ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি সিনেমার বাজার

বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি  সিনেমার বাজার

অনিন্দ্য মামুন

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৩ | ১২:০৬

বাংলাদেশ তথা ঢালিউডের সিনেমা এখন শুধু বাংলাদেশের সিনেমা হলে সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বব্যাপী মুক্তি পাচ্ছে। হলিউড-বলিউডের বড় বড় বাজেটের সিনেমার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন চলছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি সিনেমার এ সাফল্য নিয়েই লিখেছেন অনিন্দ্য মামুন

হলিউডের সিনেমা মুক্তি পায় বিশ্বব্যাপী। প্রতিবেশী ভারতের ছবিও এখন বিশ্বব্যাপী মুক্তি পায়। ফলে হলিউড-বলিউডের সিনেমার ব্যবসা দিনকে দিন ফুলে-ফেঁপে উঠছে। হিন্দি সিনেমার পাশাপাশি তামিল, তেলেগুসহ ভারতের অন্যান্য আঞ্চলিক সিনেমা বিদেশে মুক্তি পাচ্ছে। সর্বশেষ আলোচিত কন্নড় ছবি ‘কেজিএফ ২’, বলিউডের ‘পাঠান’ ভারতের বাইরে রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসা করেছে। ব্যতিক্রম ছিল শুধু বাংলাদেশ তথা ঢালিউডের সিনেমা। একটু দেরিতে হলেও বাংলাদেশি সিনেমাও হাঁটতে শুরু করে এ পথে। এতদিন দেশের সিনেমার মান নিম্নমুখী, সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া, সিনেমাসংশ্লিষ্ট সমিতিতে কোন্দল, বয়কট সংস্কৃতি ইত্যাদি কারণে দেশি সিনেমা ক্রমেই নিমজ্জিত হচ্ছিল অন্ধকার সুড়ঙ্গে। এমন সময় একদল নির্মাতা ভালো সিনেমা বানিয়ে যুদ্ধে নামলেন। নিরাশ হতে হয়নি তাদের। দেশের বাজারে দর্শক টানা থেকে শুরু করে সিনেমাগুলো এখন মুক্তি পাচ্ছে বিশ্ববাজারেও।

ফলে হলিউড, বলিউডের পাশাপাশি বিশ্বের নানা দেশের সিনেমা হলে চলছে বাংলাদেশের সিনেমাও। শুধু চলছে না; যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এমনকি মধ্যপ্রাচ্য থেকেও বিপুল আয় করছে। বিদেশে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিবেশনার কাজ করছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো। রয়েছে বঙ্গজ ফিল্ম, দেশি ইভেন্টস, রিভেরি ফিল্মস, বায়োস্কোপ ফিল্মস, রাদুগাসহ অনেক প্রতিষ্ঠান। বিদেশে বাংলা ছবি প্রদর্শনের যাত্রাটা শুরু হয় ২০১৬ সালের দিকে। সে বছর প্রথম কানাডার মেইনস্ট্রিম থিয়েটারে ‘অস্তিত্ব’ সিনেমা মুক্তির মাধ্যমে যাত্রাটা শুরু হয়। পরে একে  ‘মুসাফির’, ‘সম্রাট’ ‘শিকারি’, ‘আয়নাবাজি’, ‘নবাব’, ‘দেবী’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘স্বপ্নজাল’,  ‘শান’, ‘মিশন  এক্সট্রিম’ প্রদর্শিত হয়। এরমধ্যে ‘শিকারি’, ‘আয়নাবাজি’ , ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘দেবি’, ,‘হাওয়া’ ও ‘পরাণ’ বেশ ব্যবসা করে ।  ধীরে ধীরে বাজার খুলতে থাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে; যার রেশ ধরে সর্বশেষ আলোচিত ছবি ‘প্রিয়তমা’ ও ‘সুড়ঙ্গ’ মুক্তি পেয়েছে। ব্যবসাও করছে।

 হলিউডের মৌসুমেও বাংলাদেশি ছবি

সাম্প্রতিক সময়টা হচ্ছে হলিউডের সুপারপিক সিনেমা মৌসুম। এ সময়ে হলিউডের ফ্র্যাঞ্চাইজি সিনেমার দাপট থাকে বিশ্বব্যাপী। তাদের এই দাপুটে সময়েও দাপট দেখাচ্ছে বাংলাদেশের সিনেমা। ঈদে মুক্তি পাওয়া আলোচিত সিনেমা ‘প্রিয়তমা’ কানাডা ও আমেরিকার থিয়েটারে দ্বিতীয় সপ্তাহেও চলছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আন্তর্জাতিক পরিবেশক স্বপ্ন স্কেয়ারক্রোর প্রেসিডেন্ট মো. অলিউল্লাহ সজীব। তিনি জানান, বিশ্ব সিনেমার এই ভরা মৌসুমে প্রথম উইকএন্ড বা তিন দিনে ৪৪ হাজার ডলার গ্রস করেছে ‘প্রিয়তমা’। ৪২টি হলে কানাডা ও আমেরিকায় মুক্তির পর প্রথম তিন দিনে সিনেমাটি ৪৪ হাজার ডলার গ্রস করে ফেলেছে এবং এটি উত্তর আমেরিকার বক্স অফিসে বাংলাদেশি সিনেমার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত চতুর্থ সর্বোচ্চ ওপেনিং। দর্শকের চাপে নিউইয়র্কের জ্যামাইকা মাল্টিপ্লেক্স সবচেয়ে বড় হলটা প্রিয়তমাকে দিতে বাধ্য হয়েছে। চারটির জায়গায় সাতটি শো চালিয়েছে এক দিন। দ্বিতীয় সপ্তাহে হল বেড়ে বাংলাদেশ, কানাডা ও আমেরিকা মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী ১৫১ হলে চলছে সিনেমাটি। সিনেমাটি এবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও মুক্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া আরেক সিনেমা ‘সুড়ঙ্গ’ অস্ট্রেলিয়াতেও মুক্তি পেয়েছে। ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও সৌদি আরবে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। মুক্তি পাবে নিউজিল্যান্ডেও। অস্ট্রেলিয়ায় সিনেমাটি মুক্তির প্রথম দুই সপ্তাহে ৩৭টি প্রদর্শনীর ১২টি শোর অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। বিষয়টি জানিয়েছে সেখানকার পরিবেশক বঙ্গজ ফিল্মস। আগামী ২৮ জুলাই একযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সব কয়টি শহরে মুক্তি পাবে এ ছবি।

 বিদেশে ছবি মুক্তির প্রক্রিয়া

বিদেশে সিনেমা মুক্তির প্রক্রিয়াটা খুব একটা কঠিন নয়। এ ক্ষেত্রে প্রথম শর্তই হচ্ছে ভালো সিনেমা। নিজ দেশে সেই সিনেমার ভালো প্রচার-প্রচারণা ও দর্শক চাহিদা থাকার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পায়। এ ক্ষেত্রে সিনেমাটি মিনিমাম টু কে রেজল্যুশনের ক্যামেরায় শুট করা হতে হবে। সাবটাইটেল থাকতে হবে। শর্তগুলো থাকলেই পরিবেশক প্রতিষ্ঠান মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে সিনেমা পাঠিয়ে থাকে। হলগুলোতে সিনেমা পাঠানো, সেন্সর করানো, এর প্রচার-প্রচারণার সব খরচ পরিবেশক প্রতিষ্ঠানই বহন করে। প্রযোজককে শুধু ভার্চুয়াল প্রিন্ট ফি (ভিপিএফ) দিতে হয়। (যদিও করোনার পর এ প্রক্রিয়াটি আর থাকেনি।)

মুনাফা বণ্টনে অনুসরণ করা হয় আন্তর্জাতিক পদ্ধতি

বিদেশে প্রদর্শিত সিনেমার কোনো টিকিট যদি ১০০ টাকাও বিক্রি হয়, তার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পাবেন প্রযোজক। রেনট্র্যাক (কমস্কোর) নামের একটি গ্লোবাল নেটওয়ার্কে সারাবিশ্বের বক্স অফিস ডাটাবেজ আছে, যেখানে সব মাল্টিপ্লেক্স রিপোর্ট করে। এখান থেকেই জানা যায় কোন সিনেমা কত টাকা আয় করেছে। গ্রস বক্স অফিস আয় থেকে ১৩-১৫ শতাংশ (কানাডা ও আমেরিকায় ১৩ শতাংশ। তবে কিছু দেশে ১৪ ও ১৫ শতাংশ) ট্যাক্স কেটে রাখার পর যে আয়টা থাকে, সেটাই নিট আয়। তার থেকে কোনো কোনো দেশের মাল্টিপ্লেক্স ৫০ শতাংশ নেয়, কোনো দেশ নেয় ৬৫ শতাংশ। মাল্টিপ্লেক্স তার ভাগ নেওয়ার পর যেটা থাকে, সেটার ফিফটি ফিফটি পরিবেশক ও প্রযোজকের মধ্যে ভাগ হয়। এটাই হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি। সিনেমা ভালো চললে ২-৪ শতাংশ বোনাস হিসেবেও অর্থ দিয়ে থাকে কোনো প্রতিষ্ঠান। 

বিদেশে বাংলাদেশি ছবির সবচেয়ে বড়  পরিবেশক ‘স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো’

বাংলাদেশের সিনেমার জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন বাজার তৈরি করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এ অধ্যায়কে বাস্তবায়ন করতেই ‘স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো’র যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালে। কানাডায় শুরু হয়ে বাজার বিস্তৃত হয় আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে।

মো. অলিউল্লাহ সজীব, প্রেসিডেন্ট, স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো

এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই রিগাল, সিনেমার্ক, সিনেপ্লেক্স, ভক্সের মতো বিশ্বখ্যাত চেইনে মুক্তি পাচ্ছে বাংলাদেশের সিনেমা। স্বপ্ন স্কেয়ারক্রোর বয়স খুব বেশি দিনের নয়। এরই মধ্যে বাংলাদেশের সিনেমা বিশ্ববাজারে স্থান করে নিতে সক্ষম হচ্ছে।

হলিউড সিনেমার সুপার পিক মৌসুমেও ৪২টি থিয়েটারে কানাডা ও আমেরিকায় মুক্তি পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, যা আমাদের জন্য অসাধারণ অভিজ্ঞতা। দর্শকের চাপে এই কঠিন সময়েও নিউইয়র্কের জ্যামাইকা মাল্টিপ্লেক্স তাদের সবচেয়ে বড় হলটা প্রিয়তমাকে দিতে বাধ্য হয়েছে। কানাডার টরন্টোতেও চলছে ‘প্রিয়তমা’ দেখার উৎসব। 

আরও পড়ুন

×