ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মার্ক্সীয় জীবন

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মার্ক্সীয় জীবন

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

এন এন তরুণ ও বেবী সাউ

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ | ০৩:০৪ | আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ | ০৬:৩৫

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা সাহিত্যে আর কে নোবেল পেতে পারতেন। তিনি যেসব নাম বলেছিলেন, তার প্রথমেই ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। জীবনানন্দ, বিভূতি ও তারাশঙ্করের নামও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। বঙ্গের সাধারণ মানুষ, এমনকি লেখক-সাহিত্যিকদের অনেকেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অমর সৃষ্টির পেছনের শক্তির কথা জানেন না। জানেন না, কেন তিনি মার্ক্সীয় জীবন বেছে নিয়েছিলেন।

মানিকের মতো আরও কয়েকজনের নাম করি এখানে, যাতে আমাদের কবি-লেখকরা উৎসাহ পান। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যিনি বাংলা সাহিত্যে সাতটি নতুন বিষয়ের আবিস্কর্তা, বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৯ বছর। কাজী নজরুল বাকশক্তি হারান ৪৩ বছর বয়সে, ৪৩ বছরের মধ্যে অন্যান্য সৃষ্টি ও কর্মমুখরতার পাশাপাশি তিনি সাড়ে ১০ হাজার গান লিখেছেন (এখানে আরও দুটি তথ্য দিই : এক. রবীন্দ্রনাথের গানের সংখ্যা সাড়ে ৩ হাজারের মতো। দুই. পৃথিবীতে কোনো ভাষায় কোনো কবি বা গীতিকার এত বেশি গান রচনা করেননি)। তিনজনই তাঁদের ঝোড়ো জীবনে শিল্পের শিখা প্রজ্বালন করে রেখে গেছেন বাংলা সাহিত্যে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ৪৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে সাহিত্যচর্চাই করেছেন ২৮ বছর। ২৮ বছরের সাহিত্যিক জীবনে ৫৭টি গ্রন্থ রচনা করা অসম্ভব কিছু নয় কিন্তু শিল্পের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ এসব গল্প-উপন্যাস সুবিশাল। শিল্পমান অক্ষুণ্ণ রেখে এই বিশাল সম্ভার কীভাবে সম্ভব হলো আমাদের সময়ের শিল্পী-সাহিত্যিকদের, তা বোঝা দরকার। সৃষ্টির সঙ্গে একাত্ম হয়ে, সাধনা করাই মহৎ সৃষ্টির মূলমন্ত্র। আর সৃষ্টি ও কর্মের মধ্যে একটি আন্তঃসম্পর্ক আছে। মহৎ চিন্তাই যথেষ্ট নয়। মহৎ চিন্তার প্রতিফলন থাকতে হয় কর্মে। তাহলে কর্মও মহৎ হয়ে ওঠে। মহৎ চিন্তা উন্নত জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে। উন্নত জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা শুধু নিজের জন্য নয়, বরং সবার জন্য। সব মানুষের জন্য উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বাস স্থাপন করেছেন মার্ক্সবাদে, যুক্ত হয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টিতে, আজীবন কাজ করেছেন মানুষের মুক্তির জন্য।

সমাজের প্রতি দায়বদ্ধাতা ছাড়া একজন সাহিত্যিকের সৃষ্টি পূর্ণতা পায় না। এর জন্য দুটি জিনিস যুগপৎ দরকার। মহৎ সৃষ্টির সঙ্গে প্রয়োজন মহৎ কর্ম। এটাই সম্ভবত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনদর্শন। এই জীবনদর্শনই ধারণ করেছিলেন পাবলো নেরুদা, জ্যঁ পল সার্ত্রে, ম্যাক্সিম গোর্কি- এমনকি বার্টান্ড রাসেল ও গ্রাহাম গ্রিনরাও। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন।

ছিলেনও প্রলেতারিয়া মনেপ্রাণে। পার্টি ফান্ডে পৈতৃক বাড়ির অংশীদার হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ দান করে দিয়েছিলেন। নিজের চাকরি নেই, খাবার টাকা নেই অথচ কমিউনিস্টদের পত্রিকায় সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য হিসেবে নিরলস কাজ করেছেন।

আমরা জীবনানন্দকে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ বলে জানি। কিন্তু জীবনানন্দের যে গুটিকয় বন্ধু ছিলেন, মানিকের তা-ও ছিল না। কিন্তু যেটা লক্ষণীয় তা হলো, নিঃসঙ্গ নির্জন হলেও তিনি আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন না বরং ছিলেন সামাজিক ও সমাজবাদী। ক্রিটিক বলছেন, নির্জনতা ও সামাজিকতা- এই আত্মবৈপরীত্য মানিকের অন্তর্বাস্তবতা ও বহির্বাস্তবতা নির্মাণ করেছে। তাঁর গল্পের অনেক চরিত্রে এ রকম বৈপরীত্যের সন্ধান মেলে : একদিকে নির্জন চিন্তা, বিশ্নেষণ, রহস্য ও সংকেত; অন্যদিকে বহির্বাস্তবের প্রতি কৌতূহল। এই কৌতূহল তথা জীবনের প্রতি কৌতূহল মানিককে নিয়ে গেছে জীবনের কাছে, সাহায্য করেছে জীবনের, বিশেষ করে, সাধারণ মানুষের জীবনের ছবি আঁকতে। তিনি বলেছেন, 'ভালোবাসতাম লাল ধুলোভরা শহরের নোংরা পুরোনো ঘিঞ্জি লোকালয়, মোটেই হিসাব থাকত না যে কাদের সঙ্গে মিলছি, মিশছি, খেলাধুলা হইচই করছি, তারা বয়সে বড় অথবা ছোট, সংসারের মাপকাঠিতে ভদ্র অথবা ছোটলোক।'

কমিউনিস্ট আদর্শের যে ভিত্তি, সমন্বিত জীবন-চেতনা, মানিকের জীবনে তার নিদর্শন মেলে যখন দেখা যায় কোনো ব্যক্তিকে তিনি তাঁর কোনো বই উৎসর্গ করেননি। বস্তুত তিনি 'স্বাধীনতার স্বাদ' নামে একটিমাত্র গ্রন্থই উৎসর্গ করেছেন এবং তা তিনি করেছেন জনসাধারণের উদ্দেশে। মানিকের কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ তাঁকে কল্পরাজ্যে নিয়ে যায়নি বরং তিনি থেকেছেন মাটির কাছাকাছি। পরিবারের প্রতি, বৃদ্ধ পিতার প্রতি, স্ত্রীর প্রতি যথাসাধ্য দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর আরও বড়-ছোট ভাই থাকার পরেও এবং বিপুল দারিদ্র্য সত্ত্বেও বৃদ্ধ পিতার দায়িত্ব তিনি নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন। ধনী বড় ভাইয়ের কাছে সামান্য কিছু টাকা চেয়েও পাননি মানিক। প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু একসময় তাঁর প্রতি মোহভঙ্গ হয় যখন তাঁদের দ্বারা প্রতারিত হন। তাঁদের মুখোশ উন্মোচন করতে গিয়ে তিনি যা লিখেছেন, তার মধ্যে মানিকের দার্শনিক চিন্তার পরিচয় মেলে: শুধু সচেতন বুদ্ধি খাটিয়ে শিল্পসাহিত্য সৃষ্টি করা যায় না। বিষয়বস্তু নির্বাচন করা থেকে শুরু করে সব কাজ শুধু বুদ্ধি দিয়েই নয়, বরং সমগ্র চেতনা সহযোগিতা না করলে 'সৃষ্টি' হয় না।

শুধু শ্রেণিসচেতনতা মাত্রই নয়, মধ্যবিত্তের শ্রেণি থেকে নেমে এসে একেবারে একাত্ম হয়ে না গেলে 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসে তিনি লিখতে পারতেন না: 'ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এইখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।' একজন সাহিত্যিকের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার প্রয়োজন পড়ল কেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনের গভীর, অশান্ত জিজ্ঞাসা নিয়ে একেবারে কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে অবস্থান ও কর্মপ্রযত্ন নির্বাচন করেছিলেন।' নরেন্দ্র মিত্র জানাচ্ছেন তাঁর ঘর ও আসবাবপত্রের দৈন্যদশার কথা। তাঁর সেজো দাদা, হিমাংশু কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তাঁর কালজয়ী উপন্যাস 'পদ্মানদীর মাঝি' লেখার কিছুদিন আগের কথা: 'টাঙ্গাইলে থাকার সময় মাঝে মাঝে ও বেরিয়ে যেত মাঝিমাল্লাদের সাথে। চার-পাঁচ দিন পরে বাড়ি ফিরত, ওদের সঙ্গে একত্রে থাকত। অনেক দিন সকাল থেকে ওখানেই পড়ে থাকত।'

সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়োজনে, চরিত্রের সাথে একান্ত পরিচয় ছাড়া, একাত্ম হওয়া ছাড়া চরিত্রের এমন সার্থক রূপায়ণ সম্ভব নয়। এখানেই দরকার সাধনা, নিম্নে নেমে এসে নিম্নবর্গের মানুষদেরই একজন হয়ে ওঠা। তার মানে হলো, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ইচ্ছে করেই বেছে নিয়েছিলেন কমিউনিস্টের জীবন, নিম্নবর্গের মানুষদের একজন হওয়ার জন্য। তাঁর জীবনদর্শন আগেই উল্লেখ করা হয়েছে: "সমগ্র চেতনা সহযোগিতা না করলে 'সৃষ্টি' হয় না।" মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রধান দুটি মাধ্যমেই কাজ করেছেন: সাহিত্য সৃষ্টি ও রাজনীতি। উদ্দেশ্য- খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন।

এ দেশের অনেক সাহিত্যিকই নিজেদের কলমশ্রমিক বলতে পছন্দ করেন। সম্ভবত তাঁরা এটা মানিকের কাছে থেকেই শিখেছেন কিন্তু তাঁদের জীবনাচরণে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। 'লেখকের সমস্যা' প্রবন্ধে মানিক 'সব সময় সর্বত্র জীবনকে দর্শন করার বিরামহীন শ্রমের' কথা বলেছেন। একজন লেখককে কী রকম অনুপুঙ্খভাবে পরিপার্শ্ব লক্ষ্য করতে হবে, তা বর্ণনা করেছেন। বহির্জগৎ সম্পর্কে এই কৌতূহল মানিককে বাস্তবাবাদী শিল্পীতে পরিণত করেছে। মানুষের মনোলোক ও বহির্লোকের প্রতিটি বিষয় মানিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে চেয়েছিলেন। মানুষই তাঁর আগ্রহের একমাত্র বিষয়- মানুষের বস্তুজগৎ ও অন্তর্জগৎ।

সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার, সাহিত্যগোষ্ঠী- এমনকি নিজের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও স্পষ্টভাষিতা, অকপটতা, আপসহীনতা, দৃঢ় ব্যক্তিত্ব মানিককে বিশিষ্টতা দান করেছে। বস্তুত, তাঁর যে গভীর নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতা, তার কারণও তাঁর চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলো। শুধু তাই নয়, আদর্শ তাঁকে দরিদ্র করেছে, আক্ষরিক অর্থেই নিঃস্ব করেছে। কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হওয়ার কারণে প্রকাশক-সম্পাদকরা বিরূপ হয়েছেন, তিনি ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু আশীর্বাদস্বরূপ প্রকৃতি তাঁর সৃষ্টিতে ঢেলে দিয়েছে আদর্শের দাহ ও দীপ্তি, দান করেছে মহত্ব।

সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেই বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, ছিলেন বিজ্ঞানীও; কিন্তু বিজ্ঞান জানা বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বিজ্ঞান জানার পাশাপাশি যুক্তির আশ্রয় ছাড়া একজন মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারে না। মার্ক্সবাদই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিজ্ঞানমনস্ক করেছে। কারণ, মার্ক্সবাদের ভিত্তি হচ্ছে বিজ্ঞান ও যুক্তি। বিজ্ঞানমনস্কতাই তাঁকে সাহায্য করেছে, হৃদয় ও আবেগকে সরিয়ে নিরাবেগ, নির্মোহ ও নিরাসক্ত দৃষ্টিতে দেখতে। নিরাসক্ত দৃষ্টি ছাড়া সমাজ ও ব্যক্তির বিশ্নেষণ যথার্থ হয় না। মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষা, মার্ক্সীয় পঠন-পাঠন ও বিশ্নেষণ পদ্ধতি আর মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে তাড়িত করেছে সমাজকে, মানুষের জীবনকে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে দেখতে। বিনিময়ে আমরা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে কালজয়ী সব গল্প-উপন্যাস।

কেন লিখছি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন নিয়ে? 'মানুষের জন্য শিল্প'-এর মতো সাহিত্য সৃষ্টির লক্ষ্যও মানুষের কল্যাণ, এই পৃথিবীতেই মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন। এর জন্য আমাদের এই নষ্ট সময়ে দরকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মহান স্রষ্টার।

ড. এন এন তরুণ: ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ।

বেবী সাউ: রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক।

আরও পড়ুন

×