বৃদ্ধাঙ্গুলি

সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২২ | ১৪:৫৫
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি যেভাবে উপাচার্যসহ শীর্ষ তিন পদ শূন্য রাখিয়াই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করিতেছে, তাহা আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি বৈ কিছু নহে। প্রশ্ন হইল, দিবসের পর দিবস তাহারা কীভাবে এই রূপ বেআইনি কর্ম করিয়া যাইতেছে? রবিবার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, অন্তত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ ছাড়াই চলিতেছে। উপাচার্য কর্তৃক মূল সনদপত্রে স্বাক্ষর করিবার বিধান থাকিলেও অবৈধভাবে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের স্বাক্ষর দ্বারাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সনদ বিতরণ করিতেছে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি বিধি অনুসারে, অর্থনৈতিক বিষয়াদি ব্যবস্থাপনায় যথায় কোষাধ্যক্ষ থাকা জরুরি, তথায় প্রায় অর্ধেক সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ই চলিতেছে কোষাধ্যক্ষ ব্যতীত। ইহা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বেচ্ছাচারিতার প্রকাশ নহে, বরং ইহাতে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতাই প্রতিভাত।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শীর্ষ পদসমূহে শূন্যতা হেতু তথায় দুর্নীতির পথ প্রসারিত হইতেছে বলিয়া অনুমেয়। ইউজিসির একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে জানাইয়াছেন, নিয়মিত বৈধ উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ না থাকিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অনিয়মে সুবিধা করিতে পারে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য এহেন অভিযোগ হতাশাজনক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যে দেশের উচ্চশিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখিয়া চলিয়াছে, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কিন্তু বহু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের ভূমিকা দেখিয়া মনে হয়, তাহারা শিক্ষার চাইতে বাণিজ্যতেই অধিক মনোযোগী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হইলেও জমি ক্রয় করিবার নামে তিন শতাধিক কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত হইয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক চার ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য এখন কারান্তরীণ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ট্রাস্টি বোর্ডের বিরুদ্ধে মিটিংয়ে উপস্থিত হইবার জন্য মোটা অঙ্কের সম্মানী গ্রহণ; বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে গাড়ি ক্রয়; বিদেশ ভ্রমণ ও অবৈধ কোটা চালু করিয়া অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি; অর্থ পাচার; ইচ্ছামাফিক জনশক্তি নিয়োগদান ইত্যাদি অভিযোগও রহিয়াছে। নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাইবার সরকার নির্ধারিত সময়সীমা বহু পূর্বে অতিক্রান্ত হইলেও বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অদ্যাবধি ভাড়া বাড়িতে কার্যক্রম চালাইতেছে। বহু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি ও পড়াশোনার সুযোগ-সুবিধা না থাকিবার অভিযোগও বিস্তর।
বস্তুত উপাচার্য, উপ-উপাচার্য কিংবা কোষাধ্যক্ষ ব্যতীত একটা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কল্পনা করাও কঠিন। তারপরও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির পক্ষ হইতে খুব একটা তৎপরতা পরিলক্ষিত হইতেছে না। ইউজিসি বলিতেছে, তাহারা এতদ্বিষয়ে অবগত। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাহাদের ডাকিয়া আনিয়া আইন মান্য করিতে একাধিকবার তাগিদ দিয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে। একদ্সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আপিন মতেই চলিতেছে। উহাদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণ অনুসন্ধান জরুরি। আমরা জানি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অমান্য করিলে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধসহ কঠোর শাস্তির বিধান রহিয়াছে। উক্ত আইনের লঙ্ঘন দেখিলে সঙ্গে সঙ্গে কারণ দর্শাইবার নোটিশ দানে ইউজিসি কতটা তৎপর ছিল- সেই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠিবে। আইন ভঙ্গকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহের কোনো অশুভ আঁতাত রহিয়াছে কিনা, অনুসন্ধান জরুরি।
স্মর্তব্য, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়াছে। অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হইল, লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পাইয়া এবংবিধ প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করিতেছে। ইহার জন্য তাহাদেরকে প্রতি বৎসর সীমিত উপার্জনক্ষম পিতা-মাতার হাড় জল করা বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিতে হইতেছে। এমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষা কার্যক্রম যথাযথভাবে না চলিলে উহা উল্লিখিত শিক্ষার্থীদের সহিত এক প্রকার প্রতারণার শামিল বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। অতএব, ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যথাযথ ভূমিকা পালন অত্যাবশ্যক। লোকচক্ষুরঞ্জন তৎপরতা নয়; আলোচ্য বেপরোয়া বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে আইন মান্য করিতে সত্যিকার অর্থেই পদক্ষেপ লইতে হইবে। শীর্ষ পদ তো বটেই; আইনানুযায়ী সকল পদে জনবল নিয়োগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাধ্য করিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। শিক্ষার্থীরা কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করিয়া যাহাতে যথাযথ শিক্ষা লাভ করিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করিতেই হইবে।
- বিষয় :
- বৃদ্ধাঙ্গুলি
- সম্পাদকীয়