শ্রদ্ধাঞ্জলি
আমাদের শিল্পগুরু

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন [২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪-২৮ মে ১৯৭৬]
রফিকুন নবী
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৮:০০
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে আমি শিক্ষক হিসেবে খুব কাছের করে পেয়েছিলাম বলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। এটা আমার জীবনের খুব বড় প্রাপ্তি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন যদি সাতচল্লিশে দেশভাগের পর এ দেশে চলে না আসতেন, যদি তাঁর সহশিল্পী সুহৃদদের নিয়ে কলকাতা থেকে চলে এসে এই আর্ট কলেজ তৈরি না করতেন, যদি চারুশিল্পকে আন্দোলনে পরিণত না করতেন, তাহলে আমি বা আমরা হয়তো কখনও শিল্পী হতে পারতাম না। আমার পক্ষে বিলাতে বা ফ্রান্সে লেখাপড়া করা সম্ভব ছিল না। ভারতেও যাওয়া আমাদের পক্ষে তখন সম্ভব ছিল না। পাকিস্তানের লাহোরে একটা বহু পুরাতন আর্ট কলেজ ছিল, মেয়ো কলেজ অব আর্টস, অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য। সেখানেও পড়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার ইচ্ছেও ছিল না।
বাংলাদেশে নিজ মাটিতে, নিজস্ব পরিবেশ ও আবহে থেকে আমরা যারা এখন শিল্পচর্চা করছি, তাদের সবার ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার পর আজ ক্রমে তা অনুষদে পরিণত হয়েছে। হাজারো ছাত্রছাত্রী বেরিয়েছে, তাঁরা দেশ ও বিশ্বের শিল্পকলায় অবদান রেখেছেন ও রাখছেন। প্রায় সমস্তই শিল্পাচার্যের দান। প্রাতিষ্ঠানিক দীক্ষার একটা সুপরিসর ক্ষেত্র তিনি তৈরি করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এমন একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে দেশে শিল্পীর পাশাপাশি শিল্পকলার সমঝদার তৈরি হয়েছে, সাধারণ মানুষের ভেতর শিল্পীর সামাজিক প্রতিষ্ঠা ঘটেছে, শিল্পীর রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রকাশিত হতে পেরেছে এবং ক্রমশ শিল্পকলার একটা অর্থনৈতিক অবস্থান দেশে তৈরি হতে পেরেছে।
আমাদের জন্য একটা প্রাতিষ্ঠানিক পট তৈরি করে দিতে গিয়ে যে বিপুলা সাংগঠনিক শ্রমের ভেতর দিয়ে শিল্পাচার্যকে যেতে হয়েছিল তা তাঁর নিজ শিল্পসাধনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। থেকে থেকে এই বেদনা যে জেগে উঠত না তাঁর মনে তা নয়। তিনি বলতেন, নিজের চিত্রকলা চর্চায় যদি আরও মন দিতে পারতাম ভালো হতো। এর পরও যে ছবিগুলো আমরা তাঁর হাত থেকে পেয়েছি, সেগুলো অসাধারণ কাজ ও বিশ্বের সম্পদ। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে কলকাতাকেন্দ্রিক যে চিত্রধারা চর্চিত ছিল, সেখানে লোকজ শিল্পের প্রভাব লক্ষণীয় ছিল না। আর কলকাতা ছিল কেন্দ্র। প্রত্যেক শিল্পীর আরাধ্য স্থানগুলোর একটা। আবেদিন স্যারও এর বাইরে ছিলেন না। তিনিও কলকাতায় গিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন, পড়েছিলেন এবং কলকাতাকে কেন্দ্র করে বিকশিত হতে চেয়েছিলেন। এবং সেই সময়ে বাংলার দুর্ভিক্ষ নিয়ে তাঁর অমিত চিত্রকর্মগুলো প্রকাশিত হয়। একটা অনন্য অধ্যায় রচিত হয়। দেশে-বিদেশে তিনি ব্যাপকভাবে আলোচিত হন, সুনাম অর্জন করেন। সেই পর্যন্ত আবেদিন স্যারের ভাবনা ও পরিকল্পনা ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক।
আর এদিকে আমাদের পূর্ববঙ্গের এ অঞ্চল ছিল একেবারেই লোকজ শিল্পচর্চার একটা পুণ্য অঞ্চল। এ অঞ্চলের লোকশিল্প যে রসগ্রাহী, উত্তম, আনন্দদায়ক তার পরিচয় পরে পৃথিবী পেয়েছিল। পঞ্চাশের দশকে তিনি এসে এই পূর্ববাংলার লোকজ শিল্পকলার গভীরতা, আধুনিকতায় তিনি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। লোকজ শিল্পকলার এই শক্তি তাঁর চোখ এড়ায়নি। জয়নুল আবেদিন লোকশিল্পের উপকরণগুলো গ্রহণ করে নিজস্বতার সঙ্গে মিলিয়ে একটা নতুন ধরন তৈরি করেছিলেন। এবং আমি মনে করি, পঞ্চাশের দশক জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলার শ্রেষ্ঠতম দশক। দুর্ভিক্ষ নিয়ে যে কাজগুলো ছিল, সেগুলো জয়নুলের স্বকীয় ধারার অন্যরকম উত্তম কাজ ছিল। কিন্তু যখন তিনি লোকজ উপকরণ নিজ শৈলীতে আত্মস্থ করলেন, নামে সুনামে তাঁর কাজগুলো আরও অনেক বেশি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে উঠল।
যদি তাঁর জীবানাচারের নানা দিকের বিচার-বিশ্নেষণে যাই, তো দেখতে পাই, তিনি নিজেকে তিনভাবে ব্যক্ত করেছেন। প্রথমত, আবির্ভূত হয়েছিলেন শিল্পী হিসেবে। এটা তাঁর নিজস্ব বড় জগৎ। সে জগৎ আমাদের চেনা।
দ্বিতীয়ত, তিনি প্রশাসক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ছাত্র-শিক্ষকদের একটা বলয়ে নিয়ে এসে তাঁদের শিল্প আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন, তাঁদের চালিত করেছেন। অধ্যক্ষ ছিলেন বিধায় তাঁকে প্রশাসন ও পাঠদান দুটি দিকই সযত্নে অবলম্বন করে চলতে হতো। সেই সময়ে সরকারের কাছ থেকে ঢাকা একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান তিনি আর্ট কলেজের জন্য আদায় করেছিলেন। তারপর সেখানে এত অপূর্ব একটা অবকাঠামো স্থাপন করতে পারা। এর পাশাপাশি তিনি শিল্পকলার ভাবনাকে প্রসারিত করে, এর ধারা বেগবান করে সবার মাঝে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রোথিত করতে তিনি লোকশিল্পকে শক্তি হিসেবে আশ্রয় করেছেন। এর লক্ষ্যে তিনি একটা সোনারগাঁয়ে ফোকভিলেজ তৈরি করলেন। কামার-কুমোর-সোনারু, নকশিকাঁথার শিল্পী সবাইকে এক করলেন। সবাইকে একটা কর্মক্ষেত্র দিলেন তিনি। এবং তার সঙ্গে ফোকভিলেজের ভেতর একটা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করলেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গগুলো তিনি একাত্তরের পর বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে তিনি আদায় করে নিয়েছিলেন। এ হলো তাঁর অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার দিক। এ ছাড়া দেশের মানুষের মাঝে শিল্পবোধ তৈরির একটা জোর চেষ্টা তাঁর গোটা কর্মকাণ্ডের ভেতর ছিল। শিল্পীদের একটা মর্যাদার জায়গায় তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।
তৃতীয়ত, তাঁর ছিল সুবিস্তৃত মানবিক দিক। একজন মানবতাবাদী শিল্পী হিসেবে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ একটা মন ছিল তাঁর। প্রাকৃতিক, কি মানবসৃষ্ট- যত ধারার দুর্যোগ মানুষের ওপর চেপে বসেছিল, তিনি একজন শিল্পী হিসেবে তাঁর সবলতার জায়গা থেকে মানুষকে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দিয়ে যেতে চেয়েছেন। মানুষের হয়ে তিনি মানুষকে সংবেদনশীলতার পাঠ দিতে চেয়েছেন। সাতচল্লিশের দুর্ভিক্ষের যে অঙ্কনগুলো ছিল তাঁর, সেখান থেকে শুরু। তারপর থেকে সমস্ত দুর্যোগ বা যুদ্ধে কোন বিষয়টি মর্মন্তুদ, মর্মস্পর্শী, মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তা তিনি চিত্রিত করে দেখিয়েছেন। মনপুরায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। বহু মানুষ, প্রাণী মৃত্যুবরণ করেছিল। তা নিয়ে তাঁর যে বিশাল স্ট্ক্রল তা অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি চিত্রিত করেছেন। পাকিস্তানি শাসকদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি যে আমাদের কেবল ছবির ব্যাকরণ শিখিয়েছেন তাই নয়, তিনি আমাদের দেশ চিনিয়েছেন, মানুষকে চিনিয়েছেন। শিল্পী হিসেবে আমাদের যে সমস্ত কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে যেতে হবে, তার সমস্তের পাঠ তিনি আমাদের দিয়ে যেতে চেয়েছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শিল্পীরা যাঁরা যুক্ত হয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন আবেদিন স্যারের ছাত্র। সেই সময় থেকে সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্ত আন্দোলনে যে শিল্পীরা সম্পৃক্ত হয়েছেন তার দীক্ষা কিন্তু আবেদিন স্যারের কাছ থেকে পাওয়া; তিনি ও তাঁর যে সহকর্মীরা ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে শেখা। কেবল ছবি আঁকতে শেখানোই কিন্তু তাঁর কাছে সম্পূর্ণ শিক্ষা ছিল না। এভাবেই আমাদের লেখাপড়া সম্পূর্ণতা পেয়েছিল।
আবেদিন স্যারকে আমি পেয়েছি, একজন অন্যরকম শিল্পী, একজন অন্যরকম মানুষ হিসেবে। তাঁর অবস্থান কিন্তু শুধু একজন শিল্পী হিসেবেই সমাপ্ত নয়। নেতা, অধ্যক্ষ ও মানুষ হিসেবে, সামাজিক মূল্যবোধের একজন নির্ধারক হিসেবেও তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বাংলাদেশে নিজ মাটিতে, নিজস্ব পরিবেশ ও আবহে থেকে আমরা যারা এখন শিল্পচর্চা করছি, তাদের সবার ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার পর আজ ক্রমে তা অনুষদে পরিণত হয়েছে। হাজারো ছাত্রছাত্রী বেরিয়েছে, তাঁরা দেশ ও বিশ্বের শিল্পকলায় অবদান রেখেছেন ও রাখছেন। প্রায় সমস্তই শিল্পাচার্যের দান। প্রাতিষ্ঠানিক দীক্ষার একটা সুপরিসর ক্ষেত্র তিনি তৈরি করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এমন একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে দেশে শিল্পীর পাশাপাশি শিল্পকলার সমঝদার তৈরি হয়েছে, সাধারণ মানুষের ভেতর শিল্পীর সামাজিক প্রতিষ্ঠা ঘটেছে, শিল্পীর রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রকাশিত হতে পেরেছে এবং ক্রমশ শিল্পকলার একটা অর্থনৈতিক অবস্থান দেশে তৈরি হতে পেরেছে।
আমাদের জন্য একটা প্রাতিষ্ঠানিক পট তৈরি করে দিতে গিয়ে যে বিপুলা সাংগঠনিক শ্রমের ভেতর দিয়ে শিল্পাচার্যকে যেতে হয়েছিল তা তাঁর নিজ শিল্পসাধনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। থেকে থেকে এই বেদনা যে জেগে উঠত না তাঁর মনে তা নয়। তিনি বলতেন, নিজের চিত্রকলা চর্চায় যদি আরও মন দিতে পারতাম ভালো হতো। এর পরও যে ছবিগুলো আমরা তাঁর হাত থেকে পেয়েছি, সেগুলো অসাধারণ কাজ ও বিশ্বের সম্পদ। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে কলকাতাকেন্দ্রিক যে চিত্রধারা চর্চিত ছিল, সেখানে লোকজ শিল্পের প্রভাব লক্ষণীয় ছিল না। আর কলকাতা ছিল কেন্দ্র। প্রত্যেক শিল্পীর আরাধ্য স্থানগুলোর একটা। আবেদিন স্যারও এর বাইরে ছিলেন না। তিনিও কলকাতায় গিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন, পড়েছিলেন এবং কলকাতাকে কেন্দ্র করে বিকশিত হতে চেয়েছিলেন। এবং সেই সময়ে বাংলার দুর্ভিক্ষ নিয়ে তাঁর অমিত চিত্রকর্মগুলো প্রকাশিত হয়। একটা অনন্য অধ্যায় রচিত হয়। দেশে-বিদেশে তিনি ব্যাপকভাবে আলোচিত হন, সুনাম অর্জন করেন। সেই পর্যন্ত আবেদিন স্যারের ভাবনা ও পরিকল্পনা ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক।
আর এদিকে আমাদের পূর্ববঙ্গের এ অঞ্চল ছিল একেবারেই লোকজ শিল্পচর্চার একটা পুণ্য অঞ্চল। এ অঞ্চলের লোকশিল্প যে রসগ্রাহী, উত্তম, আনন্দদায়ক তার পরিচয় পরে পৃথিবী পেয়েছিল। পঞ্চাশের দশকে তিনি এসে এই পূর্ববাংলার লোকজ শিল্পকলার গভীরতা, আধুনিকতায় তিনি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। লোকজ শিল্পকলার এই শক্তি তাঁর চোখ এড়ায়নি। জয়নুল আবেদিন লোকশিল্পের উপকরণগুলো গ্রহণ করে নিজস্বতার সঙ্গে মিলিয়ে একটা নতুন ধরন তৈরি করেছিলেন। এবং আমি মনে করি, পঞ্চাশের দশক জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলার শ্রেষ্ঠতম দশক। দুর্ভিক্ষ নিয়ে যে কাজগুলো ছিল, সেগুলো জয়নুলের স্বকীয় ধারার অন্যরকম উত্তম কাজ ছিল। কিন্তু যখন তিনি লোকজ উপকরণ নিজ শৈলীতে আত্মস্থ করলেন, নামে সুনামে তাঁর কাজগুলো আরও অনেক বেশি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে উঠল।
যদি তাঁর জীবানাচারের নানা দিকের বিচার-বিশ্নেষণে যাই, তো দেখতে পাই, তিনি নিজেকে তিনভাবে ব্যক্ত করেছেন। প্রথমত, আবির্ভূত হয়েছিলেন শিল্পী হিসেবে। এটা তাঁর নিজস্ব বড় জগৎ। সে জগৎ আমাদের চেনা।
দ্বিতীয়ত, তিনি প্রশাসক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ছাত্র-শিক্ষকদের একটা বলয়ে নিয়ে এসে তাঁদের শিল্প আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন, তাঁদের চালিত করেছেন। অধ্যক্ষ ছিলেন বিধায় তাঁকে প্রশাসন ও পাঠদান দুটি দিকই সযত্নে অবলম্বন করে চলতে হতো। সেই সময়ে সরকারের কাছ থেকে ঢাকা একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান তিনি আর্ট কলেজের জন্য আদায় করেছিলেন। তারপর সেখানে এত অপূর্ব একটা অবকাঠামো স্থাপন করতে পারা। এর পাশাপাশি তিনি শিল্পকলার ভাবনাকে প্রসারিত করে, এর ধারা বেগবান করে সবার মাঝে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রোথিত করতে তিনি লোকশিল্পকে শক্তি হিসেবে আশ্রয় করেছেন। এর লক্ষ্যে তিনি একটা সোনারগাঁয়ে ফোকভিলেজ তৈরি করলেন। কামার-কুমোর-সোনারু, নকশিকাঁথার শিল্পী সবাইকে এক করলেন। সবাইকে একটা কর্মক্ষেত্র দিলেন তিনি। এবং তার সঙ্গে ফোকভিলেজের ভেতর একটা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করলেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গগুলো তিনি একাত্তরের পর বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে তিনি আদায় করে নিয়েছিলেন। এ হলো তাঁর অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার দিক। এ ছাড়া দেশের মানুষের মাঝে শিল্পবোধ তৈরির একটা জোর চেষ্টা তাঁর গোটা কর্মকাণ্ডের ভেতর ছিল। শিল্পীদের একটা মর্যাদার জায়গায় তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।
তৃতীয়ত, তাঁর ছিল সুবিস্তৃত মানবিক দিক। একজন মানবতাবাদী শিল্পী হিসেবে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ একটা মন ছিল তাঁর। প্রাকৃতিক, কি মানবসৃষ্ট- যত ধারার দুর্যোগ মানুষের ওপর চেপে বসেছিল, তিনি একজন শিল্পী হিসেবে তাঁর সবলতার জায়গা থেকে মানুষকে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দিয়ে যেতে চেয়েছেন। মানুষের হয়ে তিনি মানুষকে সংবেদনশীলতার পাঠ দিতে চেয়েছেন। সাতচল্লিশের দুর্ভিক্ষের যে অঙ্কনগুলো ছিল তাঁর, সেখান থেকে শুরু। তারপর থেকে সমস্ত দুর্যোগ বা যুদ্ধে কোন বিষয়টি মর্মন্তুদ, মর্মস্পর্শী, মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তা তিনি চিত্রিত করে দেখিয়েছেন। মনপুরায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। বহু মানুষ, প্রাণী মৃত্যুবরণ করেছিল। তা নিয়ে তাঁর যে বিশাল স্ট্ক্রল তা অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি চিত্রিত করেছেন। পাকিস্তানি শাসকদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি যে আমাদের কেবল ছবির ব্যাকরণ শিখিয়েছেন তাই নয়, তিনি আমাদের দেশ চিনিয়েছেন, মানুষকে চিনিয়েছেন। শিল্পী হিসেবে আমাদের যে সমস্ত কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে যেতে হবে, তার সমস্তের পাঠ তিনি আমাদের দিয়ে যেতে চেয়েছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শিল্পীরা যাঁরা যুক্ত হয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন আবেদিন স্যারের ছাত্র। সেই সময় থেকে সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্ত আন্দোলনে যে শিল্পীরা সম্পৃক্ত হয়েছেন তার দীক্ষা কিন্তু আবেদিন স্যারের কাছ থেকে পাওয়া; তিনি ও তাঁর যে সহকর্মীরা ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে শেখা। কেবল ছবি আঁকতে শেখানোই কিন্তু তাঁর কাছে সম্পূর্ণ শিক্ষা ছিল না। এভাবেই আমাদের লেখাপড়া সম্পূর্ণতা পেয়েছিল।
আবেদিন স্যারকে আমি পেয়েছি, একজন অন্যরকম শিল্পী, একজন অন্যরকম মানুষ হিসেবে। তাঁর অবস্থান কিন্তু শুধু একজন শিল্পী হিসেবেই সমাপ্ত নয়। নেতা, অধ্যক্ষ ও মানুষ হিসেবে, সামাজিক মূল্যবোধের একজন নির্ধারক হিসেবেও তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।