ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

প্রচ্ছদ

এই বৈশাখ এই জ্যৈষ্ঠ

এই বৈশাখ এই জ্যৈষ্ঠ

জ্যাকারান্ডা, ছবি :: লেখক

মোকারম হোসেন

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৩ | ১৮:০০

এই জনপদে বৈশাখ বেশ রাজসিক ভঙ্গিতেই উপস্থিত হয়। বঙ্গাব্দের প্রথম মাস হওয়ায় চারপাশে একটা উৎসব আমেজ ছড়িয়ে থাকে। এ উৎসবকে আরও বর্ণাঢ্য করে তোলে মৌসুমের প্রধান তিন ফুল– জারুল, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়া। পুষ্পপ্রেমীদের আন্দোলিত করতে এই তিন ফুলই যথেষ্ট। বৈশাখের কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেলেই স্বর্ণচাঁপা, গন্ধরাজ, লাল সোনাইল, উদয়পদ্ম, কুরচি, কনকচূড়া, পালাম, পাদাউক– নানাভাবে প্রকৃতিকে রাঙিয়ে তোলে। কিন্তু প্রকৃতি সর্বদাই চঞ্চল। আপন গতিতে ছুটতে থাকে। প্রতিটি ঋতুর বিন্যাসকে ভেঙেচুরে আরেকটি নতুন ঋতুর কাছে নিয়ে যায়।
বৈশাখের প্রথমভাগে যে ফুলগুলো প্রকৃতিকে বর্ণিল করে তুলেছিল, সে ফুলগুলো জ্যৈষ্ঠের আগেই রং হারিয়ে বিবর্ণ হতে থাকে। বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডবে গাছতলায় ফুলের রোদন আমাদের মনকে ব্যাথাতুর করে। কিন্তু এই দৃশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না। জ্যৈষ্ঠের পরিচ্ছন্ন উদ্ভিদ ও প্রকৃতি প্রচণ্ড তাপদাহের বিপরীতে আমাদের মনে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। বৈশাখে ঝড়ের সঙ্গী হয়ে আসে বর্ষণ। এই বর্ষণসিক্ত বৃক্ষরাজি অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে ওঠে। যার রেশ বর্ষা-শরৎ ছাড়িয়ে হেমন্ত অবধি দৃশ্যমান থাকে। মধ্য-গ্রীষ্ম থেকে বর্ষার প্রথমভাগ পর্যন্ত প্রকৃতিকে আলাদা করে চেনা যায়। প্রকৃতির এই চিরচেনা রূপকে প্রত্যক্ষ করার জন্য গ্রামের কোনো বিকল্প নেই। নগরে যা অনেকটাই অধরা থাকে।
এবার একটি গ্রামের দিকে চোখ ফেরানো যাক। গ্রামের নাম হারিনাল। গ্রামে ঢোকার পথেই একটা বড়সড় পুরোনো দিঘি চোখে পড়বে। পাড়গুলো এতই উঁচু যে দূর থেকে দেখতে ছোটখাটো পাহাড় মনে হবে। আগে ঝোপ-জঙ্গলে ভরা ছিল। ভয়ে সবাই এড়িয়ে যেত। এখন মোটামুটি পরিষ্কার। চারপাশে বিচিত্র বুনোফুলের বন। দিঘির পানি স্বচ্ছ টলটলে। দিঘির তিন দিকে বেশ খোলামেলা। আর সে সুযোগে গ্রামের দুরন্ত শিশুদের পানির কসরৎ এখানে নৈমিত্তিক দৃশ্য। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের তপ্তদিনে এমন টলটলে পুকুরে শরীর জুড়াতে সবারই ইচ্ছা করে বৈকি! কম বসতির এই গ্রাম ততটা কর্মব্যস্ত নয়। বাজার থেকে সোজা পুবের সরু পথ ধরলে সিকদার বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া যায়। তারপর রাস্তাটা বাঁয়ে ঘুরে গিয়ে আবার পশ্চিম দিগন্তে মিশে গেছে। রাস্তার সঙ্গে সমান্তরালে এঁকেবেঁকে চলেছে একটি খাল। খটখটে রোদ্দুরে এখন পানিশূন্য। খালপাড়ে অসংখ্য বুনোফুল ফুটেছে। আছে দণ্ডকলস, রক্তদ্রোণ, মটমটিয়া, ধুতরা, কালকাসুন্দা, ছোট ঝুনঝুনি। দু-একটি গাছে অল্পসল্প কচিপাতা ঝুলছে। ডালে ডালে পাখিদের আনাগোনা; কাঁচা-সবুজ পাতার ফাঁক গলে পুবের বাঁশঝাড় বেয়ে সকালের রোদ নামে মাঠে।  
বোরো ধান উঠেছে দিন কয়েক আগেই। কোনো কোনো ক্ষেতে ডাল, বাদাম, সয়াবিন, মরিচ তোলার শেষ মুহূর্ত। ধানের মাঠগুলো আবার ফসলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শেষ-জ্যৈষ্ঠে কেবল একটা সরু সবুজ রেখা গজিয়েছে মাঠে। দখিনের আলুথালু হাওয়ায় ধান-পাটের শস্যশিশুরা দোল খাচ্ছে। মাঝে মাঝে চষা ক্ষেত থেকে ধুলা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দামাল বাতাস। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলে মাঠের নায়করা ফিরে আসে ঘরে। সারাদিন তাপ ঢেলে সূর্যদেব ঘরে ফিরলে দূরে দিগন্তরেখার কাছে দু-একটি বাতি জ্বলে ওঠে। মাঠের ব্যস্ততা তখন বটতলার চায়ের দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। এমন তপ্তদিনে বটতলায় ঝিরি ঝিরি বাতাসে একমাত্র স্বস্তি। রাতের প্রথম প্রহর পেরিয়ে গেলে ধীরে ধীরে গ্রামগুলো নিস্তব্ধতায় ডুবে যেতে যেতে শান্ত শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়ে। খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে থাকা এমন ছোপ ছোপ সবুজ গ্রামগুলোয় আমাদের নাড়ি পোঁতা। এমন মায়াবী গ্রাম ছেড়ে কি শহরে ফিরতে ইচ্ছে করে? তবুও আমাদের ফিরতে হবে নগর উদ্যানে। সেখানকার পুষ্পসখীদের অপার সৌন্দর্যে লীন হতে।
মধ্য গ্রীষ্মে জারুল, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়া জৌলুস হারালেও রেশ থেকে যায় আরও কয়েকটা দিন। এর মধ্যে কৃষ্ণচূড়া সবচেয়ে বেশি আবেদনময়ী। রবীন্দ্রনাথ তো বলেই দিয়েছেন–
‘গ্রামের পথে ক্ষণে ক্ষণে ধুলা উড়ায়,
ডাক দিয়ে যায় পথের ধারে কৃষ্ণচূড়ায়;...
এমনি করে বেলা বহে যায়,
এই হাওয়াতে চুপ করে রই একলা জানালায়।’     
বোঝাই যাচ্ছে কৃষ্ণচূড়া আমাদের দৃশ্যপট থেকে চটজলদি হারিয়ে যায় না। এই খরতাপে ঝড়-বৃষ্টি, শিলা-বিজলি-বজ্র মাথায় নিয়ে ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান থেকে ঘুরে আসা যাক। প্রবেশ পথের দ্বিতীয় ফটক পার হতেই ডানপাশে কয়েকটি গর্জন গাছ চোখে পড়বে। গাছতলায় পড়ে থাকা রাশি রাশি ঝরা ফুল নজরে পড়তেই গাছের আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে দেখি। সরল কাণ্ডের সুউচ্চ গাছ, একেবারই খাড়া, ফুলও বেশ ওপরে। আরেকটু এগিয়ে অফিস চত্বর লাগোয়া গোলাপ বাগানের ডানপাশে ট্যাবেব্যুইয়ার উৎসব দেখে অবাকই হলাম। অনেকগুলো গাছ, তাতে বর্ণিল পুষ্প প্রাচুর্য একেবারেই ধারণাতীত। অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা তাঁর ‘শ্যামলী নিসর্গ’ গ্রন্থে ঢাকায় যে দু-একটি ট্যাবেব্যুইয়া গাছের সন্ধান দিয়েছিলেন, তা এখন অতীত। ভেবেছিলাম ঢাকায় এ প্রজাতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু না, বোটানিক্যাল গার্ডেন গাছটিকে সংরক্ষণ করে নিশ্চিত বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছে।
ট্যাবেব্যুইয়া মাঝারি উচ্চতার গাছ, আমাদের দেশে দুটি প্রজাতি চোখে পড়ে। ত্রিপত্রিক এবং পঞ্চপত্রিক, কাণ্ড নাতিদীর্ঘ, ধূসর বর্ণ, অমসৃণ এবং শীর্ষ বিক্ষিপ্ত শাখা-প্রশাখায় এলোমেলো। পাতার আড়ালে ফুলেরা আচ্ছন্ন থাকে বলেই ফুলগুলো সহজে চোখে পড়ে না। তা ছাড়া ফোটার কিছু পরেই ফুল মাটিতে ঝরে পড়ে বলে ফুলে ঢাকা গাছতলাতেই শুধু পুষ্প প্রাচুর্যের সন্ধান মেলে। নির্গন্ধ হলেও ট্যাবেব্যুইয়া এই বৈশিষ্ট্যে শিউলি কিংবা কলকের ঘনিষ্ঠ। ফুল নিঃসন্দেহে সুন্দর : ভেরির আকৃতি, দল-প্রান্ত আন্দোলিত এবং ভেতর হলুদ ও বেগুনির মিশ্রণে উজ্জ্বল। ফল লম্বা, সরু ও ঘন বাদামি। বীজ ডিম্বাকৃতি। ফুল পূজার অর্ঘ্য ও নারীর কেশবিন্যাসের উপকরণ।
ঢাল বেয়ে ওপরে ওঠার আগেই দেখা পেলাম মধুগন্ধি কইনার ফুলের। কেউ কেউ চেনেন স্বর্ণ গন্ধরাজ নামে। তবে যে নামেই ডাকা হোক, এই ফুল বেশ সুগন্ধি। অফিস চত্বর থেকে বাম দিকে এসে আবার বাঁয়ে নেমে এলে পাওয়া যাবে বনআসরা। পাহাড়ের এই বৃক্ষ সেখানে রীতিমতো ঘন জঙ্গল তৈরি করে রেখেছে। কারুকার্যময় এ ফুল বেশ সুদর্শন। উদ্যানের মাঝামাঝি পুকুরপাড়ে আছে সুউচ্চ বান্দরহুলা। এই নিশিপুষ্পের ছবি তুলতে হলে ভোরে যেতে হবে সেখানে। এই উদ্ভিদ উদ্যানে মধ্য গ্রীষ্মের এমন আরও ফুলের কথা বলা যাবে।  
আমাদের চারপাশে থাকা এ সময়ের আরও কিছু ফুলের কথা আপনাদের জানিয়ে রাখি। অবাধ অথচ স্বাল্পকালীন প্রস্ফুটনের জন্য পাদাউক অনন্য। কোনো ভোরে হয়তো মঞ্জরির হলুদ ফুটেছে আলো হয়ে সারা গাছে, বাতাস ভরে উঠল মধুগন্ধে, কিন্তু পরদিন কোনো চিহ্ন কোথাও থাকবে না। এক দিনের ব্যবধানে নিঃশেষে মুছে যাবে সব রং, শুধু নিচে ছড়িয়ে থাকবে অজস্র ঝরা ফুলের হলুদ। স্বল্পায়ু প্রস্ফুটন সত্ত্বেও বর্ণে, ঔজ্জ্বল্যে, সুগন্ধের ঐশ্বর্যে, দেহসৌষ্ঠবের আভিজাত্যে পাদাউক তরুরাজ্যের অন্যতম অপ্রতিদ্বন্দ্বী বৃক্ষ। পাদাউক বিরাট, উঁচু বৃক্ষ। এর সুদৃশ্য বীথি রয়েছে হেয়ার রোডে। ঢাকার অন্যান্য স্থানেও বিক্ষিপ্তভাবে চোখে পড়ে। কাণ্ড সরল, বৃদ্ধি দ্রুত এবং ঘন পাতার নিবিড় আচ্ছাদনের কারণে এ গাছ পথতরু হিসেবেও আদর্শ।
আমাদের দেশে জ্যাকারান্ডার ইতিহাস একেবার সংক্ষিপ্ত নয়। কিন্তু সে তুলনায় বিস্তার লাভ করেনি। জলাবদ্ধতাই এ গাছের মূল হন্তারক। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে ঢাকার কয়েকটি বড় গাছ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উত্তর পাশে, ঢাকা বিডিআর-এর দক্ষিণ পাশের প্রবেশদ্বারের ডান দিকে কয়েকটি বড় জ্যাকারান্ডা চোখে পড়ে। ইদানীং রমনা পার্কসহ বিভিন্ন এলাকায় অপরিণত গাছ দেখা যায়। এ গাছ একহারা গড়নের, লম্বাটে, মসৃণ হালকা-ধূসর শরীর, কৃষ্ণচূড়ার মতো পাতা, তবে আরও চিরল চিরল, কারুকার্যময়। কিন্তু প্রথমে ওই পাতাগুলো কারও নজর কাড়বে না, চোখ ধাঁধিয়ে দেবে তার সারা গায়ে বেগুনি– নীল ফুলের বর্ণনির্ঝর। এবার কাঠগোলাপের কথা শোনা যাক। বিচিত্র রং ও গড়নের এই ফুল দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি সুগন্ধিও। এসব কারণে তার নামও অনেক– গুলাচি, গরুড়চাঁপা, চালতা গোলাপ, গোলকচাঁপা ইত্যাদি। শীতকালে গাছের সব পাতা ঝরে পড়ার পর বসন্তের শেষ দিকে দু-একটি করে ফুল ফুটতে শুরু করে। তখন গাছে একটিও পাতা থাকে না। অবশ্য বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসেই পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয় তার রূপ। তখন গাছজুড়ে শুধু ফুলের উৎসব। গ্রীষ্মকাল ছাড়িয়ে বর্ষা ঋতু পর্যন্ত কাঠগোলাপের এমন সৌন্দর্য অটুট থাকে।
বৈশাখের এতগুলো ফুলের কথা বলেছি, যদি স্বর্ণচাঁপার কথা না বলি তাহলে কিছুটা অপূর্ণই থেকে যায়। এই ফুলের শোভা ভারি স্নিগ্ধ। সোনালি রঙের পাপড়িগুলো বেশ তুলতুলে, কোমল। এসবের সঙ্গে আছে দারুণ সুবাস। পাতার তুলনায় ফুলগুলো ছোট। তা ছাড়া ফুলগুলো ফোটেও বেশ উঁচুতে। এ কারণে স্বর্ণচাঁপার ফুল চট করে আমাদের চোখে পড়ে না। চোখে না পড়লে যে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না– এমন কোনো কথা নেই। তার চমৎকার মধুগন্ধই আমাদের তার কাছে নিয়ে যায়। স্বর্ণচাঁপা বর্ষাকাল ছাড়িয়ে মাঝে মাঝে শরৎকালেও দু-চারটি ফুটতে দেখা যায়। ফুল ঝরে পড়ার পর আঙুরের মতো থোকা থোকা ফল ধরে।
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে শালবনের খোলা জায়গায় যেখানে শুধু মোটা ঘাস ছাড়া কিছুই থাকে না, সেখানে হলদে মাথা ছোট্ট ডাঁটির ওপর শটি ফুল দুর্লভ সৌন্দর্য ছড়ায়। বৈশাখের শেষ দিকে নতুন পাতা গজাবার আগে এ ফুল দেখা দেয়, আবার কিছু পাতা বের হবার পরও দেখা যায়। দেশের বিস্তীর্ণ লাল মাটির শালবন অঞ্চল, পাহাড়ের পাদদেশ ও পথের ধারে আপনাআপনিই জন্মায়। জনবহুল এলাকা শটিগাছের পছন্দ নয়। সাধারণত প্রাকৃতিক বনবাদাড়েই ওদের জন্ম ও বৃদ্ধি স্বাভাবিক। বছরের বেশিরভাগ সময় শটি ফুলের দেখা পাওয়া যায় না। তখন অসংখ্য লম্বাটে পাতার ঠাসবুননীতে ঝোপাল থাকে। কিন্তু বসন্ত বা গ্রীষ্মের এক পশলা বৃষ্টিতেই ওদের কন্দমূলে এক ধরনের শিহরণ বয়ে যায়। তখন মাটি ভেদ করে একটি লম্বা মঞ্জরিদণ্ড বেরিয়ে আসে। এ সময় শটি ঝোপগুলো বিচিত্র আভায় সুশোভিত হয়ে ওঠে।  
শটি দেখতে হলুদ গাছের মতোই, বর্ষজীবী গুল্মজাতীয় গাছ। সাধারণত এক মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। লালচে-বেগুনি রঙের ব্রাক্টের ভেতর হলুদ রঙের ছোট ছোট ফুল থাকে। গাছের গোড়ার কন্দ বা গেড় কর্পূরগন্ধি, মাটির নিচে সমান্তরালভাবে আদা বা হলুদের মতো ছড়ান স্বভাব। ছয়শ শতাব্দীর দিকে আরবদের মাধ্যমে গাছটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
স্পাইডার লিলি বর্ষার ফুল হিসেবে পরিচিত হলেও মূলত জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি সময় থেকেই ফুটতে শুরু করে। গ্রামে ফুলটির নাম গো-রসুন। কবিরাজরা লিভারের চিকিৎসায় (!) গাছটির গোড়ার কন্দ ব্যবহার করেন। এভাবেই গ্রামের বনবাদাড় থেকে গাছটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। ঠাঁই করে নিয়েছে নগর উদ্যানে। এমনকি পুষ্পপ্রেমীদের এক চিলতে বারান্দা কিংবা ছাদবাগানেও পৌঁছে গেছে সুগন্ধি এই ফুল। টবে চাষযোগ্য হওয়ায় এ ক্ষেত্রে আরও বাড়তি সুবিধা। ফুলের গড়ন মাকড়সার জালের মতো বলেই সম্ভবত স্পাইডার লিলি নামকরণ। জন্মস্থান দক্ষিণ আমেরিকা হলেও বর্তমানে আমাদের প্রকৃতিতে বুনো পরিবেশেই জন্মে।
গাছ পেঁয়াজকন্দীয়, গোড়ায় গুচ্ছবদ্ধ পাতাসহ ৩০ থেকে ৬০ সেমি পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। মঞ্জরিদণ্ডের আগায় ৬টি সরু ফিতার মতো পাপড়ি, গোড়ায় কাগুজে বাটি বা মুকুটে জড়ানো। বর্ষার ভেজা বাতাসে ফুলের তীব্র মধুর গন্ধ ভেসে বেড়ায়। ফুল ফোটা শেষ হলে শরতে গোড়ার কন্দ দিয়ে আবার চাষ করা যায়।
আগেই বলে রাখা ভালো, নাইটকুইন বা নিশিপদ্ম কোনো বিরল প্রজাতির ফুল নয়। তবুও এ ফুল নিয়ে পুষ্পপ্রেমীদের অনেক উৎসাহ। আদতে নাইটকুইন অতটা হইচই করার মতো কোনো ফুল নয়। এমন নিশিপুষ্প আমাদের চারপাশে অনেক ফোটে। ঘরে থাকে না বলে অবলোকনের সুযোগ হয় না।
সাধারণত টবেই এদের চাষ ও বিস্তৃতি। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শৌখিন পুষ্পপ্রেমীদের বাসায়। গাছ ক্যাকটাস গোত্রীয়। মসৃণ ও কণ্টকহীন। যথারীতি পাতা নেই, রূপান্তরিত কাণ্ডই পাতার কার্য সম্পাদন করে। গাছের গোড়া শক্ত, ডাঁটার মতো। অনেক শাখা-প্রশাখা। সবগুলোই চ্যাপ্টা ফিতা আকৃতির, তাতে সবুজ রঙের শিরা সুস্পষ্ট। প্রায় সারা বছরই নিষ্প্রাণ থাকে। জ্যৈষ্ঠ মাসের দিকে এক পশলা বৃষ্টির ছোঁয়া পেলেই প্রস্ফুটন প্রস্তুতি শুরু হয়। সাদা রঙের সুগন্ধি ফুল ফোটে কিনার থেকে। একটি গাছে পর্যায়ক্রমে একাধিক ফুলও ফুটতে পারে। পাপড়ি ও পুংকেশরের সংখ্যা অনেক। সাধারণত ফল হয় না। তবে কোনো কোনো ক্যাকটাসে রসাল ও রঙিন ফল হয়। ফিতাকাণ্ড মাটিতে পুঁতলেই বেঁচে যায়, এভাবে চাষ। ছায়া ও রোদ দুটোই পছন্দ।
শুধু এ ক’টি ফুলই নয়, মে থেকে জুন মাসের প্রথম ভাগে আমাদের প্রকৃতিতে আরও ফোটে ডুলিচাঁপা, কেও, কনকচূড়া, সোনালি শাপলা, বেলি, গন্ধরাজ, কয়েক রকম লিলি, চালতা ফুল, চামেলি ইত্যাদি। আমাদের অলক্ষে বন-পাহাড়ে আরও কত যে ফুলের সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে, তার সঠিক হিসাব জানা নেই।

আরও পড়ুন

×