ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

নাট্যকেন্দ্রের 'পুণ্যাহ'

বিধ্বস্ত মানবতার শিল্প আখ্যান

বিধ্বস্ত মানবতার শিল্প আখ্যান

দৃশ্য :'পুণ্যাহ'

আবু সাঈদ তুলু

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০

আন্তর্জাতিকতার নামে যখন অন্ধ বিদেশি অনুকরণে সবাই মত্ত, তখন হাজার বছরের সংস্কৃতিনির্ভর প্রযোজনা অবশ্য সাহসী পদক্ষেপ। সম্প্রতি দেশের স্বনামধন্য নাট্যদল নাট্যকেন্দ্র 'পুণ্যাহ' শিরোনামে নতুন নাটক মঞ্চে এনেছে। গত ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে নাটকটির উদ্বোধন প্রদর্শনী হয়। নাটকটি লিখেছেন বদরুজ্জামান আলমগীর এবং নির্দেশনা দিয়েছেন ইউসুফ হাসান অর্ক। এটি নাট্যকেন্দ্রের ১৫তম প্রযোজনা।
'পুণ্যাহ' নাটকের কাহিনি গড়ে উঠেছে কাঁকরগাছি নামে এক গ্রামকে ঘিরে। সেখানে হঠাৎ ভয়াবহ ঝড় হয়। সেই ঝড়ে গ্রামটি মুহূর্তেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। তখন একটি বিধ্বস্ত জনপদের মানুষের সংগ্রাম, অস্তিত্বের সংকট, প্রতারণা কিংবা সামাজিক সম্পর্ক নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। মানুষ নিজেই নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়। ঘোড়াউত্রা নদীর অববাহিকায় হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির অদ্বৈতে বেড়ে ওঠা জীবনের গভীরে যেন বিষবাষ্প, প্রতারণা, অন্ধত্ব কেঁদে বেড়ায়। পৃথিবীর পরিবর্তনের ভয়াবহ শঙ্কা যেন এখানেও রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ বাহিত। সামগ্রিক বিপর্যস্ততার পরিপ্রেক্ষিতে আবহমান বাঙালির সংকটই বিশ্ব বাস্তবতায় চিহ্নিত হয়ে ওঠে।
কোনো চরিত্র বা একক কাহিনিকে পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চাননি নির্দেশক। ছোট ছোট স্কেচের মতো বিধ্বস্ত গ্রামের বিভিন্ন ঘটনার রূপনির্মাণ করেছেন। মঞ্চটিও নিরাভরণ। খোলা মঞ্চের পেছনে সংগীত দল বসা। পেছনে কালো সায়াক্লোমার দু'পাশে দুটো ছোট প্রতীকী চিত্র আঁকা। পুণ্যাহ শব্দে খাজনা আদায়ের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান বোঝালেও এ নাটকে এটি ঐতিহ্যের আয়নার মধ্য দিয়ে নিজের যাপিত জীবন, সমাজের রীতিনীতি ও সংস্কারকেই দেখাতে চেয়েছেন নাট্যকার। নানা দুর্যোগে বিধ্বস্ততায় একটি জনপদের রক্তক্ষরণ উৎসব ব্যঞ্জনায় পুণ্যাহ শব্দপ্রতীক যেন অনবদ্য হয়ে ওঠে। নির্দেশক নাট্য নির্মাণে বাঙালি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যের প্রতি জোর দিয়েছেন। নির্দেশক সে গীতল-নিরাভরণ পথেই হেঁটেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রঙ্গমঞ্চ' প্রবন্ধের উক্তিটির মতো 'দর্শক কল্পনাশক্তি বাড়িতে চাবি বন্ধ করিয়া আসে নাই'। নির্দেশক বিপন্ন গ্রামের ঘটনায় আত্ম অন্বেষণে দৃশ্য কাব্যিকতায় প্রত্যাশী। মানবসৃষ্ট অন্যায়-অবিচারও সমাজের দুর্যোগ। নির্দেশক সমস্যা দ্বান্দ্বিকতার পথে হেঁটে মানবিক বোধের একটি অভিব্যক্তি নির্মাণে চেষ্টা করেছেন। ঐতিহ্যবাহী রীতির ধারায় কল্পনা ও আবেগের আধিক্যে এ নাটকের দৃশ্যবুনন।
নাট্যকেন্দ্রের নাটকগুলোয় অভিনয়ে সাত্ত্বিকতা ও চরিত্র নির্মাণে বলিষ্ঠতা নাট্যজগতে অত্যন্ত সুবিদিত। তাদের এর আগে 'বিচ্ছু', 'হয়বদন', 'ক্রসিবল', 'ডালিমকুমার' নাট্যাঙ্গনে জনপ্রিয় প্রযোজনা। এ নাটকেও ঝুনা চৌধুরী, ইকবাল বাবু, হাবিব মাসুদ, মনামী ইসলাম কনক, সংগীতা চৌধুরীসহ অনেকের অভিনয়েই মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। নির্দেশক নিজেও একজন অভিনেতা। এ নাটকে তিনিও মঞ্চে সারাক্ষণ উপস্থিত থেকে গান গেয়েছেন। প্রায় প্রত্যেকেরই চরিত্র নির্মাণ, সংলাপ প্রক্ষেপণ, বাচনরীতি ও বিশ্বাসযোগ্য চলন বৈচিত্র্যে অনবদ্য হয়ে উঠেছে। মঞ্চে কোনো সেট বা দৃশ্যচিহ্নমূলক উপকরণ না থাকায় এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা ঘটনা-উপঘটনা থাকায় দর্শককে নাট্যবস্তু উপলব্ধিতে নির্ভর করতে হয় অনেকাংশে অভিনেতার এক্সপ্রেশনের ওপর। অভিনয়ে স্পেস হিসেবে দর্শকের মধ্যবর্তী স্থান পর্যন্ত ব্যবহূত হয়েছে। সাজেস্টিক পোশাক, স্থান-কাল বা চরিত্র বৈশিষ্ট্যের চেয়ে অভিনয়ে বিষয়কে উস্কে দিয়েছে।
সেলিম আল দীনের 'হরগজ' নাটকের সঙ্গে এ নাটকের কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। সেখানে টর্নেডোতে 'হরগজ' নামের গ্রাম ধ্বংস হলে আবিদ নামের উদ্ধারকর্মী ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যান জীবনোপলব্ধির প্রান্তে। এ 'পুণ্যাহ' নাটকেও রঞ্জিত আলোয়, সংলাপ-সংগীতে, ভাবপ্রকাশের চাতুর্যে নিরাভরণ মঞ্চে দৃশ্যের পর দৃশ্যে জীবনসংকটের নানা অনুষঙ্গ আত্মপ্রশ্নে উদ্ভাসিত। ছোট পরিসরের মঞ্চে; সীমাবদ্ধ সময়ে ক্যানভাসটি অতি বৃহৎ। নাটকের শেষে আম্বিয়ার রক্ত যেন প্রতারণা আর মৌলবাদী চক্রে আবহমান গ্রামবাংলার জমিনকেই ভিজিয়ে দেয়। া

আরও পড়ুন

×