ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

গৃহকর্মী নির্যাতন বাড়ছে মামলা কমছে

গৃহকর্মী নির্যাতন বাড়ছে মামলা কমছে

অলংকরণ :মোহাম্মদ মিলন

সালমা আলী

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ | ০৩:৪৯

আমরা যতই বলি না কেন আইন-বিচার পাওয়ার অধিকার সবার রয়েছে, এ জন্য মানবাধিকার সংগঠন বা সরকার অনেক কাজ করছে, বাস্তবতা হলো- এখনও গৃহকর্মীদের ওপর যে পরিমাণ নির্যাতন হচ্ছে, তার একটি বড় অংশই মামলায় যাচ্ছেন না। যেসব ক্ষেত্রে মামলা হচ্ছে, সেখানেও বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ তারা সমাজের পিছিয়ে পড়া একটি অংশ থেকে আসা।

বেশিরভাগ গৃহকর্মী নিয়মিত অল্প অত্যাচারের শিকার হন। তাদের মুখ বন্ধ থাকে। তারা পরিবারকে বলতে চান না। কারণ ওই পরিবারেও তো তাদের সুখকর অবস্থান ছিল না। অনেক সময় বাড়িতে তারা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন। আবার অনেকে তাদের নির্যাতনের কথা বলতে লজ্জাবোধ করেন। সে কারণে এ নিয়ে কাউকে কিছু বলতে চান না। এই না বলতে পারার কারণে তারা শারীরিকভাবে যেমন নির্যাতনের শিকার হন, তেমনি মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। নির্যাতন সহ্য করতে করতে একসময় এটি তাদের জন্য অভ্যাসে পরিণত হয়।

এমন অনেক ঘটনা আছে, যেখানে ওই গৃহকর্মীরা বাড়িতে ফিরে গেলেও তাদের ভয় দেখানো হয়, যাতে নির্যাতনের কথা প্রকাশ না করেন। পরিবারের লোকজনও অনেক সময় এ নির্যাতনের কথা জানেন, কিন্তু তারা সেই নির্যাতনের বিপরীতে অর্থ নিয়ে আপস করতে চান। এ ক্ষেত্রে নির্যাতনকারীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হয়- ধনাঢ্যদের সঙ্গে মামলা লড়ে পারা যাবে না। তার ওপর অনেক টাকা খরচ হবে। এর চেয়ে টাকা নিয়ে আপস করে ফেলাটাই ভালো।

এসব মামলায় বিচারের ঘটনা খুবই কম। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- কয়েক বছর আগে একটি মেয়েকে আমরা উদ্ধার করেছিলাম। তার শরীর দগ্ধ ছিল। বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা করানো হয়। আমরা তাকে ও তার পরিবারকে এমনভাবে রেখেছিলাম যে আসামিপক্ষ কোনোভাবেই তার সঙ্গে আপসের কথা বলার সুযোগ পায়নি। তবে এমন ঘটনা সব ক্ষেত্রে হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলা হয় না। মামলা হলেও এক পর্যায়ে তারা আপস করে ফেলেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখে। অনেক ক্ষেত্রে যখন তারা সেখান থেকে পরিবারে ফেরত যান, তখন পরিবারের লোকজনই আপস করতে তাঁকে চাপ দেন।

নতুন আইন করে গৃহকর্মী নির্যাতন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বড় কোনো নির্যাতন হলে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনেই মামলা হতে পারে। কিন্তু আমরা গৃহকর্মী নির্যাতনের পর নির্যাতনকারীকে বিচারের আওতায় আনতে পারছি না। আমাদের বিচারব্যবস্থায় অনেক সমস্যা রয়েছে। বিচারের অধিকার, তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অসুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। আদালতের তুলনায় মামলার সংখ্যা অনেক বেশি। বছরের পর বছর এসব মামলা ঝুলে থাকে। জেলা আদালতে যেসব মামলার রায় হয়েছে, সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত যেতে তার আট-দশ বছর লেগে যাচ্ছে।
গত প্রায় ২০ বছরে আমাদের অনেক অর্জন। আমরা এখন আইন থেকে শুরু করে বিচারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তার সুফল সেভাবে পাচ্ছি না। এখন মামলা করার প্রতিও অনেকের আগ্রহ থাকছে না।

গৃহকর্মী সুরক্ষায় মনিটরিং সেল নীতিমালায় বলা আছে- এলাকাভিত্তিক কাজ করতে হবে। এর মধ্যে মনিটরিং ও সচেতনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশনে প্রতিটি ওয়ার্ডে এ ব্যবস্থা থাকবে। একইভাবে প্রতিটি থানায় সমন্বিতভাবে এ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাঝে মাঝে কিছু বিষয়ে সোচ্চার হলেও কার্যত বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। মনিটরিং কাউন্সিলের কো-চেয়ার হিসেবে আমি যখন মন্ত্রী ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করি, তখন এ বিষয়গুলো উত্থাপন করি। এখানে যেমন সচেতনতার বিষয়ে বড় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না, তেমনি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও নেই। আবার মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ও সেভাবে দেখা যায় না।

এ ক্ষেত্রে ক্লাবগুলো একটি ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন- গুলশান লেডিস ক্লাব, ইস্কাটন লেডিস ক্লাব; তারা বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে কাজ করছে কিন্তু গৃহকর্মীদের বিষয়ে কথা বলতে চায় না। কারণ তাদের প্রায় সবার বাড়িতেই গৃহকর্মী রয়েছে। এমনকি ১২ বছরের কম বয়সী গৃহকর্মীও রয়েছে অনেকের বাড়িতে। যে কারণে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বেশিরভাগ মানুষ এ বিষয়ে চুপ থাকেন।

একসময় আমাদের দেশে মোটামুটি ধনী পরিবারে গৃহকর্মী থাকত। সেখানে কয়েকজন গৃহকর্মী একসঙ্গে থাকতেন। তারা যে কখনও নির্যাতিত হতেন না, এমন নয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই কম বয়সী মেয়েরা এক ধরনের নিরাপত্তা বোধ করত। এখন মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তরা কম টাকায় কম বয়সীদের কাজে নিয়োগ করছে।
যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রকাশ্যে আসে না। ভুক্তভোগী যখন পুড়ে যাবেন, মরে যাবেন বা খুন হবেন, তখন তা আলোচনায় আসে।

অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার দু-একটি ঘটনা হয়তো আলোচনায় আসে, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা আলোচনার বাইরে থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে ভয় দেখিয়ে, টাকা দিয়ে তাদের নির্যাতনে অভ্যস্ত করে ফেলা হয়। এসব ক্ষেত্রে নারীরা গৃহকর্মীদের ওপর বেশি নির্যাতন চালায়। ঘরের পুরুষটি হয়তো বলে দিয়েছেন- গৃহকর্মীকে যৌন নিগ্রহের বিষয়ে কোনো কথা বললে আরেকটি বিয়ে করবেন বা বিয়ে ভেঙে দেবেন। পুরুষকে আটকাতে না পেরে গৃহকর্মীকে নির্যাতন করেন ঘরের ওই নারী। কার্যত এটি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।

আমরা এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখানে ইতিবাচক মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা, পারিবারিক যৌথতা আগের মতো নেই। আগে একটি সামাজিক বলয়ের অধীনে ছিল পরিবার ও গৃহকর্মীরা। এখন পর্নো ভিডিও ও অপসংস্কৃতির প্রভাবে সমাজের মানুষের মানসিকতা অনেক বদলে গেছে। তারা এসব বিকৃতি সমাজের সবচেয়ে নিচের ধাপ থেকে আসা এই গৃহকর্মীদের ওপর প্রয়োগ করতে চায়। ধনী-গরিব বৈষম্য প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এখানে মানুষকে মানুষ হিসেবে নয়, বৈষম্যের নিক্তিতে মাপা হয়। এটি যখন বড় পরিসরে ঘটতে থাকে, তখন সেটিকে সামাজিক রোগই বলতে হবে।

গৃহকর্মী নির্যাতন রোধে সমাজের মানসিকতা বদলাতে হবে। এ জন্য রাষ্ট্র, সরকারকে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে দরকার গণসচেতনতা বাড়ানো। গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রে বাড়িতে থেকে কাজ করার চেয়ে চুক্তিভিত্তিক কাজ করাটাই বেশি ভালো। এ ক্ষেত্রে অন্য চাকরির মতোই প্রতিদিন কাজ করে তারা চলে যাবেন। তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এখন প্রশিক্ষণ শুরু করেছে। এর সঙ্গে মনিটরিং ও সচেতনতা কার্যক্রম শক্তিশালী করা সম্ভব হলে এমন নির্যাতন অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। 

লেখক :সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি

আরও পড়ুন

×