লোকগানের ফিউশন

রাসেল আজাদ বিদ্যুৎ
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৩ | ১৮:০০
আমাদের লোকগান শুধু ইতিহাস, ঐতিহ্যের ধারক-বাহক নয়, সৃষ্টির মহিমায় সমকালীন। এর বাণী ও সুরে মিশে থাকা সুধা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে শ্রোতাকে। তাই সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া সংগীতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লোকগানের সুর। লোকগানের ফিউশন নিয়েই আয়োজন
বাউল, বৈষ্ণব, সাধকের সুর-পরশে মোড়া কথাগুলো আজও আমাদের কাঁদায়-হাসায়-ভাবায়। শিকড়সন্ধানীরা তাই স্বীকার করেন– এ কেবল গান নয়, সুরের মায়াজালে বন্দি এক জীবনদর্শন। যে কারণে লোকজ বা শিকড়ের গান সময়ের পরিক্রমায় হয়ে উঠেছে একেকটি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। সময়কে ছাপিয়ে কিছু লোকগান হয়ে উঠেছে চিরকালের। সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে আজও তাই অনুরণন তুলে যাচ্ছে শ্রোতার মনে। সেসব গানের গীতিকথায় উঠে এসেছে আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ, সমাজ বাস্তবতা, দ্রোহ, আধ্যাত্মিকতা কিংবা চেনা জীবনের নানা অধ্যায়ের দৃশ্যপট। হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে সুরের ছন্দ। অন্যদিকে সময়ের পালাবদলে সংগীতে এসেছে নতুনত্ব। যে কারণে সংগীতায়োজকরা কালজয়ী গানগুলো নতুন সংগীতায়োজনে তুলে ধরছেন শ্রোতার কাছে, যাকে আমরা বলি ফোক ফিউশন। সময়ের পালাবদলে এই ফোক ফিউশনের আবেদন দিন দিন বেড়ে চলেছে।
একসময় ফোক ফিউশন আয়োজন অ্যালবামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দিলরুবা খানের ‘পাগল মন’, সেলিম চৌধুরীর ‘আজ পাশা খেলব রে শ্যাম’, ডলি সায়ন্তনীর ‘কালিয়া’, ‘এক জনমে’, ফিডব্যাকের ‘বাউলিয়ানা’, বাংলা ব্যান্ডের ‘প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব’, ফিডব্যাক ও আবদুর রহমান বয়াতীর ‘দেহঘড়ি’, হাবিব ওয়াহিদের সংগীতায়োজনে ‘কৃষ্ণ’, ‘মায়া’, বাপ্পা অ্যান্ড ফ্রেন্ডসের ‘বেনানন্দ’সহ গত তিন দশকে অসংখ্য ফোক ফিউশন অ্যালবাম শ্রোতাদের মাঝে সাড়া ফেলেছে। এর বাইরেও সিরিজ মিক্সড অ্যালবাম ‘রঙ্গমেলা’, ‘ভবের মায়া’ এবং দ্বৈত ও একক আয়োজনের বিভিন্ন শিল্পী লোকগানের মধ্য দিয়ে শ্রোতার প্রশংসা কুড়িয়েছেন। পপ স্টার আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ থেকে শুরু করে রকতারকা আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, পার্থ বড়ুয়া, রেশাদের কণ্ঠে যেমন ফোক ফিউশন শোনার
সুযোগ পেয়েছেন শ্রোতারা; তেমনি নন্দিত প্লেব্যাক শিল্পী এন্ড্রু কিশোর, খালিদ হাসান মিলু, বেবী নাজনীন, কনকচাঁপা, রিজিয়া পারভীনসহ অন্য শিল্পীদেরও ফোক ফিউশন অ্যালবামের জন্য গাইতে দেখা গেছে। তাঁদের পাশাপাশি মমতাজ, ডলি সায়ন্তনীসহ আর কিছু শিল্পী ধারাবাহিকভাবে ফোক গান গেয়েছেন। অংশ নিয়েছেন ফিউশনধর্মী নানা আয়োজনে। লোকসুরের টানে দূরে সরে থাকতে পারেননি নকীব খান, বিপ্লব, টিপু, পান্থ কানাই, পথিক নবী, বাপ্পা, অর্ণব, হাবিবের মতো আলোচিত শিল্পী এবং ফিডব্যাক, রেনেসাঁ, সোলস্, বাংলা, লালনের মতো ব্যান্ড।
একুশ শতকে এসে বিউটি, কনা, সালমা, ইমরান, ঐশী, বিন্দুকনাসহ তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরাও ফোক ফিউশন আয়োজনে মেতে উঠেছেন। এদিকে অ্যালবাম প্রকাশনা সীমিত হয়ে আসা এবং গান প্রকাশের মাধ্যম বদলে যাওয়ায় অনলাইন হয়ে উঠেছে সংগীতের বহুমাত্রিক আয়োজনের অন্যতম প্ল্যাটফর্ম। যেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে ফোক ফিউশনধর্মী পরিবেশনা, যার সুবাদে আলোচনায় এসেছে ‘কোক স্টুডিও বাংলা’, ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’, ‘আইপিডিসি আমাদের গান’, ‘সিলন মিউজিক লাউঞ্জ’, ‘ফোক স্টেশন’-এর মতো আয়োজনগুলো। যেখানে নন্দিত তারকা শিল্পীর পাশাপাশি তরুণরাও নতুন সংগীতায়োজনে কালজয়ী গানের পরিবেশনা দিয়ে দর্শক-শ্রোতার মনোযোগ কেড়েছেন।
অনলাইন যুগে এসেও মৌলিক গানের পাশাপাশি ফোক ফিউশন ছিল চোখে পড়ার মতো। চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওনের ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’, ‘নিশা লাগিলো রে’, শফি মণ্ডলের ‘মনআমার দেহ ঘড়ি’, নাদিয়া ডোরার ‘আমার অন্তরায় আমার কলিজায়’, ‘প্রাণ সখিরে’, লায়লার ‘জাত গেল’। এর বাইরেও ফজলুর রহমান বাবুর ‘দোল দোল দুলুনি’, জলের গানের ‘ইসকুল খুইলাছে রে মওলা’, ‘পরের জাগা পরের জমিন’। একইভাবে নতুন সংগীতায়োজন ছাড়াও ফোক ও আধুনিক গানের মিশ্রণে ফিউশন তৈরি করতেও দেখা গেছে। ভিন্নধর্মী সেসব আয়োজনের ‘নাসেক নাসেক’ [অনিমেষ রায়, পান্থ কানাই], ‘সব লোকে কয়’ [শিল্পী কানিজ খন্দকার মিতু, মুসশিদাবাদী, জান্নাতুল ফেরদৌস আকবর ও রুবাইয়াৎ রেহমান], ‘প্রার্থনা’ [শিল্পী মমতাজ বেগম ও মিজান], ‘পাগলা ঘোড়া রে’ [শিল্পী কুদ্দুস বয়াতী], ‘লীলাবতী’ [শিল্পী ওয়ার্দা আশরাফ, আরমিন মুসা, নন্দিতা, মাশা প্রমুখ], ‘ভবের পাগল’ [শিল্পী নিগার সুলতানা সুমি ও জালালি সেট]-সহ বেশ কিছু গান শ্রোতাদের মনোযোগ কেড়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, ফিউশনধর্মী আয়োজনে লোকগানকেই প্রাধান্য দেওয়ার কারণ কী? এর উত্তরে শিল্পী বাপ্পা মজুমদার বলেন, যে গানের আবেদন হাজার বছরেও ম্লান হয়নি, সেই মাটির গান থেকে যাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এই গানের মাহাত্ম্যই মূলত নতুন সংগীতায়োজনে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরা হচ্ছে।’ মাকসুদুল হকের কথায়, ‘আত্মপরিচয় যেমন ভুলে থাকা সম্ভব নয়, তেমনি গানের বিষয়েও শিকড়কে ভুলে থাকা সম্ভব নয়। আর লোকগানই হলো আমাদের শিকড়।’