ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

আমাজনে ফুটন্ত নদী

রূপকথা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা

রূপকথা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা

শাহিনা নদী

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২২ | ২৩:২১

রূপকথা শব্দটির সঙ্গে পরিচয় নেই এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে বিরল। কারণ একটি শিশুর জীবনে গল্প শোনার সূচনালগ্নই হয় রূপকথার গল্পের মাধ্যমে। আচ্ছা যদি এমন হয় আপনি যে রূপকথার গল্প শুনে বেড়ে উঠেছেন, বড় হয়ে সেটিই সত্য হয়ে গেল? শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও, এমন ঘটনার তথ্য-প্রমাণসহ ব্যাখ্যা করেছেন আমেরিকা প্রবাসী আন্দ্রেজ রুজো। বাস্তবতা যে কখনও কখনও রূপকথার গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর হতে পারে, সেটির প্রত্যক্ষকারী স্বয়ং আন্দ্রেজ রুজো। আমাজনের গহিন অরণ্যে এক রহস্যময় নদীর খোঁজ পান তিনি। টগবগিয়ে ফুটছে সে নদীর পানি। রহস্যময় এই নদীর নাম শান্যাই-টিম্পিশকা। তিনি শুধু নদীকে প্রত্যক্ষ করেই ক্ষান্ত হননি।

রূপকথার গল্পের বয়ে চলা সেই ফুটন্ত পানির নদী যে বাস্তবেই রয়েছে, তা গোটা বিশ্বকে জানিয়েছেন। টেডএক্সের 'দ্য বয়েলিং রিভার অব দ্য আমাজন' শীর্ষক সেই বক্তৃতায় রহস্যময় এই নদী নিয়ে তার অভিজ্ঞতা ও গবেষণালব্ধ প্রায় সব তথ্য-উপাত্ত এবং ফলাফল সবার সামনে তুলে ধরেন আন্দ্রেজ রুজো। আন্দ্রেজ বলেন, লিমায় বেড়ে ওঠা একটি বালক হিসেবে আমার দাদা আমাকে পেরুতে স্প্যানিশদের বিজয়ের গল্প শুনিয়েছিল। গল্পে আতাহুয়ালপা ছিল ইনকা (দক্ষিণ আমেরিকার একটি প্রাক কলম্বীয় সাম্রাজ্য) সাম্রাজ্যের রাজা। সেই গল্পে শুনেছিলেন ফুটন্ত নদীর কথা। এ সবকিছুই আন্দ্রেজের শৈশবের স্মৃতি। এরপর ১২ বছর কেটে যায়। তিনি এসএমইউতে (সাউদার্ন মেথডিস্ট ইউনিভার্সিটি) পিএইচডি করছিলেন। পেরুর ভূ-তাপীয় শক্তির সম্ভাবনা নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন তিনি। যখন তার সেই রূপকথার গল্পের কথা মনে পড়ত, তিনি সবাইকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন। প্রশ্নটি ছিল, ফুটন্ত নদীর কি আসলেই কোনো অস্তিত্ব আছে? আন্দ্রেজ তার বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি তেল, গ্যাস ও খনির কোম্পানির সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করতেন এবং সর্বসম্মতভাবে উত্তরটি ছিল- না। আন্দ্রেজ তার বক্তৃতায় আরও বলেন, পৃথিবীতে ফুটন্ত নদী দেখা যায় ঠিকই, তবে সেগুলো আগ্নেয়গিরির সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ, এত বড় ভূ-তাপীয় বহিঃপ্রকাশের জন্য একটা শক্তিশালী তাপ উৎসের প্রয়োজন হয়। মানচিত্রের তথ্য অনুযায়ী আমাজনে কোনো আগ্নেয়গিরি নেই। এমনকি পেরুর বেশিরভাগ অংশেও নেই। কাজেই আমাজন অরণ্যে ফুটন্ত নদী থাকার কোনো আশাই আমরা রাখতে পারি না। হঠাৎ একদিন পারিবারিক একটি নৈশভোজে সেই একই গল্প বলার সময় আন্দ্রেজের আন্টি তাকে বলেন, 'আন্দ্রেজ, আমি সেখানে ছিলাম। আমি সেই নদীতে সাঁতার কেটেছি।' তখন তার আঙ্কেল লাফিয়ে উঠে বললেন, 'না, আন্দ্রেজ, সে মজা করছে না। সত্যিই, ভারি বৃষ্টিপাতের পর তুমি সেই নদীতে সাঁতার কাটতে পারবে'।

আঙ্কেলের মুখে এসব কথা শুনে আন্দ্রেজ স্থবির হয়ে পড়েন। এরপর আন্দ্রেজ তার বক্তব্য আরও দীর্ঘ করে বলেন- 'আপনারা যেমন জানেন, বৈজ্ঞানিকভাবে সংশয় থাকা সত্ত্বেও আমি জঙ্গলে হাইকিংয়ের জন্য গেলাম; যার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আমার আন্টি। জায়গাটি থেকে সবচেয়ে নিকটতম আগ্নেয়গিরির কেন্দ্র ৭০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সত্যি বলতে, তখন আমি রূপকথার গল্পে থাকা আমাজনের সেই 'উষ্ণ-প্রস্রবণ' দেখার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করছিলাম। কিন্তু তারপর আমি একটা মৃদু তরঙ্গ শুনতে পেলাম। কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই জোরালো হচ্ছিল। এরপর আমরা যত কাছে গিয়েছি, গাছের মধ্য দিয়ে তত ধোঁয়া ও বাষ্প উঠে আসতে দেখেছি। অতঃপর আমি ফুটন্ত নদী দেখতে পেলাম। সঙ্গে সঙ্গেই পানিতে থার্মোমিটার ধরলাম এবং গড় তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৮৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট)।

এটা একেবারে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ফুটন্ত নয়, তবে অবশ্যই এর খুব কাছাকাছি। নদীটি গরম ছিল এবং দ্রুত প্রবাহিত হচ্ছিল। আমি নদীর প্রতিকূলে থেকে এই নদীকে অনুসরণ করে চলতে লাগলাম। আসলে নদীর সবচেয়ে পবিত্র স্থানে শামানের আখড়া ছিল। এটা অদ্ভুত কারণ, এখান থেকে ঠান্ডা স্রোতের প্রবাহ শুরু হয়। গল্প অনুযায়ী, এর একদিকে জলের দেবী ইয়াকুমামার বাড়ি। ইয়াকুমামা এক দৈত্যাকার সাপের আত্মা; যে পানি উত্তপ্ত করে এবং ঠান্ডা পানির জন্ম দেয়। সেখানে একটা উষ্ণ-প্রস্রবণ দেখতে পাই; যা পাথরের চাঁইয়ের নিচ দিয়ে ঠান্ডা পানির সঙ্গে গরম পানিকে মিশিয়ে দিচ্ছিল। এই প্রক্রিয়াই লৌকিক কাহিনিকে জীবন্ত করে রাখে।

পরদিন সকালে আমি ঘুম থেকে উঠলাম এবং চা চাইলাম। আমাকে মগ ও চা ব্যাগ নিয়ে নদীর দিকে যেতে নির্দেশ করা হলো। আমি অবাক হলাম! কারণ নদীর পানি একদম পরিস্কার ছিল; যদিও ভূ-তাপীয় সিস্টেমের জন্য সেটা পান করতে কিছুটা অদ্ভুত লাগছিল। ২০১১ সালে প্রথমবার সফরের পর থেকে প্রতি বছর আমি সেখানে ছুটে গিয়েছি। এই সফরটা কখনও আমার জন্য হর্ষময় আবার কখনও বা বিপজ্জনক ব্যাপার ছিল। এই নদীটি বিস্ময়ের আকারের বিশালতায়; এটি অবাক করার মতো দীর্ঘ। প্রবাহিত নদীর প্রায় ৬.২৪ কিলোমিটার অংশ উত্তপ্ত। সেখানে কিছু উষ্ণ পুল আছে। সেগুলো আকারে এই টেড মঞ্চের চেয়ে বড়। কিছু ঝরনাও রয়েছে, যার উচ্চতা ৬ মিটারের মতো। সেগুলোর সবই প্রায় ফুটন্ত নদীর কাছাকাছি অবস্থিত। আমি বুঝতে পারছি আপনারা সবাই ভূবিজ্ঞানী নন। তাই আরও সহজ করে বললে :সবাই কফি পান করতে পছন্দ করেন। প্রতিদিনের কফি কাপের তাপমাত্রা থাকে ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটা খুব গরম হলে হয় ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এক্ষেত্রে কফি কাপের কথাই ধরা যাক, ফুটন্ত নদী ঠিক এমনই। এভাবে কফির উদাহরণ দিয়ে উত্তাপের বিষয়টি তিনি তুলে ধরেন। এখনও অনেক কিছু উদঘাটন করা বাকি আছে। এরপর তিনি বলেন, 'এক অভাবনীয় বিশ্বে আমাদের বসবাস। তাই বাইরে যান। কৌতূহলী হোন। কারণ, আমাদের বসবাস এমন এক জগতে, যেখানে শামানরা জঙ্গলের আত্মার উদ্দেশ্যে গান গায়, যেখানে রূপকথার মতো বাস্তবে নদীর পানি ফুটছে এবং যেখানে কল্পকাহিনিরা জীবনজুড়ে থাকে।'

আরও পড়ুন

×