ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

স্মরণ

একজন বিনয়ী মানবিক মানুষের প্রতিচ্ছবি

একজন বিনয়ী মানবিক মানুষের প্রতিচ্ছবি

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২১ | ১৪:২৬

স্মৃতি রোমন্থন। মূলত একজন শ্রদ্ধেয় মানুষকে নিয়ে। যে মানুষটি এখন আর আমাদের মাঝে নেই। মানুষটির কর্ম-ভাবনা স্মরণ করতে গিয়ে বিচারিক অঙ্গনে আমার ভ্রমণ পর্বের শুরুর অনেক কথা সামনে আসছে। সেই সব দিনের কথা এখনও বিস্মৃত হইনি। বিগত দিনের পথচলা থেকেই বুঝতে পারি জীবন পথে চলতে গিয়ে কী গ্রহণ করতে হবে, কী পরিহার করতে হবে এবং কোন বিষয়টি অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, বিশুদ্ধ প্রবৃত্তি নিয়ে চলতে গেলে নিজ কর্ম ও আচরণ দিয়ে অন্যের হৃদয় জয় করতে হবে। সেই রকম এক জয়ী মানবিক প্রাজ্ঞ মানুষের কথাই আজ বলছি।

মনে আছে, ১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হই। নিয়মিতভাবে হাইকোর্টে আসা শুরু করি ১৯৮৯ সালের শেষ থেকে। কিছুদিন একা একা হাইকোর্টের বারান্দায় ঘোরাফেরা। কিছুদিনের জন্য ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম সাহেবের চেম্বার। এরপর জনাব আব্দুল ওয়াহ্‌হাব মিয়ার (পরবর্তী সময়ে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি) চেম্বারে যোগ দিই। সেখানে বেশ কিছুদিন কর্মে যুক্ত থাকার পর ১৯৯৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পাই। বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীসহ আমরা ৯ জন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ওই দিন অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে যোগ দিই। তখন অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন কেএস নবী। ১৯৯৮ সালে নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে যোগ দেন বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ প্রাজ্ঞ সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলাম। এর কিছুদিনের মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে যোগ দেন মাহবুবে আলম। মাহবুবে আলমকে নিয়েই আমার আজকের লেখা।

মাহবুবে আলমের সঙ্গে আমার পারিচয় হয় ১৯৯০ সালের দিকে। সে সময় দেখেছি এসআর পাল, এমএইচ খন্দকার, টিএইচ খান, খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমদ, ড. কামাল হোসেন, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ, সিরাজুল হক, আব্দুল মালেক, আমিরুল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রমুখ প্রাজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবীদের পদচারণায় সুপ্রিম কোর্ট মুখর থাকত। আইন পেশার প্রসারের দিক থেকে তাদের পাশাপাশি বা কাছাকাছি অবস্থানে যাদের নাম ছিল তাদের মধ্যে রোকন উদ্দীন মাহমুদ, হাসান আরিফ, মাহবুবে আলম, আব্দুল বাসেত মজুমদার, আব্দুল ওয়াহ্‌হাব মিয়া, এস কে সিনহা, এ জে মোহাম্মদ আলী, ফিদা এম. কামালের নাম উল্লেখযোগ্য।

মাহবুবে আলম ছিলেন ফজলুল করিম ও খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদের জুনিয়র। এই দু'জন প্রথিতযশা আইনজীবীর সঙ্গেই কাজ করেছেন মাহবুবে আলম। মাহমুদুল ইসলাম অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে যোগ দেওয়ার পর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের পদটি খালি হয়ে যায়। মাহমুদুল ইসলামের অভিপ্রায়েই অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে যোগ দেন মাহবুবে আলম, ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে। ২০০০ সালের মাঝামাঝি আমি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে উন্নীত হই। বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী এ দু'জন বিচারপতিও মাহমুদুল ইসলাম ও মাহবুবে আলমের সঙ্গে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাননীয় বিচারপতিদ্বয় হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। আমরা বেশ কয়েকজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ২০০১ সালের অক্টোবরে সরকার পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করি। আমাদের পদত্যাগের সপ্তাহখানেক আগে মাহবুবে আলমও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে কাজ করার সময় মাহবুবে আলমের সঙ্গে তার জুনিয়র কলিগ হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে আমার অনেক স্মৃতি। তার সংস্পর্শে আসাটা ছিল আমার জন্য এক বিরল সুযোগ ও সৌভাগ্যের। অসম্ভব ধৈর্যশীল বিনয়ী একজন মানুষ। আইন বিষয়ে তার দক্ষতা এবং জুনিয়রদের শেখানোর যে আগ্রহ তার মাঝে দেখেছি, তা সত্যিই বিরল ও প্রশংসনীয়। আমার সিনিয়র আব্দুল ওয়াহ্‌হাব মিয়ার কাছে উচ্চতর আদালতের প্র্যাকটিসের অ আ ক খ শেখার পর তিনি যখন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হয়ে যান, তখন সিনিয়র হিসেবে যে মানুষটির দ্বার ছিল আমার জন্য অবারিত, তিনি মাহবুবে আলম। তবে এ কথা সত্য, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে আমরা মাহমুদুল ইসলাম সাহেবের অভিভাবকত্বে যারা কাজ করতে পেরেছি, আমরা প্রত্যেকেই তার প্রতি কৃতজ্ঞ। যেভাবে তিনি আমাদের কাজ করার ও শেখার সুযোগ করে দিতেন, তার তুলনা হয় না। একটি মামলার জবাব বা আবেদনপত্র বা এফিডেভিট ইন অপজিশন ড্রাফট করার পর মাহমুদুল ইসলাম বা মাহবুবে আলম দেখে যদি বলতেন, 'খারাপ হয়নি ভালোই হয়েছে' তখন আমার ও আমার মতো যারা ওই অফিসে একসঙ্গে কাজ করতাম, সবারই আত্মবিশ্বাসের স্থানটি আরও দৃঢ় হতো বৈকি।

মানুষ হিসেবে মাহবুবে আলম ছিলেন অত্যন্ত প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিমনা। তিনি ছিলেন মানবিক। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শানিত মাহবুবে আলম তরুণ আইনজীবীদের একজন অভিভাবক ছিলেন। প্রয়াত আইনজীবী ব্যারিস্টার শওকত আলী খান বলতেন, আমরা যারা উচ্চ আদালতে আইন পেশায় জড়িত, তাদের মধ্যে যে পেশাগত প্রতিযোগিতা সব সময়ই থাকা উচিত সেটি হলো, আমরা কে কত নম্র ও বিনয়ী হতে পারি তার প্রতিযোগিতা। কোর্টে মামলায় হেরে গেলেও আমরা বলি Much Obliged My Lord-এটাই এই আদালতের প্র্যাকটিস। শিষ্টাচার শেখার ও অনুশীলনের স্থান হলো উচ্চতর আদালত। মাহবুবে আলম ছিলেন একজন বিনয়ী, নম্র ভদ্রলোক। আদালতের ভেতরে কেউ তার প্রতি রুঢ় আচরণ করলে বা বক্র কথা বললেও তিনি তার পাল্টা জবাব দিতেন না। নীরব থাকতেন। তিনি ছিলেন সবার প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন। ব্যারিস্টার শওকত আলী খান তাই তাকে সম্বোধন করতেন 'বিশ্ব প্রিয়' বলে।

কলাবাগানের হাজি বশির উদ্দীন রোডের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন মাহবুবে আলম। ওই বাড়ির তিনতলায় এক সময় বাসা ভাড়া নেন আমার বন্ধু এম. ইনায়েতুর রহিম। আমি মাস দুই-এক ওই বাড়িতে ইনায়েতুর রহিমের সঙ্গে ছিলাম। প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তে মাহবুবে আলম স্যারের বাসায় গল্প-গুজবের আসর বসত। আমরা নিয়মিতই সেই আসরে অংশ নিতাম। বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার, বিচারপতি মিফতাহ্‌ উদ্দীন চৌধুরী, বর্তমান রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, বর্তমান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী প্রমুখ নিয়মিতই মাহবুবে আলমের বাসার আসরে আসতেন। তখন আমরা সবাই আইনজীবী। গল্প-গুজব, গান-বাজনা শেষে রাতের খাবার খেয়ে আমরা যার যার বাসায় ফিরতাম। বন্ধু আমিন উদ্দিন মাঝেমধ্যে সেখানে থেকে যেতেন। কারণ সকালে হয়তো সিনিয়রের সঙ্গে কোনো মামলার শুনানি বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে সেজন্য। তখন এ এম আমিন উদ্দিন ছিলেন মাহবুবে আলমের চেম্বার জুনিয়র।

আজ এত বছর পরে এসবই শুধু স্মৃতি। তবে ভুলে যাইনি ওই সব দিনের কথা। ২০০১ সালে আমরা যখন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে বারে ফিরে আসি, তখন কঠিন কোনো মামলা পেলে বোঝার জন্য ছুটে যেতাম মাহবুবে আলমের কাছে। কখনও কখনওবা মাহমুদুল ইসলামের কাছে। সিনিয়র আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী তখন জুনিয়র হিসেবে মাহমুদুল ইসলামের সঙ্গে কাজ করতেন। এভাবে দিন যেতে থাকে। এক সময় ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে মাহবুবে আলম বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এর অল্প কিছুদিন পরই এম. ইনায়েতুর রহিম অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ওই অফিসে যোগদান করেন। মাহবুবে আলম ও এম. ইনায়েতুর রহিম একসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

২০০৯ সালের ৩০ জুন আমি ও ইনায়েতুর রহিম উভয়ই হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে শপথ নিই। আমরা মোট ৯ জন তখন অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাই। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে সম্ভবত তিনি প্রথম আমাদেরই Felicitate করেন বা সম্ভাষণ জানান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারক হিসেবে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তিনি আমাকে উৎসাহিত করেন। যুদ্ধাপরাধীদের মামলায় তিনি ট্রাইব্যুনালে (ট্রাইব্যুনাল-২) অনেকবার বক্তব্য রেখেছেন। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক থাকাকালে মাহবুবে আলম অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আমার আদালতেও শুনানিতে অংশগ্রহণ করেছেন। শুনানি শেষে মামলার এক পক্ষ জেতে আরেক পক্ষ হারে এটাই স্বাভাবিক। তবে প্রজ্ঞাবান আইনজীবীরা যখন কোনো মামলার শুনানিতে অংশ নেন তখন বিচারকরা আইনজীবীদের সাবমিশন থেকে অনেক কিছুই শেখার সুযোগ পান। এটা আমার একেবারেই নিজস্ব ধারণা। আমি আদালত কক্ষে ভালো আইনজীবীদের সাবমিশন থেকে প্রতিনিয়তই শেখার চেষ্টা করি। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক হিসেবে ২ সেপ্টেম্বর ২০২০ সর্বশেষ যে মামলাটি আমি শুনি সেটিতে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে মাহবুবে আলম অংশগ্রহণ করেছিলেন সশরীরে। সেটি ছিল ক্ষমতাসীন দলের একজন সংসদ সদস্যের একটি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষে অবস্থান। রাষ্ট্রের স্বার্থে মাহবুবে আলম তার বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি কখনও দেখতেন না মামলার পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কেউ সরকারি বা বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা বা কারও ব্যক্তিগত স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কিনা। একটি বিষয়ে তিনি সদা সর্বদা শক্ত অবস্থানে থাকতেন। সেটি হলো, রাষ্ট্রের স্বার্থ যে কোনো মূল্যে রক্ষা করা।

পদাধিকার বলে অ্যাটর্নি জেনারেল বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। একবার বার কাউন্সিলের এনরোলমেন্ট পরীক্ষায় তার কন্যা অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হয়। তিনি কাউকে কিছু বলেননি। অকৃতকার্য ছাত্রছাত্রীদের গ্রেস মার্কস দেওয়ার জন্য অনেকের পক্ষ থেকেই পীড়াপীড়ি শুরু হয়। মাহবুবে আলম কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। যে পরিমাণ নম্বর দিলে তার কন্যা পাস করবে তা তিনি দিতে দেননি। তবে কাউকে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তার সিদ্ধান্তের অনড়তার পশ্চাতের কারণটি বলেননি অনেক দিন। অর্থাৎ নৈতিকতা ও নীতির প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন ও অটল। সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি অনেকের বিরাগভাজন হয়েছেন। তাকে বহুবার হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। পাঠানো হয়েছে প্রতীকী কাফনের কাপড়। এ কারণে কর্তব্য-কাজে অবহেলার কোনো লেশমাত্র চিহ্ন ছিল না তার মধ্যে। ছিল না কোনো ভীতি।

মাহবুবে আলম ও আমরা বেশ কয়েকজন বিচারপতি একই ভবনে বাস করতাম। কিন্তু তিনি কখনও আমাদের কারও সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমার ব্যাপারে সামান্যতম আলোচনাও করতেন না। আমরা বিচারপতিরা এখনও একত্রেই একই ভবনে রয়েছি। শুধু তিনিই চলে গেলেন। বাসাটি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। তার বাসায় মাঝেমধ্যে সংগীতের আসর হতো। আমাদের সবাইকে তিনি দাওয়াত করতেন। তার বাসার দেয়ালগুলো পেইন্টিংয়ে ঠাসা। ভাবির আঁকার অভ্যাস আছে। বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত বিরল কিছু পেইন্টিং দেখেছি তার বাসার দেয়ালে।

২ সেপ্টেম্বর ২০২০ দুপুরে কোর্ট থেকে নেমেই জানতে পারি আমি আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি। মাননীয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরি। বিকেলে মাহবুবে আলম আমাকে ফোন করে উচ্ছ্বসিতভাবে অভিনন্দন শব্দটি তিনবার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে আমাকে অভিনন্দিত করেন। ৩ সেপ্টেম্বর আমি ও তারিকুল হাকিম উভয়ে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে শপথ নিই। শুনলাম ৬ সেপ্টেম্বর ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আমাদের ফেলিসিটেশন দেওয়া হবে। ওই দিন বিকেলেই শুনি মাহবুবে আলম সাহেব অসুস্থ। সম্ভবত ওই দিন রাতে বা পরের দিন সকালে তাকে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। খবর এলো তিনি করোনায় আক্রান্ত। ফোনে তার সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন একটু সামান্য জ্বর ছিল তবে এখন নেই। সামান্য কাশি আছে। একটু সংকোচ নিয়েই জিজ্ঞেস করি, ফেলিসিটেশনে কি কোনো অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল থাকবেন? তিনি বললেন না, তিনি নিজেই থাকবেন। কীভাবে? জিজ্ঞেস করে জানলাম তিনি সিএমএইচের কেবিনে পোশাক ও ল্যাপটপ নিয়ে গেছেন। সেখানকার লোকদের দিয়ে জুমের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে ৬ তারিখে তিনি আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দিত করেন।

আমার উদ্দেশে দেওয়া তার অভিনন্দন ভাষণটি ছিল প্রায় ২২ মিনিটের। তিনি আমার উদ্দেশে অনেক কথা বলেছিলেন। হয়তোবা আমি এসবের যোগ্যও নই। এ ছিল আমার প্রতি তার ব্যক্তিগত ভালোবাসা ও স্নেহের বহিঃপ্রকাশ। আর বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা নিঃসৃত উচ্চারণ, যা ছিল আমার জন্য প্রেরণা ও সাহস। আমি সন্ধ্যায় ফোনে তাকে ধন্যবাদ জানাই তার বক্তব্যের জন্য। তিনি প্রতি উত্তরে যা বলেছিলেন আমি সে কথাগুলো আর লিখতে পারছি না ...। তিনি দোয়া চাইলেন, আমার কণ্ঠ বাকরুদ্ধ হয়ে আসছিল। খুব বেশি কিছু আর বলিনি। শুধু বলেছিলাম, স্যার, ইনশাআল্লাহ আপনি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে আবারও ফিরে আসবেন।

ব্যক্তি জীবনে মানবিক মাহবুবে আলম কত মানুষকে যে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তিনি নীরবে মানুষের দুঃসময়ে পাশে থেকেছেন। সমাজে বঞ্চিত কত মানুষ রয়েছে। আল্লাহ চান সক্ষম ব্যক্তিরা তাদের পাশে থাকুক। শেষ নিবাস মাটির ঘরে শূন্য হাতেই যেতে হবে। কোনো বৈভব সঙ্গে যাবে না। সুযোগটা তাই এ কালেই। মাহবুবে আলম এটি বিশ্বাস করতেন তার কর্মে ও ধ্যানে। ইসলাম ধর্মে যেভাবে নীরবে-গোপনে দানের কথা বলা আছে, মাহবুবে আলম দান করতেন সেভাবে। কেউ জানত না। বেশ অনেক পরে উপকারভোগীদের কাছ থেকে জানা যেত তিনি কাকে কীভাবে সাহায্য করেছেন। তার ইহকালের এই নীরব পুণ্য কর্মই ওই কালে তাকে ছায়া দেবে। মাহবুবে আলমের পিতা খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। মাহবুবে আলমও হজব্রত পালন করেছেন দু'বার। তিনি স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা ও তিন নাতি-নাতনি রেখে গেছেন।

মাহবুবে আলমের মতো ন্যায়পরায়ণ, নম্র ও বিনয়ী মানুষের আজ বড়ই অভাব। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে তার মতো আর একটি মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ছিল তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এক বছর আগে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। রেখে গেছেন তার শিক্ষা, চেতনা ও আদর্শ। তার মৃত্যুর বছরপূর্তিতে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে এই প্রার্থনা করি, তিনি যেন মাহবুবে আলমকে বেহেশত নসিব করেন। আর আমার উদ্দেশে ফেলিসিটেশন সম্ভাষণে তিনি যেসব আশাবাদ ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন ও আমার ওপর অর্পিত যে দায়িত্বের কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছেন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন আমাকে সেই দায়িত্ব পালনে শক্তি ও সাহস দান করেন। আমিন।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল
বিভাগের বিচারপতি

আরও পড়ুন

×