ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে...

একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে...

--

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২২ | ০২:০৩

গানের আছে এক সম্মোহনী শক্তি, যা শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। সংগীতের অতলে ডুব দিলেই পাওয়া যায় শিকড়ের সন্ধান; মেলে জীবনের অর্থ। তাই গান যেমন আবেগে ভাসিয়ে দেয়, তেমনি খুঁজে দেয় মুক্তির পথ। সংগীত কীভাবে মুক্তিকামী মানুষের হাতিয়ার হয়ে ওঠে- তার জ্বলন্ত উদাহরণ ১৯৭১। সম্মুখযোদ্ধাদের সাহস-শক্তি জোগাতে, স্বাধীন দেশের মানচিত্র ছিনিয়ে আনতে গানই হয়ে উঠেছিল বড় হাতিয়ার। তেমনই কালজয়ী পাঁচ গানের জন্মকথা নিয়ে এ আয়োজন। লিখেছেন একাত্তরের পাঁচ শব্দসৈনিক।

গান নয়, সে ছিল বারুদ
আপেল মাহমুদ
একজন সাদাসিধে মানুষের মনের মধ্যে কতটা আগুন লুকিয়ে থাকতে পারে, তা জেনেছিলাম গোবিন্দ হালদারের গীতিকবিতা পড়ে। একাত্তরের জুন মাসের কথা। তখন আমাদের ঘরবাড়ি-ঠিকানা বলতে একটাই, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। থাকা-খাওয়া-ঘুমানো-গান বাঁধা-গান গাওয়া, এই ছিল নিয়মিত রুটিন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে স্ব্বাধীন দেশের পতাকাতলে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর ছিলাম আমরা। হঠাৎ একদিন গোবিন্দ হালদার নামের মানুষটি সামনে এসে দাঁড়ালেন। সে দিনই প্রথম পরিচয়। তার কথা থেকেই জানতে পারি, লেখালেখি রক্তে মিশে আছে। এরপর গোবিন্দ হালদার আমার হাতে তুলে দেন তার লেখা গানের একটি পাণ্ডুলিপি। যে পাণ্ডুলিপির একেকটি গীতিকবিতায় চোখ বুলিয়ে কোনোভাবেই মেলাতে পারিনি গোবিন্দ হালদারের সাদাসিধে অবয়বের সঙ্গে। কারণ, তার পাণ্ডুলিপিতে গান নয়, সে ছিল বারুদ। তাই বিস্ময় নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছি, একজন মানুষের মনে কতটা আগুন লুকিয়ে থাকলে এমন সব গান লেখা যায়? তার অন্যান্য গানের মতো 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি' গানের কথাগুলো পড়েও অবাক হয়েছিলাম। মুগ্ধ হয়েছিলাম গানের কথায় বিশ্বশান্তি, নারী, ফুল, মাটি আর মানুষের কথা কী চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা দেখে! শব্দ মানুষকে কাঁদাতে পারে, হাসাতে পারে, ভাসাতে পারে, মনের মাঝে জন্ম দিতে পারে রাগ-ক্ষোভ-জ্বালা; করে তুলতে পারে বিদ্রোহী- গণসংগীত গাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এটা জেনেছি।

আরও একবার শব্দের শক্তির সম্পর্কে নতুন করে ধারণা জন্মে গোবিন্দ হালদারের 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি' গানের কথা পড়ে। একই গানে এত অভিব্যক্তি প্রকাশ করা সহজ কথা নয়। এখানেই গোবিন্দ হালদার অন্য আট-দশজন গীতিকারের চেয়ে আলাদা। যা হোক, গানটি হাতে আসার পর খুব একটা সময় নিইনি। বসে গেছি সুর করতে। সুর করতে গিয়ে নিজেই এক ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। জুন মাসেই গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে রেকর্ড করা হয়। গানটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক ছিল- সে কথা পরে অনেকেই স্বীকার করেছেন। সম্মুখযুদ্ধের ময়দান থেকে এসেছিলাম শব্দসৈনিক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। তাই গানই মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। তাই মুক্ত স্বাধীন পতাকাতলে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত গানে গানে যুদ্ধ চালিয়ে গেছি।



অগ্নিঝরা দিনের গান
শাহীন সামাদ
মুক্তিসংগ্রামী মানুষের কথা ভেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিরলস কাজ করে গেছি। সদ্য তারুণ্যে পা রাখা আমার জন্য এটি ছিল এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি যে, প্রথম দিন বালিগঞ্জের টেকনিশিয়ান রেকর্ডিং স্টুডিওতে একসঙ্গে আমাদের আটটি গান রেকর্ড করা হয়েছিল। তখন সরাসরি গান রেকর্ড করা হতো। ভুল হলে নতুন করে আবার গাইতে হতো। রেকর্ডিং করার আগে আমরা ২৫ থেকে ৩০ জন দল বেঁধে রিহার্সেল করতাম। রিহার্সেলের জন্য দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ড্রয়িং রুম ছেড়ে দিয়েছিলেন। ঘর বড় হলেও শিল্পী, সুরকার, বাদক- সবার ভিড় সামলানো কঠিন ছিল। তার পরও একটা ঠাঁই আছে- এটাই ছিল বড় সান্ত্বনা।

তাই নাওয়া-খাওয়া ভুলে আমরা গানের রিহার্সেল করতাম। এরপর শুরু হতো লাইভ রেকর্ডিং। এভাবেই 'শিকল পরা ছল', 'কারার ওই লৌহকপাট', 'আমার প্রতিবাদের ভাষা', 'ওই পোহাইল তিমির রাত্রি', 'ব্যারিকেড-বেয়নেট-বেড়াজাল'সহ অন্যান্য গানের মতো 'জনতার সংগ্রাম চলবেই' গানটি রেকর্ড এক দিনের রিহার্সেলের পর সরাসরি রেকর্ড করা হয়। বলতে গেলে অগ্নিঝরা দিনের প্রতিটি গানের গল্পই প্রায় একই রকম। ব্যতিক্রম শুধু গীতিকার, সুরকারের নাম। সিকান্দার আবু জাফরের লেখা এই গানের সুর করেছিলেন শেখ লুৎফর রহমান। মনে আছে, গান গাওয়ার পর অন্যরকম এক অনুভূতিতে মনটা ছেয়ে গিয়েছিল। এখনও গানটি শুনলে একাত্তরের স্মৃতি ভেসে ওঠে।


মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার শক্তি
সুজেয় শ্যাম
একাত্তরের ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন উপলক্ষে কলকাতার বালিগঞ্জে নতুন করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। যে কারণে আশফাকুর রহমান ও তাহের সুলতান আমাকে ডেকে বলেন, এখন আর বসে থাকার উপায় নেই; পুরোদমে কাজ শুরু করে দাও। আমিও লেগে পড়ি একের পর এক গান তৈরিতে। জুন মাসের ৮ তারিখের কথা। স্টুডিওর দোতলা থেকে নামছিলাম। তখন দেখা আবুল কাশেম সন্দ্বীপের সঙ্গে। তিনি আমার হাতে গীতিকথা লেখা একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেন, 'সমরদাকে দেখানোর সাহস হয়নি, আপনার হাতে তুলে দিলাম। দেখুন, গানটা করা যায় কিনা।' তার লেখা 'রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি' গানের কথা পড়ে এতই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, দু'দিনের মধ্যেই গানের সুর ও সংগীতায়োজন করে ফেললাম।

অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, তখন কোথা থেকে যেন ঐশ্বরিক শক্তি মনের মধ্যে ভর করত! যে জন্য দিনে দুটো গান রেকর্ড করতেও ভয় পেতাম না। রেকর্ডিংয়ের জন্য সময়ও পেয়েছি মাত্র আধা ঘণ্টা। সেটুকু সময়ের মধ্যে এক মাইক্রোফোনে ২৫ শিল্পীকে নিয়ে গানটি রেকর্ড করেছি। কাদেরী কিবরিয়া, রথীন্দ্রনাথ রায়, প্রবাল চৌধুরী, বুলবুল মহলানবীশ, মালা খুররমসহ এই কোরাস গানের প্রত্যেক শিল্পী সেদিন মন-প্রাণ উজাড় করে গেয়েছেন। হয়তো সে কারণে গানটি হয়ে উঠেছিল সম্মুখ সমরে থাকা প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার অনুপ্রেরণা শক্তি।


মুক্তির আকাঙ্ক্ষা
ডালিয়া নওশীন

সমরদা [সুরকার সমর দাস] তার সুরের মধ্য দিয়ে আমাদের রক্তে বারুদ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। 'পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে' গানটি গাওয়ার সময় এমনই মনে হয়েছিল। এ শুধু গান নয়; ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর যত অন্যায়-অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিক্ষেপ করা বুলেট। একই সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। অবাক হয়েছিলাম, গোবিন্দ হালদারের লেখা এই গানের কথা পড়ে। মনে হয়েছিল, যুদ্ধের ময়দান থেকে এসে তিনি এই গীতিকথা লিখেছেন। সমরদা ছিলেন অর্কেস্ট্রা মাস্টার। প্রায় দেড়শ মিউজিশিয়ান নিয়ে তিনি সংগীত পরিচালনা করতেন। কিন্তু এই গানটি অল্প কয়েকজন মিউজিশিয়ান নিয়ে তৈরি করেছিলেন।

যোদ্ধা মনোভাব নিয়ে কাজ করেছেন বলেই হয়তো অল্প সময়ে, এমন একটি গান তার পক্ষে তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। একাত্তরের মাঝামাঝি যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বালিগঞ্জে নতুন করে কার্যক্রম শুরু করে, তখন গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর বিটিভিতে 'পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে' গানটি আরও একবার রেকর্ড করেছিলেন। তখন ৪০ জনের বেশি শিল্পী গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের সঙ্গে এ গানটি আরও একবার গেয়েছি। গাইতে গিয়ে দেখেছি, তরুণ প্রজন্ম এই অনবদ্য সৃষ্টি আর এর স্রষ্টাদের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল! এটাই আসলে হওয়ার কথা। যে গানে একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়েছে, তার আবেদন কখনও ফুরিয়ে যাওয়ার নয়।


বিজয়ের উল্লাসে
তিমির নন্দী

'বিজয় নিশান উড়ছে ওই' গানটি রেকর্ড করার আগ পর্যন্ত আমরা শুধু আওয়াজ তুলেছি যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের পক্ষে। গানে গানে প্রেরণা জুগিয়েছি সম্মুখ যোদ্ধাদের। গানকে হাতিয়ার করে দিন-রাত লড়াই চালিয়ে গেছি। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের একটি খবর আমাদের আয়োজন খানিকটা বদলে দিয়েছিল। তাই গানের কথা ও সুরে উঠে এসেছিল বিজয়ের উল্লাস। যখন আমাদের কানে এলো, 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী অস্ত্র সমর্পণ করে ফেলেছেন'- তখন আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। কারণ মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ তখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। অবশ্য সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে একটি বিপ্লবী গান প্রচারের প্রস্তুতি চলছিল। আমরা তার রিহার্সেলেও অংশ নিয়েছিলাম। ঠিক সে সময়ই তাজউদ্দীন আহমদ ও এএইচএম কামারুজ্জামান আসেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। আমাদের বলেন, 'আজকে দেশ স্বাধীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিজয়কে সামনে রেখে একটি গান লেখ।' এই কথা শুনে, তখনই হাতে কলম তুলে নেন শহীদুল হক খান। লিখে ফেলেন 'বিজয় নিশান উড়ছে ওই' গানটি।

এরপর সুরও করে ফেলেন সুজেয় শ্যাম। এরপর শুরু হয় গান রেকর্ডিংয়ের প্রস্তুতি। অজিত রায়ের নেতৃত্বে আমরা দল বেঁধে গানটি গেয়ে যাই। গান রেকর্ডিংয়ে মুহূর্তে মনে হয়েছিল, আমরা সবাই রণাঙ্গনে আর অবরুদ্ধ বাংলায় সব মানুষ কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইছি। এটা এমন অনুভূতি, যা কথায় বলে বোঝানো যাবে না। কারণ এটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সর্বশেষ গান। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই মুক্তিকামী জনতাকে উজ্জীবিত রাখতে ভূমিকা রাখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। একের পর এক সৃষ্টি আর প্রচার করেছে অনবদ্য সব গান। তবে সেসব গানের ভিড়ে কিছুটা হলেও আলাদা 'বিজয় নিশান উড়ছে ওই' গানটি। কারণ এই গানের কথায়, মুক্ত স্বাধীন দেশের আকাঙ্ক্ষা কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠে আসেনি। এসেছে, একটি মুক্ত স্বাধীন দেশ পাওয়ার উল্লাস। তাই বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এই গানটি। ভালো লাগার বিষয় হলো, স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও এই গান আজও সমানভাবে মানুষের হৃদয় আন্দোলিত করে যাচ্ছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যান্য কালজয়ী গানের মতো এই গানও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম গাইছে, মেতে উঠছে বিজয় উল্লাসে।

আরও পড়ুন

×