আমি থাকি বা না থাকি

কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ [জন্ম :২৩ আগস্ট, ১৯৬৮-মৃত্যু :৩১ মে, ২০২২]
মীর সামী
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০১ জুন ২০২২ | ২৩:১১
'হাম রাহে ইয়া না রাহে কাল... ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পাল', 'খুদা জানে', 'আলবিদা', 'ও মেরি জান', 'সাচ ক্যেহ রাহ হ্যায় দিল... দিওয়ানা', 'তুহি মেরি সাব হ্যায়', 'মেরা পেহেলা পেহেলা পেয়ার', আঁখোমে তেরি', 'তু জো মিলা'সহ আরও বলিউড সিনেমার অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গায়ক কেকে। জীবনের সব গান শেষ করে গত মঙ্গলবার [৩১ মে ২০২২] কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ ওরফে কেকে মাত্র ৫৪ বছরে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন। একুশ শতকের প্রথম দশকের ছেলে-মেয়েদের প্রেমের শুরু এবং প্রেমের শেষ দুই মুহূর্তেরই সাক্ষী কেকের গাওয়া গান। সংগীতের এই নক্ষত্র পতনের সাক্ষী থাকল পশ্চিমবঙ্গের হাজারো দর্শক। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের নজরুল মঞ্চ ভিড়ে ঠাসা। দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা, কখন আসবেন গায়ক? সন্ধ্যা ৭টায় কেকে এলেন। গাইতে শুরু করেন একের পর এক জনপ্রিয় সব গান। নজরুল মঞ্চে হাজির দর্শকরা দেখলেন, ৫৪ বছর বয়সী কেকে গান গাইতে গাইতে মঞ্চের এক পাশ থেকে অন্য পাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কখনও দর্শকদের উদ্দেশে 'ফ্লাইং কিস' ছুঁড়ে দিচ্ছেন। দক্ষ জাদুকরের মতো সুরের জাদু দেখিয়েছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। অনুষ্ঠান শেষে মধ্য কলকাতার এক বিলাসবহুল হোটেলে ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন কেকে। এরপর তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
কিন্তু শিল্পীর কি আর মৃত্যু হয়। কেকে অনন্ত আকাশে চলে গেলেও, রেখে গেছেন তাঁর অসাধারণ সব সৃষ্টি। তাঁর 'হাম রাহে ইয়া না রাহে কাল... ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পাল' গানের কথার মতো 'আমি থাকি বা না থাকি, এই সময় মনে থাকবে'। তাঁর প্রত্যেক ভক্ত মনে রাখবেন তাঁকে; তাঁর শিল্পীসত্তাকে। গায়ক কেকের মৃত্যুতে শুধু ভারত নয়, শোকস্তব্ধ বাংলাদেশের সংগীতপ্রেমীরাও। দেশের অনেক তারকাশিল্পী তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। উপমহাদেশের বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা কেকের সঙ্গে তাঁর একটি ছবি প্রকাশ করে লিখেছেন, 'কিছুক্ষণ আগে কেকে মারা যাওয়ার ভয়ংকর খবর শুনলাম। আমার দুঃখ প্রকাশ করার ভাষা নেই। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে আমার ৫০ বছরপূর্তি উদযাপনের আগের দিনের সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন। গেয়েছিলেন আমার আয়োজনে।' অন্যদিকে চিরকুট ব্যান্ডের ভোকাল শারমিন সুলতানা সুমী লেখেন, 'একদিন আমরা সবাই যাব। কিন্তু একজন শিল্পীর জন্য এর চেয়ে সুন্দর মৃত্যু আর কী হতে পারে! কেকে, আপনার যত্নভরা গান দিয়ে যেমন আমাদের কৈশোর কিংবা বর্তমানের রং পাল্টে দিয়েছেন, তেমনই মায়ায়, আদরে থাকেন ওপারে।'
১৯৬৮ সালের ২৩ আগস্ট দিল্লির মালয়ালি পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ। বাবা সিএস নায়ার এবং মা কুন্নাথ কনকাবলী দু'জনেই গান গাইতেন। যেহেতু সংগীত পরিবারে কেকের জন্ম, তাই বাবা তাঁকে শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চার জন্য একজন ওস্তাদের কাছে পাঠান। কিন্তু সেই ওস্তাদের কাছে মন টিকল না তাঁর। ফিরে এসে বাবাকে বললেন, 'কিশোর কুমার কখনও গান শিখে গায়ক হননি। তাই আমি ভালো গায়ক হলে না শিখেই হবো'। বলিউডে আত্মপ্রকাশের আগেই কেকে ১১টি ভাষায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিজ্ঞাপনে জিঙ্গেল গান।
১৯৯৬ সালে তামিল সিনেমা 'কদাল দেশম'-এর ছবির 'কলেজ স্টাইল' মাধ্যমে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয় কেকের। জীবনের প্রথম এই প্লেব্যাকের সুযোগ দেন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী এ আর রহমান। এরপর ১৯৯৯ সালে 'হাম দিল দে চুকে সানম' সিনেমার বিখ্যাত গান 'তড়প তড়প কে ইস দিল সে...' গানের মাধ্যমে বলিউডে যাত্রা শুরু করেন কেকে। বাকিটা ইতিহাস। ওই বছরেই মুক্তি পায় তাঁর বিখ্যাত অ্যালবাম 'পল'। এই অ্যালবামের 'হাম রাহে ইয়া না রাহে কাল...' রাতারাতি লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। কোঁকড়া চুলের লাজুক কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ হয়ে ওঠেন সবার ভালোবাসার কেকে। বাংলা, হিন্দি এবং তামিল ছাড়াও তেলেগু, কন্নড়, মালয়ালাম, মারাঠি, অহমিয়া ও গুজরাটি ভাষাতেও গান গেয়েছেন কেকে। ২০০৯ সালে 'খুদা জানে' গানটির জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে সেরা গায়কের সম্মাননা পান। এ ছাড়াও বহু গানের রিয়েলিটি শোতে জুরি সদস্য হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন। জীবদ্দশায় হিন্দিতে প্রায় ৫০০-এরও বেশি এবং অন্যান্য ভাষায় ২০০টিরও গানে কণ্ঠ দিয়েছেন কেকে।
একজন কণ্ঠশিল্পীর প্রধান কর্তব্য গানে গানে ভক্ত ও শ্রোতার মন জয়। সে দায়িত্ব একেবারে নিখুঁতভাবে পালন করেই একেবারের ছুটি নিলেন কেকে। একজন শিল্পীর এর থেকে ভালো 'বিদায়' আর কী হতে পারে।
- বিষয় :
- কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ
- কেকে
- বলিউড সিনেমা