ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

শ্রদ্ধাঞ্জলি

লতা-সন্ধ্যা-বাপ্পির সংগীত ও রাজনীতি

লতা-সন্ধ্যা-বাপ্পির সংগীত ও রাজনীতি

মযহারুল ইসলাম বাবলা

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৫:০৪

তিনজন কণ্ঠশিল্পীর মাত্র ক'দিনের ব্যবধানে বিদায়ের ঘটনা কেবল ভারতের নয়, উপমহাদেশের সংগীতপ্রেমীদের শোকে হতবিহ্বল করেছে। তাদের মধ্যে দু'জনের মৃত্যু বার্ধক্যজনিত হলেও তিনজনই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রয়াত শিল্পীদের একজন মারাঠি এবং অপর দু'জন বাঙালি।

লতা মঙ্গেশকর মারাঠি হলেও সর্বভারতীয় ভাষায় তার অসাধারণ গান শ্রোতাদের যুগ যুগ ধরে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিয়েছে। তিনি হিন্দি চলচ্চিত্রে সর্বাধিক গান গেয়েছেন এবং একক কর্তৃত্বে হিন্দি গানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী হিসেবে নিজের স্থায়ী আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন। স্বর্ণযুগে তার গাওয়া বাংলা গান বাঙালি শ্রোতাদেরও বিমুগ্ধ করেছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরীর সুরে ও কথায় অগণিত গান গেয়ে বাঙালি হৃদয়ে লতা মঙ্গেশকর জায়গা করে নিয়েছেন এবং তা মুছে যাওয়ার নয়। তার গাওয়া গানগুলো শুনে মনে হয় না অবাঙালি এই শিল্পীর গাওয়া বাংলা গানগুলো নিখুঁত উচ্চারণের বিষয়টি। মনেই হয় না তিনি বাঙালি নন অথচ জাতিতে মারাঠি। কিন্তু তার শ্রুতিমধুর কণ্ঠে বিশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ অসাধারণ। তার গাওয়া ওইসব বাংলা গান আজও বাঙালি শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে। চিরদিনের গানে পরিণত লতা মঙ্গেশকরের বাংলা গানগুলো বাঙালি হৃদয়ে গেঁথে আছে। মুছে যাবে না কোনোদিন, কোনোকালে।

বাংলা গানের স্বর্ণযুগের শেষ শিল্পী হিসেবে বিদায় নিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। অসামান্য এই শিল্পীর গাওয়া গান বাংলা গানের জগতে 'চিরদিনের গান' হিসেবেই আসন নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তার পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের বিরল ঘটনা উপমহাদেশের সব মানুষকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। অতীতে জাতীয় পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পেলেও জীবন সায়াহ্নে এসে পদ্মশ্রী প্রত্যাখ্যান হিন্দু জাতীয়তাবাদী-কেন্দ্রীয় সরকারকেই যেন প্রত্যাখ্যানের ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। ভারতে এখন হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের জয়যাত্রা প্রবল স্রোতে বইছে। ভারতীয় জনগণও সেই স্রোতে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছে। বিজেপিকে একচেটিয়া ভোট দিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বারবার ক্ষমতাসীন করে চলেছে।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ১৯৫০ সালে বোম্বেতে চলে যান শচীনদেব বর্মণের আমন্ত্রণে। বোম্বেতে হিন্দি গানে তিনি সফলতা পাননি বলেই ১৯৫২ সালে স্থায়ীভাবে কলকাতায় ফিরে আসেন। বাংলা চলচ্চিত্রে এবং বাংলা গানের জগতে তার স্থায়ী আসন পাকাপোক্ত হয়ে যায়। অত্যন্ত শ্রুতিমধুর কণ্ঠের অধিকারী সন্ধ্যার গান বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শক নন্দিত নায়িকা সুচিত্রা সেন অসংখ্য ছবিতে ঠোঁট মিলিয়েছেন। শ্রোতাদের কাছে ওইসব গান অভাবনীয় মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিয়েছিল। আজও ওইসব গান কিংবদন্তি গানে পরিণত হয়ে আছে। তার কণ্ঠের স্বতন্ত্রতায় সহজে বুঝে নেওয়া যায় শিল্পীর পরিচয়। শারীরিক কারণে দীর্ঘদিন গান থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সম্মাননা অনুষ্ঠানে আসতেন। ঋজু কণ্ঠে অতীতের নানা স্মৃতির কথা বলতেন। এই অসামান্য শিল্পী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে গানের স্কোয়াড গঠন করে পশ্চিম বাংলাজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণা, শরণার্থীদের জন্য অনুদান সংগ্রহে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলা গানের স্বর্ণযুগের তিনিই শেষ শিল্পী হিসেবে বিদায় নিলেন। অবসান ঘটল স্বর্ণযুগের শিল্পীদের একে একে বিদায়ের শেষ যাত্রা।

বাপ্পি লাহিড়ী বাংলা গানে যতটা না প্রতিষ্ঠিত তার চেয়ে অধিক প্রতিষ্ঠা তার হিন্দি গানে। আদিতে আমাদের সিরাজগঞ্জের জমিদার লাহিড়ী পরিবারের সন্তান। তার পিতা ১৯৪৭-এর দেশভাগে কলকাতায় চলে যায়। তবে কৈশোরে বাপ্পিসহ পুরো পরিবার জন্মভূমিতে একবার এসেছিল। লাহিড়ী পরিবারের পাকা দোতলা বাড়িসহ অবকাঠামো এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। কেবল পাকা এক তলা বাড়িটি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে আছে। জমিদার লাহিড়ীদের জনকল্যাণমূলক কাজের নিদর্শন হিসেবে ছেলে ও মেয়েদের স্কুল, কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি তাদের সুখ্যাতি ছিল এলাকাজুড়ে। পরিবারের সদস্যদের স্থানীয়রা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।


বাপ্পি লাহিড়ীর পিতা-মাতা দু'জনই গান করতেন। মা আবার নাচও করতেন। অশোক কুমার, কিশোর কুমারদের ভগ্নি ছিলেন বাপ্পির মা। পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্রে তার গায়ক হওয়ার পথটা সহজই ছিল। শুরুতে বাংলা গান গাইতেন। কেবল তরুণদের মধ্যেই তার গাওয়া বাংলা গান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ওই সময়ে তিনি পাড়ি দেন বোম্বেতে। শুরুটা ভালো না হলেও, গায়ক, সুরকার, সংগীত পরিচালক হিসেবে হিন্দি গানে সর্বভারতীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। হিন্দি চলচ্চিত্রে কিশোর কুমারের পর তিনিই বাঙালি শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে থাকা সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মাসাধিককাল হাসপাতালে ছিলেন। হাসপাতাল থেকে গৃহে প্রবেশের পর হঠাৎই তিনি চলে গেলেন। বোম্বেতে স্থায়ী বাপ্পি কলকাতায় আসা-যাওয়া করতেন। বিচারক হিসেবে অংশ নিতেন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের গানের প্রতিযোগিতায়।

এই তিন গুণী শিল্পীর বিদায়ে উপমহাদেশজুড়ে তাদের শ্রোতারা শোকে বিহ্বল হয়েছেন। পরিণত বয়সে লতা মঙ্গেশকর এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বিদায়ও শ্রোতাদের শোকাচ্ছন্ন করেছে। অন্যদিকে বাপ্পি লাহিড়ীর আকস্মিক চলে যাওয়া মেনে নেওয়া কষ্টসাধ্য তো বটেই। এই তিনজন শিল্পীর গানের ভক্ত, অনুরাগীরা শিল্পীদের বিদায়ে শোকে বিহ্বল হয়েছেন। শিল্পীরা তাদের শিল্পীসত্তার মাঝে এবং তাদের গানের মাঝেই নিশ্চয় বেঁচে থাকবেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় রাজনৈতিকভাবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকলেও অন্য দু'জনের ক্ষেত্রে বিতর্কের ঘটনা রয়েছে। লতা মঙ্গেশকর এবং বাপ্পি লাহিড়ী সংগীতের ভুবনে যেমন জনপ্রিয়, ধর্মান্ধ হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে যুক্ততার কারণে তেমনি বিতর্কিতও বটে। তারা কোন অভিলাষে কিংবা মোহে পড়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেন এ নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। বাপ্পি লাহিড়ী বিজেপিতে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিলেও হেরে গেছেন। লতা মঙ্গেশকর হিন্দুত্ববাদী আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এবং আরএসএসের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে বিপুল সমালোচিত হয়েছেন। অসমিয়া জাতিসত্তার গায়ক, সুরকার খ্যাতিমান ভূপেন হাজারিকাও শেষ বয়সে সারা জীবনের প্রগতিবাদী মতাদর্শ ত্যাগ করে হিন্দুত্ববাদী বিজেপিতে যোগদান করেন এবং গুয়াহাটি থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। তার প্রতি ব্যক্তিগত অনুরাগীরা হতাশ ও তির্যক সমালোচনা করে তাকে পরিত্যাগ করেছিল। সর্বভারতীয় জনপ্রিয় শিল্পী লতা মঙ্গেশকর এবং বাপ্পি লাহিড়ীর ক্ষেত্রেও তাদের অনুরাগীরা হতাশা ও সমালোচনা মুখর হয়েছিল। তবে তাদের শিল্পীসত্তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি।

মযহারুল ইসলাম বাবলা: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

আরও পড়ুন

×