ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

প্রতিবেশী

মণিপুরের সহিংসতা ভূরাজনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে

মণিপুরের সহিংসতা ভূরাজনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে

সুশান্ত সিং

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৮ জুন ২০২৩ | ০৪:৫১

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মণিপুর এখনও জ্বলছে। রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী সন্ত্রাসীদের ওপর এর দায় দিয়েছেন, আপাতদৃষ্টিতে কুকি জাতিগোষ্ঠীর দিকেই আঙুল তুলেছেন তিনি। কিন্তু ভারতের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল অনিল চৌহান স্পষ্ট করেছেন যে, ‘মণিপুরের এই বিশেষ পরিস্থিতির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এটি মূলত দুটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ।’

চৌহানের এ মন্তব্য মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে মোদির আপাত উদাসীন মনোভাব সম্পর্কে প্রশ্ন উস্কে দেয়। যখন সহিংসতা শুরু হয়, প্রধানমন্ত্রী তখন কর্ণাটকে বিজেপির পক্ষে প্রচার করছিলেন (সেখানে ১০ মে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শাসক দল হেরে যায়)। কিন্তু তাঁর নীরবতা অব্যাহতই ছিল এবং তিনি জাপান, পাপুয়া নিউগিনি ও অস্ট্রেলিয়া সফরে ব্যস্ত ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার যাওয়ার কথা ছিল; তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনা বাতিল করার পরেও মোদি অস্ট্রেলিয়া যান। সেখানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে হিন্দু মন্দির ধ্বংসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন। অথচ মোদি মণিপুরে মৃত্যু নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেননি বা রাজ্যে খ্রিষ্টানদের গির্জা ধ্বংসের কথাও উল্লেখ করেননি।

মোদির মন্ত্রিসভার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সহিংসতা শুরু হওয়ার ২৭ দিন পরে মণিপুর সফর করেন, ত্রাণের প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর আগে সেখানে দুই দিনের সফরে যান ভারতের সেনাপ্রধান। সহিংসতা তখন আরও ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালে চীনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভয়াবহ এক সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে মণিপুরে বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। এখন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য মণিপুরে আবার সৈন্য পাঠানো হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্ভবত রাজ্যে স্বাভাবিক অবস্থার দ্রুত প্রত্যাবর্তনের আশা করছে, কিন্তু মোদি সরকারের কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া তা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

মণিপুরের সহিংসতাকে এখন পর্যন্ত একটি নিরাপত্তা সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, যার ফলস্বরূপ সেখানকার বিবদমান জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সেতু নির্মাণের বদলে বিভাজনকে আরও উস্কে দেওয়া হয়েছে। এই অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি ফেডারেল বাহিনী এবং রাজ্য পুলিশের মধ্যে উত্তাপ ছড়ানোর মতো ঘটনার জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে মেইতি সম্প্রদায় সেখানে সেনাবাহিনী এবং ফেডারেল বাহিনী মোতায়েনের প্রতিবাদ করছে। কুকিরা রাজ্য পুলিশকে অবিশ্বাস করে; কারণ নিজেদের অস্ত্রাগার লুট করতে কিছু লোককে পুলিশই উৎসাহিত করেছে বলে অভিযোগ আছে। সেই ঘটনা সহিংসতা আরও উস্কে দিয়েছে।

বিস্তৃত অঞ্চলে এ অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও রয়েছে। মিয়ানমারের চিন জনগোষ্ঠী এবং ভারতের মিজোরাম রাজ্যের মিজো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কুকিদের নৃতাত্ত্বিক মিল আছে। সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে শত শত কুকি মিয়ানমারে পালিয়ে গেছে। কুকিদের প্রতি অন্যায় আচরণে প্রতিবেশী রাজ্য মিজোরামেও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। এ রাজ্যটি ১৯৮৬ সালে মিজো-নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। নাগাল্যান্ড রাজ্যে নাগাদের বিদ্রোহেও তাদের জাতিগত কুকি ভাইদের সহানুভূতি আছে। এটা বিশ্বের চলমান দীর্ঘতম বিদ্রোহগুলোর মধ্যে একটি। সেখানে নাগা জনগণ তাদের নিজস্ব পতাকা ও সংবিধান দাবি করেছে।

যদি মণিপুরে পূর্ণাঙ্গ বিদ্রোহ ফিরে আসে, এর প্রভাব যদি প্রতিবেশী রাজ্য মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং আসামে পড়ে, তাহলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সেখানে পর্যাপ্ত সেনা মোতায়েন করতে হবে। তা হলে সেটা অরুণাচল সীমান্তে চীনের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অবস্থানকে কমজোরি করে দেবে। ওদিকে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি ২০২১ সাল থেকে সেখানে শক্ত অবস্থান নিয়ে আছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী মণিপুরকে শান্ত করতে যত বেশি সময় নেবে, তারা ভারত সীমান্তে তত বেশি দুর্বল থাকবে। ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত অবকাঠামোগত ব্যাপক ফারাক রয়েছে।

২০১৫ সালে, মোদি তথাকথিত ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ তথা পূর্বদিকে সক্রিয় হওয়ার নীতি ঘোষণা করেছিলেন। এটা বাণিজ্য, সংস্কৃতি, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ এবং ভৌত অবকাঠামোর মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে কাছের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার ওপর জোর দেয়। কিন্তু অবকাঠামোগত অগ্রগতি সে অনুসারে হয়নি বললেই চলে; বিলম্বিত কিছু প্রকল্প শুধু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সচল হয়েছে। যদি মণিপুরে সহিংসতা রাজ্যের সীমানার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে, তবে এটি অ্যাক্ট ইস্ট নীতিকে আরও ব্যাহত করবে। মনে রাখতে হবে, পরোক্ষভাবে নীতিটি মার্কিন ইন্দো প্যাসিফিক কৌশলের সঙ্গে জড়িত– যা কোয়াড নামক চতুর্ভুজ নিরাপত্তা সংলাপের আদলে কার্যকর হচ্ছে। ফলে এই সংযোগ প্রকল্পগুলো স্থবির হয়ে পড়লে ইন্দো প্যাসিফিক কৌশলের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিও থাকে।

ভারতের উত্তর-পূর্বের নাজুক শান্তি এখন বারুদভর্তি বাক্সের ওপরে বসে আছে বলে মনে হচ্ছে। মণিপুরের সহিংসতা এতে ভয়ংকর স্ফুলিঙ্গ জোগাতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। অতএব ইস্যুটি মোদির সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দাবি করে। বিজেপির রাজ্য সরকার নিঃসন্দেহে মণিপুরের অধিকাংশ মানুষের আস্থা হারিয়েছে। রাজ্য নেতৃত্বের পরিবর্তন বা রাজ্যকে প্রত্যক্ষ ফেডারেল প্রশাসনের অধীনে আনার পদক্ষেপ বিদ্যমান বাস্তবতা মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে। নয়াদিল্লির উচিত ফেডারেল বাহিনী এবং সেনাবাহিনীকে মণিপুর থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রুটিন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলো পুনঃস্থাপন করা।

মোদি যদি দ্রুত মণিপুরে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে না পারেন, তাহলে সীমান্তে চীনের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জের ঝুঁকি আরও বাড়বে এবং কোয়াডের প্রচেষ্টাও দুর্বলতায় নিপতিত হবে। মণিপুরের মতো প্রত্যন্ত রাজ্যে সহিংসতা ও সংঘর্ষ কোনো সাধারণ নিরাপত্তা সমস্যা নয়। এই ঘটনাবলি দক্ষিণ এশিয়া এবং বিস্তৃত ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূরাজনীতিতেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।

সুশান্ত সিং: ভারতের সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের ঊর্ধ্বতন ফেলো; ফরেন পলিসি থেকে ভাষান্তর করেছেন সাইফুর রহমান তপন

আরও পড়ুন

×