বুদ্ধপূর্ণিমা
অহিংসা ও উদারতার দর্শন

অসীম বরণ চৌধুরী
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৩ | ১৮:০০
আড়াই হাজার বছরেরও আগে এশিয়া মহাদেশের প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলের একটি রাজা শাসিত ঐতিহ্যবাহী বংশে এই দিনে জন্ম নেওয়া একটি শিশু পরবর্তী সময়ে কী করে তাঁর অর্জিত জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি, কঠোর তপস্যা, সহৃদয় বিবেচনা, অপার করুণাঘন প্রেম আর মৈত্রী দিয়ে সে সময়ের প্রচলিত ঈশ্বরবাদী ধর্মচেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে বিশ্বজগতে একটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এবং নতুন ভাবধারার মতবাদের সূচনা করেন, তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। মহাকালের পথপরিক্রমায় আজও বিশ্বের সব জাতি-গোষ্ঠীর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এই দিনটি মহাসমারোহে এবং ভাবগাম্ভীর্যে উদযাপন করে। এই পূর্ণিমা তিথির শুভদিনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক সিদ্ধার্থ গৌতম, যিনি পরবর্তী সময়ে ‘বুদ্ধ’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন– জন্মলাভ, বুদ্ধত্ব বা জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত এবং নির্বাণপ্রাপ্ত বা ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন বলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে দিবসটি উদযাপন করেন।
বুদ্ধ তাঁর প্রদর্শিত পথ এবং মুখনিঃসৃত বাণীর মধ্যে সবার প্রতি অহিংসা পোষণ, মৈত্রী লালন, সব জীবের সুখ-শান্তি কামনা ও দয়া প্রদর্শনের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। মানুষকে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে পরামর্শ দিয়েছেন। কেননা, তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন– কোনো কিছুতেই অতি চরম পন্থা অবলম্বন বা অতি নিষ্ক্রিয় ভাব গ্রহণ যথার্থ নয়। তিনিই প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন– হিংসা দিয়ে হিংসাকে জয় করা যায় না; বরং হিংসাকে জয় করতে হলে মৈত্রীই সর্বাগ্রে আবশ্যক। ঘৃণা ঘৃণারই জন্ম দেয়; ভালোবাসা নয়। আজ ঠিক এই সময়ে এক দল মানুষ আরেক দল মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার, খবরদারি, অবদমিত রাখা এবং তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে কত ধরন ও শ্রেণির সমস্যা সৃষ্টি করেছে, তা তো সবারই জানা।
বৌদ্ধ ধর্ম একটি অহিংস, উদার এবং সর্বজীবে দয়া প্রদর্শনকারী ধর্মমত বা দর্শন। জানামতে, গৌতমই প্রথম, যিনি পৃথিবীর সব মানুষ শুধু নয়; বরং সব জীব তথা পশু-পাখিকেও ভালোবাসার কথা বলেছেন। শুধু যারা তাঁর মত ও পথের অনুসারী তাদের জন্য নয়; বরং জাতি-ধর্ম, বর্ণ-গোত্র, স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে পৃথিবীর সব মানুষের জন্য তিনি মঙ্গল কামনা করেছেন। তিনি মানুষকে এবং মানুষের নিজের সত্তাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। নিজের সুখ-শান্তি, ভোগ-বিলাস ইত্যাদির মধ্যে যে এক ধরনের অশান্তি লুকিয়ে থাকে, সেটা তিনি সব সময় বিশ্বাস ও লালন করতেন। এ জন্য তিনি অন্য কিছুর মধ্যে সুখ- শান্তি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিষয় না খুঁজে নিজের মধ্যেই তা খুঁজতে বলেছেন।
গৌতম বুদ্ধ মানবজীবনের সময়কে অভিহিত করেছেন দুঃখময়, বেদনাক্লিষ্ট একটা সময় হিসেবে। তিনি বলেছেন, জগতে বারবার আসা বা জন্মগ্রহণ দুঃখকে বরণ করার শামিল। নির্বাণ লাভের মাধ্যমে জগতে বারবার আসার প্রক্রিয়া বন্ধ এবং পরিত্রাণের উপায় হিসেবে বলেছেন। বিষয়টা বুঝতে বেশ কষ্টসাধ্য এবং নির্বাণ অর্জনকে জটিল ও দুঃসাধ্য ব্যাপার মনে হতে পারে। তবে এটা মানুষের জন্য একেবারে অসাধ্যও নয়। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, শীল এবং একনিষ্ঠ ধ্যানের মাধ্যমে এই নির্বাণ সম্পর্কে একজন সম্যক ধারণা অর্জন করতে পারেন। সে জন্য গৌতম তাঁর উদ্ভাবিত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ নামে পদ্ধতির বিষয় তাঁর প্রচারিত ধর্মমতে উল্লেখ করেছেন।
বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে দেখতে পাই, মানুষ একে অন্যকে শাসন, শোষণ, অবদমন, আধিপত্য বিস্তার, বঞ্চিত করতে কত ধরনের কৌশলই না গ্রহণ করছে! ফলে নিরন্তর অশান্তি, রেষারেষি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ধর্মে-ধর্মে, জাতিতে-জাতিতে, ধনী-গরিবে লেগেই আছে। অন্যকে অশান্তিতে রেখে শান্তি আশা করা বাতুলতা মাত্র।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক; সকলের মধ্যে অহিংসা বিরাজ করুক।
অসীম বরণ চৌধুরী: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
- বিষয় :
- বুদ্ধপূর্ণিমা
- অসীম বরণ চৌধুরী