ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

বইয়ের ভুবন

ধর্ম-রাজনীতি-আত্মদ্বন্দ্বের আখ্যান

ধর্ম-রাজনীতি-আত্মদ্বন্দ্বের আখ্যান

মহাথের, লেখক-উপল বড়ুয়া, প্রকাশক-জাগতিক প্রকাশন, প্রচ্ছদ-রাজীব দত্ত, দাম-২০০ টাকা

লাবণী মণ্ডল

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০

উপল বড়ুয়ার ফিকশন ‘মহাথের’। এ রচনাকে ঠিক ফিকশন বলাও মুশকিল। রচনাশৈলী ঝরঝরে হলেও এখানে সরলের মাঝে জটিল-কঠিন দিকে পাঠককে ধাবিত করা হয়েছে। এ গ্রন্থ পড়তে গিয়ে যদি নিজেকে একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে পরিচয় দেওয়া না যায়, তাহলে খেই হারানোই স্বাভাবিক। তবে পাঠের রস আস্বাদন করতে সমর্থন হলে নিশ্চিতভাবেই এটি নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে।
প্রথম পাঠেই এ গ্রন্থের রহস্য উদ্ঘাটন করাটা কঠিন। মহাথের বৌদ্ধধর্মীয় পণ্ডিত ও সমাজসেবক। বইটির নামকরণের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এর রহস্য। বৌদ্ধ ধর্মগুরুর আত্মদ্বন্দ্ব নিয়ে বইটি লেখা হলেও, এর বর্ণনায় রয়েছে প্রাণ-প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের ছোঁয়া। হিমালয়ের পাদদেশে অরণ্যের অপূর্ব চিত্র রচনার মধ্য দিয়েই এ গ্রন্থের শুরু।
ভোরের সৌন্দর্য কতটা উপভোগ্য, স্নিগ্ধ; তা যারা কোনো গ্রামীণ জনপদে নদীর পাড়ে বাস করেন, তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন। একই সঙ্গে স্নিগ্ধতা পেরিয়ে দ্বন্দ্ব-প্রতিদ্বন্দ্বের যাত্রা শুরু হয়। সরলতার ভেতর যে গরল রাজনীতি তৈরি হয়; তা থেকে গ্রাম-শহর কোথাও মুক্ত নয়। শহরের কংক্রিটের ভেতর যেমন দ্বন্দ্ব-পরাজয় থাকে; গ্রামের ওই স্নিগ্ধতার ভেতরও নিজের সঙ্গে নিজের দ্বন্দ্ব। ধর্মের সঙ্গে ধর্মের; নিজের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার লড়াই থাকবে।
বৌদ্ধ ধর্মগুরুর এই আত্মদ্বন্দ্ব প্রাঞ্জল ভাষাশৈলী দিয়ে প্রকাশ করার যে নান্দনিকতা তা উপল বড়ুয়া সাবলীলভাবেই করতে পেরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, বিশ্বজুড়ে ধর্মের খেলা চলছে– রক্ত দিয়ে হোলি খেলা। একজনকে প্রতিষ্ঠিত করতে, আরেকজনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের খেলায় মেতে উঠেছে পৃথিবীর একাংশ। এতে এক দল অন্য দলকে দোষারোপ করছে খুনখারাবি-রাহাজানির জন্য। যেখানে এক ধর্মগুরুকে বিতাড়িত করে প্রতিষ্ঠিত হয় আরেকজন। পলায়ন করতে বাধ্য হয় একজন, প্রতিষ্ঠা পায় অপর গোষ্ঠীর ধর্মগুরু। এর বর্ণনা আগে-পরে অনেক ফিকশন-ননফিকশনে রচিত হয়েছে। কখনও তা বিষাক্ত মনোভাব তৈরি করেছে, কখনও বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি আদর্শিক অবস্থানের প্রকাশ ঘটেছে। এখানেই ‘মহাথের’-এর সার্থকতা। লেখক এই লোভ-লালসা-কামনা-বাসনা এবং জয়-পরাজয়কে তুলে ধরেছেন বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। যে কারণে পাঠকের ভেতর নতুন করে ক্ষোভের জন্ম হবে না। পাঠক তাঁর চিন্তাশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে উপলব্ধি করে নেবেন, এর দৃষ্টিভঙ্গিগত জায়গা।
উপন্যাসে নতুন নতুন শব্দের খেলা রয়েছে। যেগুলো হয়তো লেখকের নিজস্ব শৈলী তৈরি করতে সহায়তা করবে। প্রত্যেক লেখকের নিজস্বতা জরুরি। তা থাকলেই লেখা সাবলীল এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। বিশেষ একটি গোষ্ঠীর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি যেভাবে সেখানকার নদনদী, প্রাণ-প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছে, তা যেমন প্রকৃতিপ্রেমী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। তেমনি ভৌগোলিক বাস্তবতায় সভ্যতা চেনানোকে নির্দেশ করে। নদীর সঙ্গে মানুষের মেলবন্ধন ঘটানোর যে অপূর্ব নিদর্শন ‘মহাথের’ বইটিতে তা সত্যিই বিস্ময়কর। বাঁকখালীর নদীর যে বর্ণনা এ গ্রন্থে এসেছে, তা ওই জনপদের মানুষই উপলব্ধি করতে পারবেন। ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সেখানকার মানুষের মনস্তত্ত্বের মেলবন্ধন ফুটে উঠেছে।
দু’জন মানুষের একসঙ্গে একই তালে হেঁটে বেড়ানোর যে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন, তা পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে পড়বে হয়তো তিনি নিজেই হাঁটছেন কারও সঙ্গে, হয়তো বন্ধুর পাশে। নয়তো রাজনৈতিক সঙ্গীর পাশে। চলছে রাজনৈতিক আড্ডার সঙ্গে হাঁটার তাল। তিনি বর্ণনা করেছেন– ‘হাঁটতে হাঁটতে দু’জনের এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথাবার্তা চলতে থাকে। তারপর উভয়ে এক বৃক্ষের ছায়ায় এসে বসেন। সন্ন্যাসী থেকে ধার করা জল খান মহাথের। বিনিময়ে একদিন সেই জল ফিরিয়ে দিতে বলেন সন্ন্যাসী। মহাথের কথা দেন, একদিন তিনি এমন জল ফিরিয়ে দেবেন, যা পানে জগৎতৃষ্ণা মিটবে সন্ন্যাসীর। কিন্তু সন্ন্যাসী বলেন, যে জলটুকু এখন পান করছ সেই অকৃত্রিম জলটুকুই চায়।’
কথার এই যে মারপ্যাঁচের বর্ণনা– বিপরীতমুখে হাঁটতে থাকা মহাথের ও সন্ন্যাসী। এরপর আবার প্রকৃতির সান্নিধ্যে পাঠককে ফিরিয়ে নেওয়া। এই যে দ্বন্দ্বের মাঝ থেকে প্রকৃতির সন্ধ্যাতারার মাঝে ফিরিয়ে আনার বিশেষত্ব তৈরি করেছেন, এটিই হয়তো মহাথেরের সার্থকতা।
সন্ধ্যার নীরবতা। চৈত্রের দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃক্ষের যে খেলা, তার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। চৈত্রের ফাটল মাটি, যা ফেটে বের হয় গরম হাওয়া। যেখান থেকে প্রকৃতির প্রতি আক্রোশ বাড়ে, ক্ষোভ বাড়ে কোনো অদৃশ্য আত্মার প্রতি।
এর পরই জগতের সবকিছুকে উপেক্ষা করে নিজস্ব রাত তৈরি করা। যে রাতে ধ্যানে বসা যায়। জগতের সব কোলাহল বিদায় দিয়ে নিজের জন্য এক রাত তৈরি করা যায়, যার নাম মহারাত।
প্রকৃতির সঙ্গে নারীর যে যোগসূত্র; সেটিও উপস্থাপন করতে ভুলেননি উপল বড়ুয়া। তিনি দেখিয়েছেন– ‘... তার পাশে ক্ষীণকায়ার নদী। জ্যায়সি নারীর স্তনের মতো শুকনো। পাড় থেকে খানিক দূরে বেশ কয়েকটি বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। অল্পবিস্তর পাতা ঝরে যাওয়ায় তাদের বেরিয়ে আসা ডালপালাগুলো সন্ধ্যার নিচে ধারণ করেছে বিভিন্ন রূপ ...।’
মানবজগতের এই যে রূপ বদল। চক্রব্যূহের মাঝে ঘোরপাক খাওয়া। হারিয়ে ফেলার বৈশিষ্ট্য তা নতুন কিছু নয়। বস্তুর সঙ্গে প্রাণীর রূপ বদলানোর ইতিহাস পৃথিবীর জন্ম ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শাসনব্যবস্থাও চিরস্থায়ী নয়। কালে কালে পাল্টেছে এর শাসনকর্তারা। মানবজাতির পূর্বে যেভাবে শাসন হতো, সে ইতিহাসও লিপিবদ্ধ আছে ঐতিহাসিকদের লিখনে। এসব বদলে যাওয়ার ইতিহাসের সঙ্গে যে দ্বন্দ্ব-বিরোধের রূপ পাল্টেছে, যে পাল্টানোর গল্প ‘মহাথেরে’ রচিত হয়েছে।

আরও পড়ুন

×