম্যমূলক আচরণ করেই চলেছে?
সত্য-মিথা যাই হোক- সংখ্যাগুরুর ধর্মের প্রতি সামান্য কটাক্ষ প্রকাশ হলে তৎক্ষণাৎ প্রকাশকারী বা অভিযুক্ত সংখ্যালঘু ব্যক্তি তো বটেই, তার সম্প্রদায়ের সবার বাড়িঘর, তার পাড়া ও গ্রাম ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতনের শিকার হয়। অপরদিকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির বা ধর্মীয় স্থাপনা আক্রান্ত হচ্ছে; দেব-দেবীর মূর্তি ভাঙচুর করা হচ্ছে; তাতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কোনো মোকদ্দমা হয় না। কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় না। কারও বিন্দুমাত্র শাস্তি দেওয়া হয় না! আবার যদি একটি মুসলিম বাড়ি আক্রান্ত হয়; আক্রমণকারীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়। হিন্দুদের গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের শিকার হলেও কোনো মামলা হয় না হামলাকারীদের বিরুদ্ধে। এই বৈষম্য সৃষ্টি করে চলেছে আমাদের রাষ্ট্র।
দেশে কিছুদিন পরপরই নানা অজুহাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যেসব হামলার ঘটনা ঘটে; প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায় তা ঘটে থাকে ধর্ম অবমাননার গুজব রটিয়ে বা মিথ্যা অভিযোগ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর পেছনে চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ইন্ধনের প্রমাণ মেলে। সম্পত্তি দখল বা স্থানীয় বিরোধ নিয়েও এ জাতীয় ঘটনা ঘটানো হয়। ঘটনা ঘটার পর আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে ঠিকই; কিছু দিন যেতে না যেতেই ইস্যু চাপা পড়ে যায়। অপরাধীরাও বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বাংলাদেশের জন্মের শুরু থেকেই সংখ্যালঘুরা ছিল অপশক্তিগুলোর টার্গেট। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বেছে বেছে হিন্দুদের ওপর হামলা চালিয়েছে। লক্ষ্য হিন্দু জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করা। পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ কমেনি। ধর্ম অবমাননা, জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচন কিংবা তুচ্ছ কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর একটি বিশেষ ভোটব্যাংকের তকমা নিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা চালানো হয়, তা ১৯৪৭, ১৯৫০, ১৯৬৪, ১৯৯০, ১৯৯২ সালের সংখ্যালঘু নির্যাতনেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। পরবর্তী সময়ে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এ ছাড়া ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন যেন নতুন মাত্রা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী ও সংখ্যালঘু নেতারা বলছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রাম আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে ১৯৭৫-পরবর্তী কোনো জাতীয় নির্বাচন সংখ্যালঘুদের জন্য সুফল বয়ে আনেনি। নির্বাচনের আগে ও পরে, দুর্গোৎসবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি এখন যেন নির্ধারিত হয়ে গেছে। বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি দেবালয়ও এসব হামলার লক্ষ্যবস্তু। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা সংখ্যালঘু অজুহাতে নির্যাতনের সময় নীরব ভূমিকা পালন করেন।
বারবার হামলা, টার্গেট, সংখ্যালঘু দেখে ধর্মের নামে উগ্রবাদ, অসহিষুষ্ণতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। মৌলবাদী গোষ্ঠী ও তাদের নানা বর্ণের পৃষ্ঠপোষকরা বা তাদের লালিত গোষ্ঠী যে কোনো ছুতায় হামলে পড়ছে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর। এসব ঘটনা যারা ঘটিয়ে যাচ্ছে, বছরের পর বছর ধরে কখনও প্রকাশ্য দিবালোকে আবার কখনও রাতের অন্ধকারে- কোনো ঘটনা প্রতিরোধেই পুলিশকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। ভিকটিমরা মামলা দিলে হয়তো তা রেকর্ড করা হয়, কিন্তু পুলিশি তদন্ত কিছুতেই এগোয় না; যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হুঙ্কার ছাড়েন- 'অপরাধীদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।' বাস্তবে যা ঘটে তা হলো, 'অপরাধীদের কাউকেই শাস্তি দেওয়া হবে না।'
বহু ঘটনায় এটা প্রমাণিত। হিন্দুরা দেশ ছাড়বে না। এসব ঘটনার পেছনে হিন্দুদের এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্য কাজ করে। এমন উদ্দেশ্য বহু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। যথেষ্টসংখ্যক হিন্দু ১৯৪৭ বা তারও আগে থেকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে নারী-শিশুদের নিরাপত্তা ও আস্থাহীনতার কারণে। তবু যে দেড় কোটি আজও আছে, তারা চায় তাদের মাতৃভূমিতেই থাকতে। তবে আতঙ্ক নিয়ে নয়; অধিকারহীনতা নিয়েও নয়; পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার ও ধর্মীয় বৈষম্যমুক্ত হয়ে। সব ধর্মাবলম্বীর জন্য সমান নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করাতেই সমাধান। সে পরিবেশ যাঁরা গড়বেন, তাঁদের আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে রাস্তায় নামা প্রয়োজন।
রণেশ মৈত্র :সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
[email protected]