ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

আদিবাসী নারী

নির্যাতন ও সহিংসতার জীবন

নির্যাতন ও সহিংসতার জীবন

প্রতীকী ছবি

আহমাদ শামীম

প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১২ মার্চ ২০২২ | ২৩:২২

সাম্প্রতিক সময়ে করোনা মহামারির মধ্যেও নারী নির্যাতনের যে উল্লম্ম্ফন দেখতে পাই, তা সত্যিই আশঙ্কার। সেটা বাঙালি হোক বা আদিবাসী নারী। পার্বত্য অঞ্চল বা সমতলের আদিবাসী, উভয় স্থানেই নারীরা যেমন নিজেদের পরিবার, জাতিগোষ্ঠীর দ্বারা নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তেমনি বাইরের মানুষ দ্বারাও নির্যাতিত হচ্ছেন তারা।

চলতি মাসের ৫ মার্চ সমকালে প্রকাশিত একটি সংবাদের উল্লেখ করা যেতে পারে। 'আদিবাসী নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর গলা কেটে হত্যার অভিযোগ' শিরোনামের ওই সংবাদের ভাষ্য, বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় নোয়াপতং ইউনিয়নের মহিলা কার্বারিপাড়া সংলগ্ন এলাকার একটি জুমঘর থেকে চুই রং মারমা নামে এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ ময়নাতদন্তের জন্য গত শুক্রবার তার লাশ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে। পুলিশ সূত্রমতে, ৩ মার্চ বৃহস্পতিবার, মহিলা কার্বারিপাড়ার পার্শ্ববর্তী এলাকার একটি পাহাড়ে জুম ক্ষেতে কাজ করতে যান চুই রং মা মারমা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলেও তিনি বাড়ি না ফেরায় পরিবারের লোকজন ও পাড়া-প্রতিবেশী মিলে তার খোঁজ করতে থাকেন। রাত ১২টার দিকে জুমের ঘরে গলাকাটা অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়। নিহতের ছেলে উশৈচিং মারমা বলেন, জুম ক্ষেতে হলুদ চাষ নিয়ে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে তার মায়ের বিরোধ ছিল। এ হত্যায় তারা জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। হত্যা মামলায় চারজনকে আসামি করা হয়েছে। চুই রং মা মারমার মতো আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ ও হত্যার এমন অনেক ঘটনা থেকে যায় আড়ালেই। কিছু ঘটনা আলোড়ন তোলে দেশব্যাপী, তখন সভা-সমাবেশ আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও নড়েচড়ে বসে।

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৭টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ জন বাস করে। এরা মোট জনসংখ্যার ১.১%। ২০০১ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ১০ হাজার ১৬৯। এসব আদিবাসী নারী সমাজের ওপর যুগ যুগ ধরে পারিবারিক, সামাজিক, সাম্প্রদায়িক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়ন চলে আসছে। সর্বশেষ আদমশুমারি ও গৃহগণনা বলছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৭টিতেই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেছে। অন্য ১৭ জেলায় বেড়েছে এক লাখ ৭৫ হাজার ৯৭২ জন। তবে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে এই হিসাবের মিল নেই। ফলে আদমশুমারির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আদিবাসীদের সাংবিধানিক ও আইনি অধিকারের প্রশ্নে রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা নিয়েও আছে প্রশ্ন। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদের কোনো অধিকারের কথা উল্লেখ ছিল না। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ২৩৯(ক) ধারা সংযোজন করা হয়। সংবিধানের ২৩ (ক)তে রাষ্ট্র দেশের বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে অনুচ্ছেদ ২৭-এ সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং অনুচ্ছেদ ২৮(১) এ কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ না করা এবং তাদের জন্য বিশেষ বিধি প্রণয়নের কথা উল্লেখ আছে সংবিধানে।

সংবিধানে আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ে ধারার সৃষ্টি হলেও আদিবাসী নারীদের প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা থেমে নেই। কাপেং ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের দেওয়া তথ্যমতে, ২০০৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৭২৬ জন আদিবাসী নারী ধর্ষণ, হত্যা, ধর্ষণচেষ্টা, অপহরণ, যৌন নির্যাতন ও পাচারের মতো ঘটনার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণ বা গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২২৬ জন, হত্যা বা ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৮৬ জন, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৮১ জন, ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৪৫ জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ৫২ জন, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৭ জন এবং পাচার হয়েছেন ১১ জন নারী। ২০১৪ সালে আদিবাসী নারীদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের ভয়াল থাবা। গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১২২ জন নারী নির্যাতনের শিকার হন। যার মধ্যে ধর্ষণের শিকার ২১, হত্যা ৭, শারীরিক নির্যাতন ৫৮, ধর্ষণচেষ্টা ২২, অপহরণ ১০ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে চারটি। ২০১৫ সালেও আদিবাসী নারীদের ওপর নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে ৮৫টি।

করোনা মহামারি চলাকালীন দুই বছরেও এই অবস্থার কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি। ২০২০ সালে আদিবাসী নারীদের ওপর হত্যা, সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৬২টি। এর মধ্যে ধর্ষণ ২০, হত্যা বা ধর্ষণের পর হত্যা দুই, শারীরিক নির্যাতন ১৬, ধর্ষণচেষ্টা ১৬, অপহরণ ছয় ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে দুটি। ২০২১ সালে হত্যা, নির্যাতন, সহিংসতা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে মোট ৪২টি। এর মধ্যে ধর্ষণ ২২, হত্যা চার, শারীরিক নির্যাতন দুই, ধর্ষণচেষ্টা ১২, অপহরণ এক, যৌন নির্যাতন এক ও পাচারের ঘটনা ঘটেছে একটি। ২০২১ সালে নির্যাতনের এসব ঘটনায় মামলার পরিসংখ্যানে চোখ বুলানো যেতে পারে। দলবদ্ধ ধর্ষণের তিনটি ঘটনায় করা তিন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে সাতজন। ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৭টি, মামলা হয়নি দুটি ঘটনায়। এসব ঘটনায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১০ এবং গ্রেপ্তার হয়নি ৯ জন। হত্যা বা ধর্ষণের পর হত্যায় মামলা হয়েছে তিনটি, মামলা হয়নি একটি ঘটনায়। এ চারটি ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। ধর্ষণচেষ্টায় মামলা হয়েছে পাঁচটি, মামলা হয়নি সাতটি ঘটনায়। গ্রেপ্তারের সংখ্যা তিন ও গ্রেপ্তার হয়নি ৯ জন।

আদিবাসী নারী নির্যাতন কেন বাড়ছে, এর প্রতিকার কী হতে পারে এ নিয়ে কথা হলো বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও কাপেং ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী ফাল্কগ্দুনী ত্রিপুরার সঙ্গে। তিনি বলেন, 'সহিংসতা বাড়ার অনেক কারণ। এর মধ্যে অন্যতম হলো, ওই নারী একজন আদিবাসী, দ্বিতীয়ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। এ ছাড়া ভূমির মালিকানা-সংক্রান্ত সমস্যায় আদিবাসী নারীদের টার্গেট করা হয় এবং আদিবাসীদের প্রান্তিক জীবনযাপন। সর্বোপরি আদিবাসী নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হওয়াটাই মূল কারণ। এর সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও। এমন অবস্থার শিকার নারীরা আইনি সহায়তা পায় না বললেই চলে। সামাজিকভাবে প্রান্তিক ও আর্থিক অসংগতির কারণে আদিবাসী নারীরা আইনি লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও অনেক দুর্বল। পাশাপাশি নির্যাতনের শিকার নারীর নিরাপত্তা বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শর্টকাট বা সহজ কোনো পথ নেই। আইনি ব্যবস্থা বা নীতিমালায় শাস্তির বিধানগুলো উল্লেখ আছে কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে এগুলোর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। চলমান এই কাঠামো ভাঙতে হলে রাষ্ট্র ও সমাজের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ যে দুর্নীতির বীজ রোপিত হয়েছে তার মূলোৎপাটন করতে হবে। দ্রুততর সময়ের মধ্যে বিচারকার্য নিষ্পত্তি করা গেলেই এ অবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে করি।'

আরও পড়ুন

×