জবিতে টেন্ডার বাণিজ্যে ছাত্রলীগের ‘গুরু-শিষ্য’

কামরুল হাসান ও জবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আকতার হোসাইন এবং সাখাওয়াত হোসেন প্রিন্স ও শাখা সভাপতি ইব্রাহিম ফরাজী। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান হুসাইন, জবি
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪ | ১২:২১ | আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪ | ১২:৩০
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) সব টেন্ডার পান সাখাওয়াত হোসেন প্রিন্স ও কামরুল হাসান। দু’জনই শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। তাদের গড়া রাজনৈতিক শিষ্য বর্তমান সভাপতি ইব্রাহীম ফরাজী ও সাধারণ সম্পাদক এস এম আকতার হোসেন এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন সবকিছু। প্রশাসনকে জিম্মি, হুমকি-ধমকি দিয়ে ঠিকাদার তাড়ানো, চেক আটকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তারা গুরুদের প্রতিদান দিচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা অলিখিত নিয়ম বানিয়ে ফেলেছেন– ক্যাম্পাসের কাজ মানেই পাবেন প্রিন্স ও কামরুল। বড় কাজ কামরুল নিলে প্রিন্সকেও একই টাকার ছোট ছোট কাজ দিতে হয়। সভাপতি তাঁর ভোলার বড় ভাই ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রিন্সকে এবং সম্পাদক তাঁর মাদারীপুর ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুলকে কাজ দেন। বিনিময়ে টেন্ডারের ৮-১০ শতাংশ কমিশন নেন তারা। আগে প্রিন্স ও কামরুলের কর্মী ছিলেন তারা।
হাজি ট্রেডের কর্ণধার ভুক্তভোগী ঠিকাদার আজাদ হোসেন জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের ৫৭ লাখ টাকার কাজ তিনি ১০ শতাংশ কমে করতে টেন্ডার জমা দেন। ছাত্রলীগ সভাপতি ইব্রাহিম ফোন করে ক্যাম্পাসে না যেতে হুমকি দেন। পরে কাজটি তাঁর পছন্দের প্রিন্সকে ৫৭ লাখ টাকায় দেওয়া হয়েছে।
আরেক ভুক্তভোগী ঠিকাদার মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘কমিশন বেশি দিতে রাজি নই বলে তারা (সভাপতি-সম্পাদক) আমাকে কাজ দেন না। তাদের লোক ছাড়া কেউ কাজ পেলে কর্মী পাঠিয়ে ঝামেলা করেন।’ এ ছাড়া নতুন ক্যাম্পাসের প্রাচীর নির্মাণকারী ঠিকাদার আনোয়ার হোসেনের ১০ লাখ টাকার চেক সভাপতি আটকে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০২২ সালের ১ জানুয়ারি ইব্রাহীমকে সভাপতি ও আকতারকে সাধারণ সম্পাদক করে জবি ছাত্রলীগের কমিটি হয়। এর পর থেকে ক্যাম্পাসের সব টেন্ডার কবজায় নেন তারা। দেড় বছর আগে কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও তাদের দাপটে অসহায় প্রশাসন।
গত আড়াই বছরের টেন্ডারের নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গভীর নলকূপের জন্য ৯ লাখ টাকা, বাংলা বিভাগের সংস্কারে সাড়ে ৬ লাখ, নাট্যকলা বিভাগের ভবনের ছাদের জন্য ৩১ লাখ, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ল্যাবের সরঞ্জাম কেনার ৫৫ লাখ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ভবন সংস্কারে ১৮ লাখ, মনোবিজ্ঞান বিভাগের ভবন সংস্কারে ১৪ লাখ টাকাসহ বড় বড় কাজ পেয়েছেন কামরুল। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় মসজিদ দ্বিতল করার ৫৭ লাখ টাকা, দর্শন বিভাগের ভবন সংস্কারে ২১ লাখ এবং ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালের ডেস্ক ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, ২০২২ সালে ছাত্রী হলে কম্পিউটার, প্রিন্টার ও ফটোকপি মেশিন কেনা, আসবাব মেরামতসহ অন্যান্য কাজ পেয়েছেন প্রিন্স।
আকতারের বিরুদ্ধে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, বর্তমান প্রশাসনের সময়ে ইজিপিতে (ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) টেন্ডার হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ইব্রাহীম ও আকতার। তবে অবন্তীকার আত্মহত্যার ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার আন্দোলনের মতো তারা প্রায় ২০০ কোটি টাকার নতুন ক্যাম্পাসের বালুর কাজ এবং ৪০০ কোটি টাকার রাস্তা নির্মাণের কাজ পেতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ কর্মীদের মাঠে নামানোর পরিকল্পনা করছেন বলে জানা গেছে।
সব কাজ কেন প্রিন্স ও কামরুল পাচ্ছেন– প্রশ্নে জবির প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, অন্য ঠিকাদার আবেদন কম করেন। কাজ পেলেও বাতিল করেন। ফলে প্রিন্স ও কামরুল কাজ বেশি পান। বাংলা বিভাগ ও নাট্যকলা ভবনের টেন্ডার অন্য কোম্পানি পেলেও কাজ করছেন কামরুল।
প্রিন্স কনস্ট্রাকশনের কর্ণধার প্রিন্স বলেন, ‘নিয়মিত ঠিকাদার হিসেবে ইজিপি প্রক্রিয়ায় টেন্ডার পাই। এখানে কোনো ভাইয়ের অবদান নেই।’ কেএস করপোরেশনের মালিক কামরুল বলেন, ‘সব কাজ নিয়ম মেনে পেয়েছি।’
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহিম বলেন, ‘কাজ আমি করলেও করব, তুমি করলেও করবা। তারা (প্রিন্স-কামরুল) করলে সমস্যা কোথায়? তারা বিধি মোতাবেক কাজ পান।’ চেক আটকে রাখা ঠিকাদার আনোয়ারকে চেনেন না বলে জানান তিনি। একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি আকতার।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান বলেন, আগে এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাইনি। অপরাধী ছাত্রলীগের হলেও পার পাবে না।
- বিষয় :
- জবি
- ছাত্রলীগ
- টেন্ডার
- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়