সংস্কৃতি
জাতীয় কবিতা উৎসব ও কিছু আক্ষেপ

আনিসুর রহমান
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৯:১৫
জাতীয় কবিতা পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কবি শামসুর রাহমান ১৯৮৯ সালে ঢাকার একটি খবরের কাগজে লিখেছিলেন- 'আমরা কয়েকজন জাতীয় কবিতা পরিষদ কার্যালয়ে জমিয়ে কথাবার্তা বলছিলাম। আমাদের আলাপ-আলোচনার মাঝখানে এসে হাজির হলেন আহমদ ছফা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি সিগারেট ধরালেন, তারপর ঘন ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে আমাদের আলোচনায় যোগ দিলেন। তিনি আমাদের অনেক কিছুই অনুমোদন করেন না, দূরে দূরে থাকেন; তবু তাঁকে আমরা আমাদের একজন বলেই গ্রহণ করেছি, যদিও আমাদের এই গ্রহণ করা আর না করার জন্য তাঁর বিশেষ কিছু যায় আসে না। তিনি আছেন তাঁর মতো, সবসময় আমি তাঁকে বুঝতেও পারি না।'
জাতীয় কবিতা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট কমবেশি প্রায় সবাই জানি। ১৯৮৭ সালে এশীয় কবিতা উৎসবের নামে স্বৈরাচারী এইচএম এরশাদের খায়েশে ধ্বজাধারী আমলা, মন্ত্রী, পাইক-পেয়াদা কিছু কবি-অকবি, আধা-কবির মেলবন্ধন ঘটেছিল। এই প্রহসন শামসুর রাহমানসহ কিছু তরুণ ও পরিণত বয়সের কবি মেনে নিতে পারেননি। প্রতিবাদ হিসেবে জন্মলাভ করল জাতীয় কবিতা পরিষদ। এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় চার দশক ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে জাতীয় কবিতা উৎসব।
শামসুর রাহমান ১৯৮৯ সালে ছিলেন ৬০ বছরের পরিণত মানুষ; রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা কবিতার জগতে আলোচিত নাম। আহমদ ছফার বয়স তখন ৪০-এর কোঠায়। তাঁর মধ্যে তারুণ্যের উদ্যম ও দ্রোহকে নেতিবাচকভাবে না নিয়ে শামসুর রাহমান তাঁকে আশ্রয় দিয়েছেন, ধারণ করেছেন। এমনকি পত্রিকায় লিখে স্বীকৃতি দিয়েছেন। লেখালেখির জগতে ধারণ করার শক্তি, মেধা ও প্রতিভা বড় বেশি দরকার। বিশেষ করে জাতীয় সংগঠনে তা আরও বেশি জরুরি। প্রতিষ্ঠার চার দশকে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়া কবিতা পরিষদ কি সেই 'গ্রহণ' এবং 'ধারণ'-এর ধারায় আছে?
শঙ্খ ঘোষ বলে গেছেন- 'এক দশকে সংঘ ভেঙে যায়'। এখানে সংঘ ভেঙে যাওয়া মানে সংগঠন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নয়। এর মানে, পরিণতরা নতুন সংঘকে জায়গা ছেড়ে দেবেন বা তারুণ্যকে স্বাগত জানাবেন। আজকে কবিতা পরিষদে কি নতুনদের জায়গা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে? কবিতা পরিষদ কিংবা উৎসবের আড়ালে তারুণ্যের বন্ধ্যত্বকাল পার করছি না তো আমরা?
এক দশকে যেমন কবিদের সংঘ ভেঙে যায়, ঠিক তেমনিভাবে কোনো কবিও দশকের পর দশক কবিসংঘের মোড়ল হয়ে থাকলে তাঁকে অকবি হওয়া থেকে ফেরাবে কে? জাতীয় কবিতা উৎসবের বাস্তবতাও এমন হয়েছে- দুই একজন 'শীর্ষস্থানীয় কবি' থাকেন মনোযোগ ও দৃষ্টির কেন্দ্রে। তরুণরা যেন তাঁদের মুরিদ মাত্র। অথচ লেখালেখির জগৎ হলো পুরোটাই পীরালি প্রথার বিপরীত। এখানে বহু পথ-মত, তর্ক-বিতর্ক ও বৈচিত্র্যময় প্রকাশের সমাবেশ ঘটবে।
উপনিবেশউত্তর দেশগুলোতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব আয়োজনের পেছনে প্রতিবাদী একটা প্রেক্ষাপট থাকে। যেমনটা ছিল আমাদের কবিতা উৎসবের পেছনে। তবে গূঢ় অর্থে সাহিত্যে উৎসবের মূল উদ্দেশ্য- লেখালেখি জগতের বৈচিত্র্যকে তুলে ধরা। পুরোনোদের পাশাপাশি নতুন নতুন কণ্ঠস্বরের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করা। শুধু দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে নয়; খোদ প্রাচ্যেই লেখালেখির জগৎ অনাদিকাল থেকে আড্ডানির্ভর এবং পরবর্তী সময়ে প্রকাশনা ও সাহিত্য সাময়িকীর সমৃদ্ধ ধারা যোগ হয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের লেখালেখির ধারা এখনও অনেকটা মৌখিক গল্প বলার মতো।
এটা ঠিক, পশ্চিমা দুনিয়ার সাহিত্য উৎসব অনেকটা বাণিজ্যনির্ভর; প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় এবং বিনোদন-ঘনিষ্ঠ। তবে জনকল্যাণধর্মী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে সাহিত্য উৎসব আয়োজনের মধ্যে কিছু রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার ব্যাপার থাকে। যার প্রতিফলন ঘটে স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় বাজেটের সব পর্যায়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য উল্লেখযোগ্য বাজেট বরাদ্দ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। বড় কথা, এতে এ ধরনের আয়োজনের প্রতিবাদী চরিত্র ঢাকা পড়ে যায় না।
বছর কয়েক আগে 'পেন ইন্টারন্যাশনাল' সংগঠনটির রেঙ্গুন কেন্দ্রের আমন্ত্রণে মিয়ানমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। দেশটিতে দীর্ঘ সামরিক জান্তার শাসন ও শোষণে দৃশ্যত লেখালেখি অঙ্গন কোণঠাসা হলেও অদৃশ্যে আমি দেখে এসেছি, তাদের লেখালেখির সৃজনশীল উদ্ভাবন ঈর্ষণীয় বটে। এখানে বড়মাপের উৎসব না থাকলেও গণমানুষের লেখালেখি বলতে যা বোঝায়, তার নাম রেঙ্গুন শহর। সন্ধ্যার পর পানশালা বা কফি হাউসে অনেকটা আড্ডার ঢঙে বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু পথ-মতের মানুষ নিজ নিজ লেখা কবিতা ও গল্প পড়ে শোনান। পড়া মানে মামুলি পাঠ নয়। ক্ষেত্রবিশেষে অনেকটা নাট্যশিল্পী বা কণ্ঠশিল্পীর মতো চমৎকার উপস্থাপনার প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। শহরটা নিরাপদ, ভয়হীন, উৎকণ্ঠাহীন, মোহনীয় এক দুনিয়া। পৃথিবীর আর কোনো দেশ বা নগরে এতটা মানবিক রঙিন রাতের চিত্র আমি দেখিনি।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে রেঙ্গুনে একেক মহল্লায় ঘরোয়াভাবে কবিতা ও গানের আসর বসে। এই নগরে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, শিক্ষক- সবার রয়েছে বলার মতো গল্প ও কাব্যরুচি। এক রোববার রেঙ্গুনে এক কবি বন্ধু, যিনি পেশায় ট্যাক্সিচালক আমাকে আর তাঁর এক বন্ধু কবিকে তাঁর ট্যাক্সিতে করে সারাদিন ঘুরিয়েছেন, কবিতা পড়ে শুনিয়েছেন। কবিতা ও মিয়ানমার সম্পর্কে অনেক গল্পও বলেছেন।
রেঙ্গুনে দেখা কবিতানুরাগী ভাই-বোনদের মাঝে খুব কম জনকেই পেয়েছি, যাঁদের কারাবন্দি হওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। এই বন্দিদশা তাঁদের উদ্যম দমাতে পারেনি। তাঁরা বরং আরও বেশি কবি হয়ে উঠেছেন। লেখালেখি উদযাপনের প্রিয় রেঙ্গুন এক অপূর্ব জনপদ; মুক্তির অপেক্ষায় থাকা কবিতার শহর। আনিসুর রহমান: বাঙালি-সুইডিশ কবি ও নাট্যকার; সুইডিশ লেখক সংঘের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য
- বিষয় :
- সংস্কৃতি
- আনিসুর রহমান
- জাতীয় কবিতা উৎসব