বিএনপি সহিংসতার রাজনীতি করেনি, করবেও না

ড. আব্দুল মঈন খান
এহ্সান মাহমুদ ও ফারুক ওয়াসিফ
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৩ | ০৭:৫২
বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের এক দফা দাবিতে ২৭ জুলাই রাজধানীতে মহাসমাবেশ ডেকেছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। একই দিনে শান্তি সমাবেশ আহ্বান করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এই পরিপ্রেক্ষিতে উভয় দলের শীর্ষ দু’জন নেতার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কী হবে ২৭ জুলাই? সংঘাত এড়িয়ে সমাধানের কোনো পথ খোলা রয়েছে কিনা? সাক্ষাৎকার দুটি নিয়েছেন এহ্সান মাহমুদ ও ফারুক ওয়াসিফ
সমকাল: ২৭ জুলাইয়ের বিএনপি ঘোষিত মহাসমাবেশ ঘিরে রাজনীতির ময়দানে উত্তাপ দেখা যাচ্ছে। বিপরীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়ে সমাবেশ ডেকেছে। বিএনপি আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে, বলা যায় কিনা? এই পর্যায়ে তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো কিনা– বিশেষ করে, সামনে আগস্ট মাসব্যাপী যেহেতু আওয়ামী লীগের কর্মসূচি থাকবে?
আব্দুল মঈন খান: বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি গত প্রায় ১৫ বছর ধরে চলছে, সেখানে বিএনপির এই পর্যায়ের কর্মসূচিকে তাড়াহুড়া বলা যাবে না। ইতোমধ্যে অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে একটি সরকার সব গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে বিসর্জন দিয়েছে। গায়ের জোরে, পুলিশ ব্যবহার করে, বন্দুকের জোরে একটি জাতিকে পদানত করে রেখেছে। কোন জাতি? যে জাতি আজ থেকে ৫০ বছরেরও আগে একটি প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যে বাংলাদেশের জন্য এই দেশের লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিল, সেই বাংলাদেশ আজকে কোথায় দাঁড়িয়েছে! এই দেশের মানুষ একাত্তরে উপলব্ধি করেছিল– বাংলাদেশের জন্ম অপরিহার্য। পাকিস্তানের অবকাঠামোর মধ্যে নাগরিকের অধিকার বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। সেখানে গণতন্ত্র বলতে কিছু থাকবে না। সেই সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বা কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করছিল। পূর্ব বাংলার সোনালি আঁশখ্যাত পাট থেকে আয় করা অর্থ চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। আমাদের বঞ্চিত করা হতো। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পর আমরা সেই চিত্র কেন এখনও দেখছি? স্বাধীনতার যে মূলকথা, গণতন্ত্র– সেটি আজকের বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক দলটি নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে দাবি করে আসছে, তারাই তো স্বাধীনতার চেতনা ও আদর্শ পরিপন্থি কাজ করে চলেছে। স্বাধীনতার আদর্শের বিপক্ষে এই অর্থে বলছি, যে কারণে স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছিল, তারা তার বিপক্ষে কাজ করছে। তারা এই দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। তারা এই দেশের মানুষের ভোটের অধিকারকে ধ্বংস করছে।
সমকাল: বিএনপি তার আন্দোলনকে বলছে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই। এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আব্দুল মঈন খান: আমি এই কথাটি স্পষ্ট করে বলতে চাই– এই সরকার দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছে; স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের মানুষের যে স্বাধীনচেতা মনোভাব, সেটিকেও তারা ধ্বংস করেছে। এই দেশের মানুষের টুঁটি চেপে ধরে গুটিকয় স্বার্থবাদী ও অর্থলিপ্সু মানুষের ইচ্ছা পূরণ করে চলেছে। সেই অবস্থান থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই। এই অবস্থার পরিবর্তন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে– এই কারণে আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম করছি না। আমরা এই অবস্থার পরিবর্তন চাই। আমরা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্দোলন করছি। এই দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনব; এই দেশের দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে। এ জন্য আমরা আন্দোলন করছি।
সমকাল: গত বছরের মধ্য জুলাই থেকে প্রায় টানা কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি মাঠে আছে। এই সময়ে যেটি লক্ষণীয়, বাংলাদেশের অতীতের রাজনৈতিক কর্মসূচি যেমন হরতাল-অবরোধ; এসব দেখা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমেরিকার মতো বড় রাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো শক্তিশালী বৃহৎ জোট বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে যেভাবে সক্রিয় হচ্ছে, এটা কি তার কোনো প্রভাব?
আব্দুল মঈন খান: বিএনপি কখনোই সহিংসতার রাজনীতি করেনি। সরকার ও ক্ষমতাসীনরা বিভিন্ন সময়ে অপবাদ দিয়েছে। বিএনপির আন্দোলন নিয়ে অতীতে যা আমরা শুনেছি, সেটাকে অপবাদই বলব। সত্যিটা যদি বের হয়ে আসে, তখন সবাই জানতে পারবে। গণতন্ত্র নিজেই যেহেতু একটি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া, তাই গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার যে প্রক্রিয়া, সেটিকেও আমরা শান্তিপূর্ণ রাখতে চাই। বিএনপি কখনও লগি-বৈঠার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। এই দেশে সহিংসতার রাজনীতি করেছে আওয়ামী লীগ। আপনারা নিশ্চয় দেখেছেন, সাপ কীভাবে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়। আওয়ামী লীগ একইভাবে মানুষ পিটিয়ে মেরেছে। দেশবাসী তা দেখেছে।
সমকাল: বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে– ২০১৪-১৫ আমলে আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও করেছে। সেই বিষয়ে কী বক্তব্য আপনার?
আব্দুল মঈন খান: ২০২৩ সালে এসে ২০১৪ সালে কী ঘটেছিল, সেটি নিয়ে আলাপ কোনো কাজের বিষয় হতে পারে বলে মনে করছি না। তবে যেহেতু প্রশ্ন তোলা হলো, তাই বলছি, সেই সময়ে পর্দার অন্তরালে থেকে কারা গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল, তা এখন দেশবাসী এবং বিশ্ববাসী জেনেছে। বাংলাদেশ আফগানিস্তান হয়ে যাবে– এ ধরনের জুজুর ভয় বহু দেখানো হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। এসবই ছিল তাদের ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদি করার কৌশল মাত্র। বাংলাদেশে বর্তমান সরকার যা করছে, তা সারাবিশ্ব দেখছে। বিদেশিরা আজ প্রকাশ্যে বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা, গণতন্ত্রের অপমৃত্যু, মানবাধিকারের অবক্ষয়– এসব বিষয়ে কথা বলছেন। আজকে কেন আমেরিকা কিংবা যুক্তরাজ্যের, ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ নিয়ে এত কথা বলছেন? তারা এই দেশে আসছেন, এখানে থাকছেন, এখানকার বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছেন। যারা এখানকার মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, দিনের ভোট রাতে করেছে, ভোটের ফলাফল বদলে দিয়েছে; তাদের নিয়ে এখন সারাবিশ্বই কথা বলছে। এই রাজনৈতিক দলটি সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন নিয়ে নিয়েছিল। এখন তারা যতই গণতন্ত্রের কথা বলুক, তা মানুষ আর বিশ্বাস করবে না। আজকে একটি বিষয় বুঝতে হবে, এখন আর কোনো দেশই বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। আমরা সবাই একটি গ্লোবাল ভিলেজের অংশ। তাই বাংলাদেশে যদি কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেটিতে ভুক্তভোগী কেবল বাংলাদেশই হবে না, আরও অনেকেই হবে। সরকার বড়াই করে বলে থাকে, তারা এত এত উন্নয়ন করেছে। কিন্তু আমি যদি এখন পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলি, সরকার তো বিদেশ থেকে লোন এনেছে, অনুদান এনেছে। তাহলে যে দেশের অর্থে এসব হলো, এখন সে দেশের জনগণ বা প্রতিনিধিরা যদি বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, সেটি কীভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো হয়? যদি তারা উন্নয়নে সহায়তা করতে পারেন, তবে এখানকার পরিস্থিতি নিয়েও কেন কথা বলতে পারবেন না! এখন একটিই কথা– এই সরকারকে অবশ্যই সরে যেতে হবে। এই দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হলে অবশ্যই সরকারকে ক্ষমতা থেকে চলে যেতে হবে।
সমকাল: বিএনপি এক দফা দিয়েছে– বর্তমান সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ। আবার আওয়ামী লীগ বলছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। দু’দলের এই অনড় অবস্থানে আলোচনা কিংবা সংলাপের আর কোনো সুযোগ আছে কিনা?
আব্দুল মঈন খান: একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আলোচনা বা সংলাপ হতে পারে বা হবে। সংলাপের মধ্য দিয়ে দুটি পক্ষ একটি মতে পৌঁছাতে পারে। তবে সেখানে একটি বড় প্রশ্ন রয়েছে। সেটির উত্তরের জন্য আমি পেছনের দিকে; ২০১৮ সালের দিকে তাকাতে চাই। তখন আমরা এই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে সংলাপে বসেছিলাম। সেখানে আমিও ছিলাম। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন– সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। তিনি বলেছিলেন, আপনারা আসুন। আমরা একটি ভালো নির্বাচন করব, আপনারা দেখুন। আমরা তাঁর কথায় বিশ্বাস করেছিলাম। আমরা সেই সময় সরকারপ্রধানকে বলেছিলাম, আমাদের দলের ৪৫ লক্ষাধিক নেতাকর্মীর নামে মামলা রয়েছে। তখন সরকারপ্রধান বলেছিলেন, আপনারা মামলার তালিকা দিন। আমাদের দলের মহাসচিব বস্তা ভরে তালিকা দিয়েছিলেন। তার পর আমরা কী দেখেছি? একটি মামলাও প্রত্যাহার হয়েছিল– এটা কি কেউ আজকে বলতে পারবে? সম্ভবত পৃথিবীতে এমন দ্বিতীয় কোনো মামলার নজির আর নেই। এখন দেখা যাচ্ছে, সংলাপের টেবিলে মুখে এক কথা বলা হচ্ছে, বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। যারা দিনের ভোট রাতে করে ফেলছে, তখন সেই দলটির প্রতি আর কোনো রাজনৈতিক দলের বা দেশের মানুষের আস্থা বা বিশ্বাস থাকে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সংলাপ অর্থহীন। বিশ্বাস না থাকলে সংলাপ কাজে আসে না।
সমকাল: দেশবাসীর প্রতি আপনার কোনো বার্তা...
আব্দুল মঈন খান: আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একটি কথা বলেছিলেন– ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।’ আমি আরেকজনের নাম উল্লেখ করতে চাই– চীনের মাও সে তুং। তিনি বলেছিলেন, ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস।’ জিয়াউর রহমান একজন সৈনিক হয়েও বুঝেছিলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণই আসল ক্ষমতার মালিক। বিএনপি এখনও সেই জনগণের ওপরেই বিশ্বাস রাখতে চায়।
সমকাল: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আব্দুল মঈন খান: সমকালকেও ধন্যবাদ।