ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

রাশিয়া-ইউক্রেন

মিউনিখ সম্মেলনে ব্যাপকতর যুদ্ধের পূর্বাভাস

মিউনিখ সম্মেলনে ব্যাপকতর যুদ্ধের পূর্বাভাস

ইউয়ে পারপার্ট

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ২২:৩১

ডোনাল্ড ট্রাম্প- ২১ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সতর্ক করে দিয়েছেন এ বলে যে, 'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এখন যতটা কাছে মনে হচ্ছে, আগে কখনোই এমনটা মনে হয়নি'। তিনি এর জন্য দায়ী করেছেন সব যুদ্ধবাজ এবং সেসব বিশ্বায়নপন্থি আমেরিকানকে যাঁরা মনে করেন 'আমেরিকা লাস্ট'- অর্থাৎ যাদের কাছে আমেরিকার স্বার্থের চেয়ে আর সবার স্বার্থ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ; তাঁর মতে- সেসব আমেরিকান আছেন ছায়ারাষ্ট্রে, পেন্টাগনে, বিদেশ মন্ত্রকে এবং জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রতিরক্ষা শিল্প সমন্বয়ে গঠিত চক্রের মধ্যে। ওই টিভি অনুষ্ঠানটি ছিল আগামী বছর অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে প্রচারের অংশ।

ওই অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বিশেষত ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ডের নাম উল্লেখ করেছেন; যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ মন্ত্রকে উপসচিব হিসেবে রাজনৈতিক বিষয় দেখভাল করছেন। ট্রাম্পের মতে- ন্যুল্যান্ড 'ইউক্রেনকে ন্যাটোর দিকে ঠেলে দেওয়ার বিষয়ে বদ্ধপরিকর'।

সম্প্রতি (১৭-১৯ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠিত বার্ষিক মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের আগে এবং অধিবেশনগুলোতে উচ্চারিত মার্কিন ও ন্যাটো কর্মকর্তাদের বিভিন্ন কথাবার্তা খেয়াল করলে যে কারও খুব কমই সন্দেহ হবে যে ইউক্রেনে মার্কিন যুদ্ধের লক্ষ্য রাশিয়ায় সরকার পরিবর্তন এবং হয় রাশিয়ার স্পষ্ট পরাজয় নিশ্চিত করা, নয় এমন অবস্থা তৈরি করা যা রাশিয়ার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের সমতুল্য মনে হবে। পরিস্থিতি বোঝার জন্য আপাতত এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ১৮ ফেব্রুয়ারি মিউনিখের বিখ্যাত হোটেল ব্যারিষে হফে, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস কোনো রাখঢাক না রেখেই ঘোষণা দিলেন যে, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে বলতে চায় যে রাশিয়া মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছে'।


ঠিক কোন পদ্ধতিতে এবং কার দ্বারা এই অপরাধটি নির্ণন করা হয়েছে, তিনি অবশ্য বলেননি। মানবতাবিরোধী অপরাধ আলোচনার মাধ্যমে মোকাবিলা করা যায় না। এর জন্য 'যতদিন প্রয়োজন ততদিন' একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। এটা আমার নয়- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কথা; এ কথা বলে তিনি তখন অক্ষশক্তির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। রাশিয়াও অবশ্য বিষয়টি যথাযথ অর্থেই গ্রহণ করেছে।

প্রেসিডেন্ট পুতিন ২১ ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশে তাঁর বার্ষিক ভাষণে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ঘোষণা করেছেন যে, রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০১০ সালে সম্পাদিত নিউ স্টার্ট নামক পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি অবশিষ্টাংশ থেকেও নিজেকে প্রত্যাহার করবে; তিনি এটাও বলেছেন, ন্যাটো যেহেতু এখন তার বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে সেহেতু- ওই চুক্তি অনুসারে রাশিয়ার পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শন করা ন্যাটোর জন্য একটা অবাস্তব বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুতিন বক্তৃতায় রুশ রাষ্ট্রের অখণ্ডতা হুমকির মুখে পড়লে তার জবাবে কালবিলম্ব না করে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিও পুনর্ব্যক্ত করেন। সুতরাং, আমরা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছি তা বোঝা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কীভাবে আমরা এখানে পৌঁছলাম? ছোট করে হলেও এ গল্পটা বলা দরকার। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি, ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, রাশিয়া ইউক্রেনে একটি নতুন বড় আক্রমণ শুরু করেছে। এর আগে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এবং তাঁর কর্মকর্তারাও (কিছু আর পদে নেই, দুর্নীতির জন্য বহিস্কৃত) একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

১৪ ফেব্রুয়ারি, মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন বললেন যে, তিনি আশা করেন এ বসন্তে ইউক্রেন তার নিজস্ব আক্রমণ শুরু করবে। তবে অস্টিনের সঙ্গে একই সংবাদ সম্মেলনে, বলা বাহুল্য- সাংবাদিকদের বিস্মিত করে দিয়ে, মার্কিন প্রধান যুগ্ম চিফ অব স্টাফ জেনারেল মার্ক মিলি বলেন, 'সংক্ষেপে বললে বলতে হয়, রাশিয়া হেরে গেছে। তাদের এ হার হয়েছে রণনীতি, রণকৌশল ও মাঠের যুদ্ধে এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যন্ত চড়া মূল্য দিয়ে চলেছে।'

পরে একই প্রেস কনফারেন্সে তিনি রাশিয়া কী করতে পারে সে সম্পর্কে অনুমান করে বলেছিলেন, 'রাশিয়ান আক্রমণের বিষয়ে বলা যায়, এই আক্রমণ যা আপনি এই মুহূর্তে বাখমুত এলাকায় চলতে দেখছেন, আপনি জানেন, খারকিভ থেকে খেরসন পর্যন্ত পুরো যুদ্ধক্ষেত্রটি বেশ স্থিতিশীল আছে, যদিও খুব সহিংসতা ও লড়াই চলছে। এটি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল আছে।'

'এগোনো বা পেছানো বলতে যা চলছে তার বেশিরভাগই সাধারণত বাখমুতের আশপাশে। ইউক্রেনীয়রা ধরে রেখেছে ... আমি এটাকে খুবই কঠিন এক লড়াই হিসেবে তুলে ধরতে চাই, প্রচুর হতাহত হচ্ছে- বিশেষ করে রাশিয়ান পক্ষে। এখানে কোনো শৌখিন কৌশলের জায়গা নেই। এটি হলো একেবারে সম্মুখ যুদ্ধ, মুহুর্মুহু আক্রমণ চলছে, প্রচুর গোলবারুদ ব্যবহূত হচ্ছে সেই নির্দিষ্ট এলাকায়; হতাহতও হচ্ছে ব্যাপক।'

এ মূল্যায়নটি তার প্রথম মূল্যায়নের চেয়ে কিছুটা হলেও বাস্তবতার কাছাকাছি। তারপর, ১৬ ফেব্রুয়ারি, বিদেশ মন্ত্রকের ন্যুল্যান্ড বললেন যে, 'রাশিয়া ঘোষণা করেছে তারা একটি নতুন আক্রমণ শুরু করছে। ঠিক আছে, যদি তেমনটা হয় তবে এটি খুবই করুণ।' তিনি উল্লেখ করেছেন যে যুদ্ধটি পূর্বদিকেই 'মরণপণ' বলে মনে হচ্ছে, বাখমুত শহরের মতো এলাকাগুলোতে, যেখানে রাশিয়া হয় সামনের দিকে অল্প অল্প করে হলেও এগিয়ে যাচ্ছে নতুবা কোনো অঞ্চলই সে দখল করতে পারছে না।

এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিভ্রান্তিকর বা ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি তৈরির লক্ষ্যে দেওয়া বিবৃতিগুলোর একটি উদ্বেগজনক চিত্র। তাদের বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার মৌলিক স্তরগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে, ধরে নেওয়া যাক, এটি ইচ্ছাকৃত। তবে আপনি যেভাবেই এটি পড়ুন, মূল লাইনটি একই : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোর বেশিরভাগ দেশই এখন নিজেদের সম্পূর্ণ যুদ্ধ-সংঘাতের মধ্যে দেখছে এবং রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন বেশ স্পষ্ট করে এবং জোরের সঙ্গে বলেছেন যে তিনি এটি বুঝতে পেরেছেন।

জিম ডেভিস যেমনটা লিখেছেন, ইউক্রেনের বাস্তব পরিস্থিতি হলো, যুদ্ধ একটি অচলাবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে ইউক্রেন বা রাশিয়া কারোরই এই মুহূর্তে একটি নিষ্পত্তিমূলক আক্রমণ শুরু করার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি নেই। কিন্তু এ ধরনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির যুদ্ধে পরিস্থিতি শেষমেশ জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধতর রাশিয়ার পক্ষেই যেতে পারে।

জেনারেল মিলি তা ভালো করেই জানেন এবং এ জন্যই সমঝোতামূলক আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তাকে অবশ্যই প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও তার প্রভাবশালী আদর্শিক যোদ্ধাদের রাজনৈতিক প্রেসক্রিপশন মেনে চলতে হচ্ছে।

মিলি এবং সব বাস্তববাদী পর্যবেক্ষক জানেন যে, ইউক্রেনের প্রতি ব্যাপক সাহায্যের পাশাপাশি ন্যাটো সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলে জয় শেষমেশ রাশিয়ার পক্ষেই যাবে। রাশিয়াও এখন পোল্যান্ড ও পশ্চিম ইউক্রেন থেকে নেপর নদীর ওপারে এবং দোনবাস অঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর সরবরাহ লাইন কেটে দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে।

মার্কিন দূরপাল্লার আর্টিলারির সহায়তায় ইউক্রেনও কি আবারও কের্চ ব্রিজ ধ্বংস এবং দক্ষিণাঞ্চলের রঙ্গমঞ্চে রুশ সরবরাহ লাইন বন্ধে প্রচেষ্টা চালাবে? এটি হলে যুদ্ধের মেয়াদ ও তীব্রতা বৃদ্ধি অনিবার্য যদি না ওয়াশিংটনের বোধোদয় ঘটে এবং এ যুদ্ধে তার কৌশলগত প্রাপ্তি সম্পর্কে সে ঠান্ডামাথায় ভাবে; অবশ্য এটি আপাতত অনেক দূরের বিষয় বলেই মনে হচ্ছে।

ইউয়ে পারপার্ট: এশিয়া টাইমসের প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক; এশিয়া টাইমস ডটকম থেকে ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন

আরও পড়ুন

×