ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

কম্পানি : ইতিহাস আশ্রয়ে বর্তমানকে স্যাটায়ার

কম্পানি : ইতিহাস আশ্রয়ে বর্তমানকে স্যাটায়ার

কম্পানি নাটকের একটি দৃশ্য।

আবু সাঈদ তুলু

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৪ | ১৬:০৭ | আপডেট: ০২ মে ২০২৪ | ১৬:৩০

ঈদ যে শুধু ধর্মীয় উৎসবেই সীমাবদ্ধ নয়, তা আবার প্রমাণ করে দিল আরণ্যক নাট্যদল। ঈদের দিন থেকে বাংলা নববর্ষের দিন পর্যন্ত টানা চার দিন তারা উপস্থাপন করে নতুন নাটক ‘কম্পানি’। এটি রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন মামুনুর রশীদ। নাটকটিতে আশ্রয় করেছেন ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাঙালির পরাজয়ের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটকে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ইতিহাস নিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শচীন সেন গুপ্ত, সিকানদার আবু জাফর, সাঈদ আহমেদসহ নানা জনই নাটক রচনা করেছেন। কিন্তু বাংলা ভাষায় এই ইতিহাস নিয়ে এ ‘কম্পানি’ নাটকটির দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দৃষ্টিকোণ থেকে সে ইতিহাসকেই পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ নাটকটির নায়ক কুচক্রী রবার্ট ক্লাইভ। নাটকটি শ্লেষাত্মক। ব্রিটিশদের শোষণ-লুণ্ঠনের প্রতিনিধি হিসেবে তুলনা করে নিজেদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়েছে। 

এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ক্লাইভ। যে ক্লাইভের চক্রান্তেই হাজার বছরের বাংলা ব্রিটিশদের দাসে পরিণত হয়েছিল। সে পরিপ্রেক্ষিতে নাট্যকার নাটকের কাহিনির সময়কাল ধরেছেন ১৭৪৪ থেকে ১৭৫৭ সাল। ক্লাইভের জেলজীবন থেকে ভারতবর্ষে আগমন ও বাংলাকে পরাধীন করে ব্যাপক লুণ্ঠন করা পর্যন্ত কাহিনির বিস্তার। নাট্যকার ইতিহাসকেও নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। নতুন চরিত্রেরও সমাহার ঘটিয়েছেন। সিরাজউদ্দৌলার শাসনের ইতিহাস নানা জটিলতায় পূর্ণ। নবাব সিরাজের পতনের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিং সিরাজের এক ঘনিষ্ঠ কর্মচারীকে দিয়ে প্রথম সিরাজের জীবনী তৈরি করান। যেখানে সিরাজ জঘন্য চরিত্রের মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন। পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিবিদ জেমস মিলের ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’তেও সিরাজের চরিত্র অসম্মানজনক। মীরজাফর আলি খানকে নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর পর গবেষণায় উঠে আসতে থাকে নতুন ইতিহাস।

 বিহারীলাল সরকার, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, নিখিলনাথ রায়, কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতিজনের গবেষণায় সিরাজউদ্দৌলার ওপর আরোপিত কালিমাগুলো দূর হয়ে প্রজাবৎসল চরিত্র হিসেবে সিরাজউদ্দৌলাকে প্রতিষ্ঠিত করে। চল্লিশের দর্শক থেকে সিরাজকে নিয়ে জাতীয়তাবাদের আন্দোলনও গড়ে উঠতে শুরু করে। কিন্তু সেসব তথ্য-উপাত্ত নির্ভর ইতিহাস মামুনুর রশীদের নাটকে অনেকাংশে অনুপস্থিত। মামুনুর রশীদ তাঁর নাটকে ইতিহাসের এমন কিছু তথ্য দিয়েছেন, যেগুলো দর্শককে বিস্মিত ও নতুন করে চমক দিয়েছে। কিন্তু সুভ্যেনির তথ্যসূত্র উল্লেখ করেননি। 

প্রতীকবাদী উপস্থাপনা রীতিতে নাটকটি উপস্থাপিত হয়েছে। নাটকটি ইতিহাসের সময় নির্ভর হলেও, উপস্থাপনায় সময় প্রাধান্য পেয়েছে নৈর্ব্যক্তিকতা। বিভিন্ন প্রতীকী সাজেশনে দৃশ্যগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। নাটকের কাহিনি সরলরৈখিক। নাটকের শুরু থেকে মনে হয় ক্লাইভ কিংবা কোম্পানির গুণগান গাওয়াই নাটকটির মূল প্রবণতা। কিন্তু শেষ দৃশ্যে সমস্তটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। শেষ দৃশ্যেই প্রশংসার আড়ালে যে গভীর নিন্দা রয়েছে তা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় ইতিহাসচর্চা খুব কম। নাটকটি বিনোদনের সঙ্গে জাতিসত্তার গভীর রসদ সংগ্রহে নাট্যকর্মী কিংবা দর্শককে যেমন অনুসন্ধিৎসু করে তুলবে, তেমনি বিতর্কও তুলবে। নাটকটি ইতিহাসকে আশ্রয় করে সমকালের বাঙালির প্রবণতাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়েছে। নাটকটিকে ইতিবাচক বলে নেতিবাচক বিষয়কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কালো দেখিয়ে সাদার অনুপস্থিতি বুঝানো হয়েছে। চরিত্রাভিনয়ে নাটকটি উপস্থাপিত।

 আরণ্যক নাট্যদল তাদের প্রয়োজনে বরাবরই অভিনয়কে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এ নাটকও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতিটি চরিত্রই অসাধারণ সাত্ত্বিকতায় জীবন্ত করে তুলেছে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর মনস্তত্ত্ব। বয়স, মেজাজ, সংলাপ প্রক্ষেপণ ও অভিনয়ের নানা কুশলতা ঘটনাকে বাঙ্ময় করে তুলেছে। সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে সাজ্জাদ সাজু যেন আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন ১৭৫৭ সালের সেই বিপন্ন মানসিক আবেগে। জগৎ শেষ্ঠ চরিত্রে কামরুল হাসান আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন চক্রান্তের বুনোজাল। বিশ্বাসভাজন কেমন হতে পারে, তা যেন সাঈদ সুমনের মোহনলাল চরিত্রে প্রতিভাত। অপরদিকে ঘসেটি বেগম চরিত্রে ‘লায়লা বিলকিস’ ছবি অল্প সময়ের জন্য মঞ্চে এলেও যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে ইতিহাসের আবেগঘন পরিস্থিতি। নাট্য উপস্থাপনার পরতে পরতে দ্বন্দ্ব উপস্থাপিত।

মঞ্চ সজ্জায় খুব সাধারণ কিছু বক্স, সাজেশন, ফ্রেম ও নেট ব্যবহার করা হয়েছে। কিছুদিন আগে কলকাতা থেকে আসা ‘উড়ন্ত তারাদের মেলা’ নাটকেও তেমনটা দেখা গেছে। পরিমল মজুমদারের ধ্রুপদি সংগীতের নিনাদে, ফয়েজ জহিরের মঞ্চ পরিকল্পনায়, ঠাণ্ডু রায়হানের আলোক ভাবনায় মামুনুর রশীদের নাট্যবস্তু ও নির্দেশনায় নাটকটি উপস্থাপিত। নাটকটির টিমওয়ার্ক খুব সুশৃঙ্খল উপস্থাপনায় প্রাণবন্ত নাট্য প্রযোজনা।
 

আরও পড়ুন

×