প্রচ্ছদ
প্রেরণার মধু

আফসান চৌধুরী
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
মুনীর চৌধুরী
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ইলিয়াস ভাইয়েরে সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। তবে সেই ঘনিষ্ঠতা ঠিক সাহিত্যিক স্তরের ছিল না। তবে তিনি আমার সম্পাদকের ভূমিকায় ছিলেন। ইউপিএল এর রিডার ছিলেন তিনি সুতরাং তাঁর মন্তব্য ছিল প্রতিষ্ঠান ও লেখকের জন্যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কয়দিন আগে আমি খুঁজে পেয়েছি তিনি কী লিখেছিলেন আমার লেখা সম্বন্ধে এবং আমি তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করে কী প্রত্যুত্তর দিয়েছিলাম। ইলিয়াস ভাইয়ের সাহিত্য অমূল্য। তবে একটা দুটো ব্যতিক্রম বাদে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে তা সেভাবে স্পর্শ করেছে বলতে পারব না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস নিয়ে সবাই বেশ সরব। কিন্তু আমার কাছে তাঁর গল্পগুলোকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন বইয়ের ফেরা গল্পটা যেমন বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ, তেমনই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মিলির হাতে স্টেনগান। এই একটা গল্প আমাকে বছরের পর বছর তাড়া করে ফিরেছে। আমরা যারা সত্তর দশকে বেঁচেছি, মিলির হাতে স্টেনগানকে আমরা বুঝতে পারি। এ গল্প অতুল কারণ আমি চোখের সামনে দেখেছি ওই পাগল ভালো হয়ে যাচ্ছে আর মিলি অসুস্থ হয়ে পড়ছে, মিলি তাকে স্টেনগান দিতে চাইছে। আমরা যারা সত্তর দশকে কষ্ট পেয়েছি, ক্ষুব্ধ হয়েছি, মনে হয়েছে এ গল্পটা বিশেষভাবে তাদের। সৈয়দ শামসুল হক তৃতীয় যদি বলতে হয়, সৈয়দ শামসুল হকের নাম আসবে। হক ভাইয়ের একটা বই আমাকে ভীষণরকম নাড়া দিয়েছে : বৈশাখে রচিত পঙতিমালা। স্বাধীনতার আগে প্রকাশিত এ বই এখনো যখন পড়ি, একটা কথা মনে হয়— এ বই অসাধারণ রকমের আধুনিক। শুধু ইমেজারি না, যে বিষয়গুলো তিনি তখন কবিতায় এনেছেন; লোকে গালও দিয়েছে; সেই বিষয়গুলো কিন্তু সাহিত্যে তখনো আসত না। তিনি অকপটে বলে গেছেন এবং সেই লেখায় প্রকাশিত তাঁর কষ্ট, আনন্দের প্রায় সবটাই আমি ধরতে পারি। এজন্যেই বইটা যখন আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে শুরু করলাম; অনেকদিন ধরে অনুবাদ করেছি; তখন মনে হচ্ছিল, আমি বোধহয় ওনাকে ধরতে পারব। ভালো লাগা থেকে অনুবাদ করছিলাম। বই হওয়ার আগে যখন ওনাকে পড়ে শোনাতাম, হক ভাই বলতেন, ‘আফসান, আপনি যা করবেন ঠিক আছে।’ আমার বিশ্বাস আমি গভীরে পৌঁছাতে পেরেছি আর সে কারণে নিছক অনুবাদ করিনি। আমার এক বন্ধু আছে, যুদ্ধবন্ধু, সোলেমান। আমার উপন্যাস ‘রক্তের মেহেন্দি দাগে’ তার কথা আছে। যেদিন বুঝতে পারলাম সোলেমানের পা চলে যাওয়ার পর হাতও চলে গেছে, সেদিন আমি আমার জীবনের একটা ভয়াবহতম দিন কাটালাম। বাসায় ফিরে এসে, ঘুমানোর তো প্রশ্নই আসে না, চুপ করে বসেছিলাম। আমার ডায়বেটিস আছে। ডায়বেটিক ট্রেমর হয়। আমার হাতটা ট্রেমর হচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম সোলেমান আর আমি বোধহয় এক হয়ে যাচ্ছি। প্রচণ্ড কষ্ট দুঃখবোধ থেকে আমি লিখতে শুরু করেছিলাম। ওই রাতে, আমার লেখা ছাড়া উপায় ছিল না। সোলোমানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হলেও আমাকে লিখতে হতো। আমি যখন লিখছিলাম, (ইংরেজিতে লিখেছি- ইংরেজি আমার প্রথম ভাষা। তারচেয়ে বড়কথা বাংলা আমি হাতে লিখে উঠতে পারতাম না। আমার কম্পিউটার ছিল। সেখানেই ইংরেজিতে লিখতে শুরু করেছিলাম) যে ফর্মটা আমি বেছে নিলাম আশ্চর্যজনকভাবে সেটা ছিল কবিতার ফর্ম। কিন্তু আমি তো কবিতা লিখি না! কবিতা কেন উপস্থিত হলো? সেই রাতে কবিতা ছাড়া আমাকে আর কিছুই আমাকে মুক্তি দিতে পারত না। আমি লিখেই যাচ্ছিলাম। একসময় সোলেমানের কথা শেষ হয়ে গেল। এরপর আমি নিজের কথা লিখে যাচ্ছিলাম। তখন আমি হক ভাইয়ের কাব্য শৈলী দিয়ে প্রভাবিত হয়েছি। লেখাটা কনভার্সেশন উইথ সোলেমান নামে বের হয়। ওটা ছিল আমার স্মৃতির স্মৃতিচারণ। হাসান হাফিজুর রহমান একজন মানুষকে বোধহয় আমি আমার বাবার চেয়ে বেশি ভালো বেসেছিলাম। তাঁর মৃত্যুতে আমি দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে গিয়েছিলাম, মাটিতে গড়িয়ে কেঁদেছিলাম। তিনি হাসান হাফিজুর রহমান। হাসান ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ ছিল আর কোনো মানুষের সঙ্গে ততোখানি ছিল না। আমরা সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতাম। কখনো তাঁর লেখা পড়ে বিশেষ কোনো অংশ ধরে বলতাম, ‘আপনার এই জায়গাটা হয়নি।’ হাসান ভাই পাল্টে দিতেন। এইরকম সম্পর্ক তো সবার সঙ্গে হয় না, হবেও না। হাসান ভাই যখন মারা গেলেন, আমি আর মাহফুজুল্লাহ ভাই বিচিত্রা অফিসে সারাদিন চুপ করে বসেছিলাম। তিনি আমাকে হাসান হাফিজুর রহমানের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন ইতিহাস প্রকল্পে চাকরিটা দেওয়ার জন্য। তিনি বলছিলেন, ‘মানুষ সবাই যায়। মানুষ সবাই যায়।’ মাহফুজুল্লাহ ভাইও একদিন চলে গেলেন। হাসান হাফিজুর রহমান মারা যাওয়ার পর মাহফুজুল্লাহ ভাই বলেছিলেন, ‘ছাদ চলে গেলে কেমন লাগে আমি জানি।’ আমিও অনুভব করছিলাম সেদিন, আমার ছাদটা আর নেই। আমার জীবনের সমস্ত শিক্ষা, অর্জন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে। আমার বেঁচে থাকা, কষ্ট করা, কষ্ট পেরিয়ে ওপরে ওঠা- সব মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ঘিরে। এটা হাসান ভাই না থাকলে হতো না। তিনি আমাকে সন্তানের মতো ভালোবাসতেন? আমি জানি না। তিনি আমাকে ভালোবাসতেন এটা আমি জানি। আর জানি, আমি তাঁকে ভালোবাসতাম।
- বিষয় :
- প্রচ্ছদ
- আফসান চৌধুরী