ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ

কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ

সুহৃদ সমাবেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২২ | ২৩:০৬

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূূন আহমেদের দশম প্রয়াণ দিবস আজ। পাঠক মনে কল্পনার ইন্দ্রজাল তৈরি করে এই অতুল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক চিরস্থায়ী আসন গেড়েছেন। বিশেষ করে বাঙালি মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীর মন ও মনন ছিল তাঁর নখদর্পণে। হুমায়ূনের সাড়ে তিন শতাধিক গ্রন্থের বেশ কয়েকটি কালজয়ী বলে এরই মধ্যে চিহ্নিত। চার সুহৃদের গদ্যে হুমায়ূন আহমেদের চার গ্রন্থের পাঠ প্রতিক্রিয়া...

অপেক্ষা
ফরিদুল ইসলাম নির্জন
হিমু হয়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরে জুতা ছাড়া হেঁটে চলেছি। কখনও শুভ্র হয়ে মোটা গ্লাসের চশমা পরেছি। বাকের ভাইয়ের জন্য হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম সেদিন। আবার কখনও লজিক জোগাতে মিসির আলীর কাছে ছুটে চলা, বৃষ্টিতে ভিজে জোছনায় ডুবে কী এক দারুণ বৈচিত্র্যময় জগৎ তৈরি হয়েছে তাঁর লেখায়। তবে 'অপেক্ষা'য় ভিন্ন এক স্বাদ মিলেছে। ছোটবেলা থেকে হুমায়ূন আহমেদের লেখার ভক্ত ছিলাম। প্রতিটি বইয়ে অন্যরকম জাদু আছে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে বাধ্য করে। অপেক্ষা বইটির আরও বেশি টান। কাহিনিটা সরল, সহজ বর্ণনা। আছে গভীর বেদনা, আছে অপেক্ষার দীর্ঘ মহাসাগর। চাকরিজীবী হাসানুজ্জামানের একমাত্র সন্তান ইমন। ইমনের যেদিন প্রথম দাঁত পড়ে সেদিন তাঁর বাবা ফেরেন না অফিস থেকে। শুরু হয় সুরাইয়া বেগমের অপেক্ষা। পেটের অনাগত সন্তান নিয়ে সুরাইয়া অপেক্ষায় আছেন তাঁর স্বামীকে দুটো সুখবর দেবেন। তাঁর বিশ্বাস, তিনি মারা যাননি, হারিয়ে গেছেন। এই অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘতর। পুরো উপন্যাসে আছে অভিমান জড়ানো অপেক্ষা। ছোট্ট ইমন ধীরে ধীরে বড় হয়। সুপ্রভা নামে আরেকটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। যার সম্পর্কে এই বইয়ে কয়েকটি ডায়ালগ মনের হৃদয়ের ক্যানভাসে এখনও জলছবি হয়ে ভাসে- 'পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দময় জিনিসগুলির জন্যে কিন্তু টাকা লাগে না। বিনামূল্যে পাওয়া যায়। যেমন ধরো জোছনা, বর্ষার দিনের বৃষ্টি, মানুষের ভালবাসা।' সুরাইয়ার লড়াই সংগ্রাম, অভিমানী হৃদয় আর প্রিয়তমের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার শেষ ছিল না। শেষে আকুলতা ও অস্থিরতা বেড়ে যায়। 'কলিংবেল বেজে যাচ্ছে। তিনি তাকিয়ে আছেন উঠোনের দিকে। শুক্লপক্ষ বলে উঠোনে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। আচ্ছা তাঁর বিয়ের রাতেও কি শুক্লপক্ষ ছিল? তাঁর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সর্বনাশা ঘণ্টা বেজেই যাচ্ছে। কে এসেছে? কে?'
সদস্য সচিব সুহৃদ সমাবেশ, ঢাকা কেন্দ্রীয় কমিটি

তেতুল বনে জোছনা
প্রত্যয় নিশান
বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র হুমায়ূন আহমেদ আমাদের বইপ্রেমী হতে বাধ্য করেছেন। ছোট ছোট দুঃখ-কষ্ট ও আনন্দ-বেদনার জোয়ারে ভাসতে শিখিয়েছেন। আনন্দ যেমন উপভোগ্য, ঠিক তেমনি বেদনাও উপভোগ করতে শিখিয়েছেন গল্পের এই জাদুকর। তাঁর নির্মাণশৈলী পাঠকের হৃদয় কেড়েছে। সব ছাপিয়ে তিনি দেখিয়েছেন বেঁচে থাকার আনন্দ উপভোগের পথ।


ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্পটি আমার ভালো লাগা তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে। "তুমি আমার জন্যে দু'ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ- তার প্রতিদানে আমি জনম জনম কাঁদিব"- হুমায়ূন আহমেদের লেখা জনপ্রিয় উক্তিটি অনন্য আলোড়ন তৈরি করে।
২০০১ সালে প্রথম প্রকাশিত এই প্রকাশিত বইটির কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিরাটনগর গ্রাম, সেখানকার চেয়ারম্যান তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। তাই নব্যধনী আজিজ মিয়ার উত্থানও তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। এমনই এক সময়ে গ্রামের ইমাম সাহেবের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আসে, নিজের প্রতিপত্তি জাহির করতে গিয়ে সবকিছু ঠিকভাবে না বিবেচনা করেই কঠোর শাস্তি দিয়ে বসেন জহির খাঁ। এই শাস্তিকে ঘিরে পরিস্থিতি অনেক ঘোলাটে হয়ে ওঠে। বইটির মূল চরিত্রে আছে নবনী ও আনিস। আনিস পেশায় একজন ডাক্তার এবং নবনী তাঁর স্ত্রী। চাকরিসূত্রে গল্পে আনিস গ্রামে অবস্থান করেন আর নবনী থাকেন ঢাকায়। গ্রামের জনৈক হুজুরও বেশ প্রাধান্য পেয়েছে এ গল্পের চরিত্রে। বিরাটনগর গ্রামের চেয়ারম্যান জহির খাঁ প্রায় পুরো উপন্যাসে নিজেকে দুষ্টু লোক বলে জাহির করেছেন। উপন্যাসের সবচেয়ে বিচিত্র চরিত্রের অধিকারী মতি মিয়া। তিনি নানা পেশায় নিজেকে মানিয়ে নেন। ৩০ বছর বয়সী এই যুবক নানারূপে দেখা দেন। ইমাম সাহেব, আনিসের বাবা, আনিসের মা, নবনীর বাবা, সখিনা, আজিজ মিয়া, সুজাতসহ আরও কিছু চরিত্র এই উপন্যাসে নানা পর্বে স্থান পেয়েছে। গতানুগতিক প্রেমের উপন্যাসে নায়ক-নায়িকার জীবনের বর্ণনার বিপরীতে এখানে ভিন্নরূপে চিত্রিত হয়েছে গল্পের পথরেখা। বিরাটনগরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে গ্রামের রাজনীতি ও মানুষের নানা বিশ্বাস সুচারুরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। মূল কাহিনিতে তেমন ভূমিকা না থাকলেও এদের জীবনকথা উপন্যাসকে গতিশীল করতে বেশ বড় ভূমিকা রেখেছে। হুমায়ূন আহমেদের প্রেমের উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। অনেকে এটিকে তাঁর লেখা শ্রেষ্ঠ প্রেমের উপন্যাসও বলেন। আনিস ও নবনীর মধ্যে বিয়ে-পরবর্তী সংকট দেখা দেয়, তা পারিবারিক বিয়ের ক্ষেত্রে অনেক দম্পতির জন্য স্বাভাবিক। যার দরুন উপন্যাসটির কাহিনি অনেক বেশি বাস্তবসম্মতভাবে ফুটে উঠেছে। নিকটতম মানুষের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ না করে চেপে রাখলে যে সমস্যা দানা বাঁধে, সেটিই লেখক এখানে সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।
সুহৃদ ঢাকা

মজার ভূত
হাসনাত মোবারক
হুমায়ূন আহমেদের কিশোর উপযোগী লেখাগুলোই আমাকে বেশি টানে। মন খারাপের দিনে এই জাদুকরের কিশোর গ্রন্থগুলোই পড়ি। বারবার পড়ি। মুগ্ধ হই। বিস্মিত হই। তাঁর কিশোর উপযোগী রচনাগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তিনি শিশু-কিশোরদের ছোট করে দেখাননি; বরং শিশুদের বয়ানে তিনি সত্য, প্রতিবাদী, মানবিক করে শিশুদের চিন্তাকে তুলে ধরেছেন। বয়স অল্প হলেই চিন্তার পরিসরও সীমিত হবে, এমনটা তিনি বিশ্বাস করতেন না; বরং লেখাতে তিনি কিশোরদের চিন্তাকে পরিপকস্ফভাবে উপস্থাপন করতেন।
এমন এক সৃষ্টি 'মজার ভূত'। বইয়ে ছয়টি গল্প রয়েছে। 'মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ', 'রুঁরুঁর গল্প', 'মোবারক হোসেনের মহাবিপদ', 'একটি ভয়ংকর অভিযানের গল্প', 'ভূত মন্ত্র', 'পানি রহস্য'। রম্য-রসের হাঁড়ি ভরা গল্পগ্রন্থটি আমার খুব প্রিয়। যেমন রস তেমনি নানা উপদেশ বাতলে দিয়েছেন গল্পের পরতে পরতে। হুমায়ূন আহমেদের লেখা মানেই ছোট ছোট বাক্য, সহজ ও সরল শব্দ। সরস কাহিনির বাতাবরণে তিনি দর্শন ঢুকিয়ে দিয়েছেন একের পর এক। বলার ঢঙে রয়েছে অভিনবত্ব। মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ গল্পে নীতু নামের একটা মেয়েকে স্কুলশিক্ষক মামা গল্প বলার মাঝখানে গল্প থামিয়ে মামা যখন বলেন, অন্যদিন বলব। তখন নীতু আপত্তি জানায়। মামাকে অনুরোধ করে- গল্পটি এখনই শেষ করতে হবে। সেই সঙ্গে পাঠক হিসেবেও আমার আগ্রহ জন্মে- মামা গল্পটা এখনই শেষ করুক। হ্যাঁ। এখানে স্টোরি টেলার হুমায়ূন আহমেদের কারিশমা। যতবার পড়ি ঠিক ততবারই মজা পাই। দুপুরে পার্কের বেঞ্চিতে বসা অবস্থায় ফুটফুটে ছেলে এসে তাঁর সঙ্গে অবিশ্বাস্য গল্প ফেঁদেছে। ছেলেটি যে মিথ্যা বলছে, এজন্য ওই ছেলেটির মধ্যে রাজনৈতিক নেতা হওয়ার সম্ভাবনা দেখেন। গল্পে হুমায়ূন আহমেদ সুচারুভাবে উপস্থাপন করলেন- রাজনৈতিক নেতা মানে মিথ্যার ফুলঝুরি। এখানেই একজন হুমায়ূন আহমেদ অদ্বিতীয়। সাহসী। প্রতিবাদী।
সুহৃদ ঢাকা

বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল
হিভা আনিকা
পাঠক হিসেবে নিজেকে ষোলো আনা খ্যাতি না দিলেও হুমায়ূন আহমেদের লেখা আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে, আলোড়িত করে, অনুপ্রাণিত করে। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। সেই 'বাদল দিনের দ্বিতীয় কদমফুল' থেকে শুরু, এরপর তাঁর কত সৃষ্টি কদমফুলের সুবাস ছড়িয়ে দিল, সে হিসাব রাখিনি। প্রতিটি লেখা আর চরিত্রের সঙ্গে কল্পনার জগতে হারিয়ে যাওয়া। মূলত বাদল দিনের দ্বিতীয় কদমফুল বইটিই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে জনপ্রিয় এই লেখকের সঙ্গে। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র হেদায়েতুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল কলেজের একজন অঙ্কের শিক্ষক। ছাত্রীরা তাঁকে ডাকে 'গিরগিটি' স্যার। গিরগিটি ছাড়াও তাঁর আরেকটা নাম আছে 'আফু', মানে আইনস্টাইনের ফুপাতো ভাই। প্রাইম নম্বর নিয়ে তাঁর প্রচুর মাতামাতি। ছোটবড় যে কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রেই প্রাইম নম্বর খোঁজে আর চারপাশে ঘটে যাওয়া সবকিছুরই ইকুয়েশন বের করতে চেষ্টা করে। আপাতত সে আত্মার ইকুয়েশন মেলানোর চেষ্টা করছে। এ কাজে তাঁকে সাহায্য করছে গণিতবিদ রামানুজ।

হেদায়েতের ধারণা, যেদিন সে আত্মার ইকুয়েশন মেলাতে পারবে সেদিন সে পাগল হয়ে যাবে। হেদায়েতের স্ত্রী সেতু। অত্যন্ত রূপবতী। ঘন ঘন বাবার বাড়ি যাওয়া তাঁর স্বভাব। রবিন সাহেবের সঙ্গে তাঁর অনৈতিক সম্পর্ক। এ নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই। তাঁর মাথাব্যথা হচ্ছে একটা হাত নিয়ে। এক রাতে অন্ধকারে লাইটারের জন্য হাত বাড়াতেই একটা হাতের ওপর তাঁর হাত পড়ে। প্রথমদিন সে ভয় পেয়ে যায় কিন্তু এক সময় আস্ত মেয়েটাই তাঁর সামনে আসে। তাঁর মাথায় হাত বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। মেয়েটার শরীর থেকে সে কচি আমপাতার গন্ধ পায়। কিন্তু আদৌ কি কোনো মেয়ে এসেছিল, নাকি এসেছিল কোনো আত্মা, না এসব কিছুই তাঁর কল্পনা? হেদায়েতের কলেজের মাহজাবিন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। প্রায় রাতেই হেদায়েতকে তাঁর এক ছাত্রী ফোন দেয়। নাম নিতু, রোল নম্বর ১০। কিন্তু রোল নম্বর ১০ কি সত্যিই নিতু না মাহজাবিনের?

হেদায়েতের বড় ভাই বেলায়েত। দু'জন দু'জনের ভক্ত। হঠাৎ নিখোঁজ হন বেলায়েত। হেদায়েত চরিত্রটা ভীষণ ভালো লেগেছে। মনে হয়েছে একটা মানুষ কতটাই না সহজসরল ও সাদামাটা মনের হতে পারে। আবার আরেকটা সময় মনে হয়েছে, মানুষের এত ভালো হওয়ার দরকার নেই। কিছুটা হলেও স্বার্থপর হওয়া উচিত। তবে দুই ভাইয়ের ভালোবাসা, মধুর সম্পর্কটা দারুণ। হেদায়েত ভাইকে স্বপ্নের কথা বললে তাঁকে কখনও নিয়ে যায় নিউরোসার্জন আবার কখনও পীরের কাছে। যেভাবেই হোক ভাইকে সুস্থ করতেই হবে। আবার বেলায়েত যখন নিখোঁজ হয় তখন হেদায়েত পাগলের মতো খোঁজেন। দুই ভাইয়ের ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ। এই মুগ্ধতা একটুও কমেনি বরং বেড়েছে। দূর আকাশের নক্ষত্র হয়েও যদি তিনি আমাকে শুনতে পারতেন, বলতাম- এক নীলাকাশ মুগ্ধতায় ভালোবাসি।
সুহৃদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×