ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

প্রচ্ছদ

প্রেরণার মধু

প্রেরণার মধু

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০

মুনীর চৌধুরী

 এখনকার দিনে গণমাধ্যমের সাধারণ চিত্র—পক্ষেবিপক্ষে তর্কবিতর্ক চলছে তো চলছেই। একটা সাধারণ চিত্র যদি আঁকতে চাই তো এক ধরনের টক শোর ছবি ফুটে ওঠে। টকশোতে যেমন উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলতেই থাকে, গণমাধ্যমেও তাই। পরিবারের সবাই মিলে দেখা যায় না। স্বাধীনতার আগে কিন্তু এমন অনেক অনুষ্ঠান হতো যেগুলো পরিবার নিয়ে দেখা যেত। স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান হতো, সঞ্চালনা করতেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী, একটা অনুষ্ঠান হতো বই নিয়ে। আমার সবচেয়ে প্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ওটা। সঞ্চালনা করতেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। আমার লেখক, গবেষক জীবনের প্রেরণাদের মাঝে তিনি একজন। আমি মনে করি আমার জীবনে মুনীর চৌধুরীর অবদান খুব বড়। তাঁর বড় ছেলে ভাষণ আমার সহপাঠী। মিশুক, তন্ময়- ওরাও অনেক আদরের। ওদের আমি ছোট ভাই জ্ঞান করি। মিশুকের মৃত্যুতে আমি এতো কষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করার নয়। যে সময়ের কথা বলছি তখন ঢাকা কলেজে পড়ি ও সাহিত্যে আগ্রহী। তখনো কাউকে তেমন চিনি না বা জানি না। বন্ধুরা মিলে একটা সাহিত্যকাগজ বের করার চেষ্টা করি, নাম— পূর্বপত্র। এটা বেশ কিছুদিন বের হয়েছিল। স্বাধীনতার পর তিয়াত্তর চুয়াত্তর সাল পর্যন্ত চলেছিল মনে আছে। বই পরিচিতির সেই অনুষ্ঠানে মুনীর চৌধুরী স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন বই নিয়ে সম্যক আলোচনা করতেন। এমন নাটকীয় আর নান্দনিক ছিল তাঁর উপস্থাপন যে বইগুলো ভীষণ আপন হয়ে উঠত। একদিন এক বই নিয়ে আলোচনা করলেন, লেখকের নাম প্রায় অজানা। আলোচনা-সমালোচনাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেলেন আমি যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে গেলাম। আঠার উনিশ বছরের একটা ছেলে আমি তখন। শুনে স্তম্ভিত হয়ে ভাবছিলাম, এই বই আমার চাই। কালই কিনতে হবে। লেখকের নাম হাসান আজিজুল হক। বইটির নাম আত্মজা ও একটি করবী গাছ। মুনীর চৌধুরী যখন আত্মজা ও একটি করবী গাছ অর্থাৎ নামগল্পটা পড়ছিলেন, তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। সেই যে পড়েছিলেন— ‘এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন কাঁদতিছ তুমি?’— আজও আমার কানে বাজছে। পরদিন কলেজে আমার বন্ধু হাসান ফেরদৌস, ওয়াসি আহমেদ ওদের বললাম, ‘এই লেখকের নাম শুনেছ?’ সেভাবে শোনেনি কেউ। আমরা গিয়ে নিউমার্কেট থেকে বইটা কিনলাম এবং পড়া শুরু করলাম। হাসান আজিজুল হক বোধহয় বাংলাদেশের প্রথম লেখক যিনি বাংলাদেশের সাহিত্যকে আমার হৃদয়ে নিয়ে এলেন। সেদিক থেকে কার প্রভাব বলব? হাসান আজিজুল হক তো বড় লেখক সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাকে তাঁর কাছে পৌঁছে দিলেন যিনি, আমার জন্য তিনিই বড় প্রভাবক। মুনীর চৌধুরী। মুনীর চৌধুরী দ্বিতীয় আরেকটা কাজ করলেন(আমি ষাটের দশকের শেষদিকের কথা বলছি। সাতষট্টি থেকে উনসত্তরের ভেতর হতে পারে), তিনি ফায়েজ আহমেদ ফায়েজের কবিতা পড়ে শোনালেন। কবিতাপাঠ শোনাও অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল। প্রথম যে কবিতাটি তিনি পড়েছিলেন সেটি হলো— মুঝ সে পেহলি সি মোহাব্বাত মেরে মেহবুব না মাঙ। আমার কাছ থেকে প্রথম প্রেমের মতো প্রেম চেও না প্রিয়তমা। অসম্ভব মানবতাবাদী কবিতা। মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আমার টুটাফুটা উর্দু দিয়ে আমি পড়ছি।’ তাঁর সেই পাঠ আমাকে এতোটাই টেনেছিল যে আমি আজও মাঝেমধ্যে সেই কবিতা শুনি। আমার একটা লেখা আছে ফায়েজ আহমেদ ফায়েজের ওপর। আমার যত লেখা আছে তার ভেতর ওটাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি প্রচারিত। দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক জায়গায় কয়েকজন শিক্ষক আমাকে বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ভাবনা নিয়ে পড়ানোর অংশ হিসেবে আমরা এই লেখাটা পড়াই। আমার যাত্রাটা শুরু হয়েছিল মুনীর চৌধুরীর সেই অনুষ্ঠানে। এবং আমার সর্বশেষ লেখা ‘রক্তের মেহেন্দি দাগ’ ‍উপন্যাসের সূত্র যদি কেউ খুঁজতে যান তো আমি বলব, তা ফায়েজ আহমেদ ফায়েজের কবিতা। আমার পরিকল্পনা, একটা উর্দু কবিতা বই লিখে যাব। উর্দু কবিতায় যে গভীরতা আসে, বাংলায় তা আসে না বলেই মনে হয় আমার। আমি আমার তিনটি ভাষা জানার জায়গা থেকে এ মন্তব্য করছি। আমরা একটা ভাষা নিয়েই গৌরব করতে শিখি, নিজ মাতৃভাষা। অন্য ভাষার সুষমা সম্পদ জানার, গ্রহণের ক্ষেত্রে যে উৎসটা সবচেয়ে বেশি অবহেলা পায় তা আসলে সাহিত্য। কত ভাষার যে সাহিত্য আছে! সব ইংরেজিতে এসে স্থান পাচ্ছে বলে ভগ্নাংশ জানার সুযোগ হচ্ছে আমাদের। যাহোক। নিজ ভাষা থেকে শুরু করে বিবিধ ভাষার প্রতি আমার যে অভিযাত্রা, তা শুরু করে দিয়েছিলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ইলিয়াস ভাইয়েরে সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। তবে সেই ঘনিষ্ঠতা ঠিক সাহিত্যিক স্তরের ছিল না। তবে তিনি আমার সম্পাদকের ভূমিকায় ছিলেন। ইউপিএল এর রিডার ছিলেন তিনি সুতরাং তাঁর মন্তব্য ছিল প্রতিষ্ঠান ও লেখকের জন্যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কয়দিন আগে আমি খুঁজে পেয়েছি তিনি কী লিখেছিলেন আমার লেখা সম্বন্ধে এবং আমি তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করে কী প্রত্যুত্তর দিয়েছিলাম। ইলিয়াস ভাইয়ের সাহিত্য অমূল্য। তবে একটা দুটো ব্যতিক্রম বাদে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে তা সেভাবে স্পর্শ করেছে বলতে পারব না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস নিয়ে সবাই বেশ সরব। কিন্তু আমার কাছে তাঁর গল্পগুলোকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন বইয়ের ফেরা গল্পটা যেমন বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ, তেমনই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মিলির হাতে স্টেনগান। এই একটা গল্প আমাকে বছরের পর বছর তাড়া করে ফিরেছে। আমরা যারা সত্তর দশকে বেঁচেছি, মিলির হাতে স্টেনগানকে আমরা বুঝতে পারি। এ গল্প অতুল কারণ আমি চোখের সামনে দেখেছি ওই পাগল ভালো হয়ে যাচ্ছে আর মিলি অসুস্থ হয়ে পড়ছে, মিলি তাকে স্টেনগান দিতে চাইছে। আমরা যারা সত্তর দশকে কষ্ট পেয়েছি, ক্ষুব্ধ হয়েছি, মনে হয়েছে এ গল্পটা বিশেষভাবে তাদের। সৈয়দ শামসুল হক তৃতীয় যদি বলতে হয়, সৈয়দ শামসুল হকের নাম আসবে। হক ভাইয়ের একটা বই আমাকে ভীষণরকম নাড়া দিয়েছে : বৈশাখে রচিত পঙতিমালা। স্বাধীনতার আগে প্রকাশিত এ বই এখনো যখন পড়ি, একটা কথা মনে হয়— এ বই অসাধারণ রকমের আধুনিক। শুধু ইমেজারি না, যে বিষয়গুলো তিনি তখন কবিতায় এনেছেন; লোকে গালও দিয়েছে; সেই বিষয়গুলো কিন্তু সাহিত্যে তখনো আসত না। তিনি অকপটে বলে গেছেন এবং সেই লেখায় প্রকাশিত তাঁর কষ্ট, আনন্দের প্রায় সবটাই আমি ধরতে পারি। এজন্যেই বইটা যখন আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে শুরু করলাম; অনেকদিন ধরে অনুবাদ করেছি; তখন মনে হচ্ছিল, আমি বোধহয় ওনাকে ধরতে পারব। ভালো লাগা থেকে অনুবাদ করছিলাম। বই হওয়ার আগে যখন ওনাকে পড়ে শোনাতাম, হক ভাই বলতেন, ‘আফসান, আপনি যা করবেন ঠিক আছে।’ আমার বিশ্বাস আমি গভীরে পৌঁছাতে পেরেছি আর সে কারণে নিছক অনুবাদ করিনি। আমার এক বন্ধু আছে, যুদ্ধবন্ধু, সোলেমান। আমার উপন্যাস ‘রক্তের মেহেন্দি দাগে’ তার কথা আছে। যেদিন বুঝতে পারলাম সোলেমানের পা চলে যাওয়ার পর হাতও চলে গেছে, সেদিন আমি আমার জীবনের একটা ভয়াবহতম দিন কাটালাম। বাসায় ফিরে এসে, ঘুমানোর তো প্রশ্নই আসে না, চুপ করে বসেছিলাম। আমার ডায়বেটিস আছে। ডায়বেটিক ট্রেমর হয়। আমার হাতটা ট্রেমর হচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম সোলেমান আর আমি বোধহয় এক হয়ে যাচ্ছি। প্রচণ্ড কষ্ট দুঃখবোধ থেকে আমি লিখতে শুরু করেছিলাম। ওই রাতে, আমার লেখা ছাড়া উপায় ছিল না। সোলোমানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হলেও আমাকে লিখতে হতো। আমি যখন লিখছিলাম, (ইংরেজিতে লিখেছি- ইংরেজি আমার প্রথম ভাষা। তারচেয়ে বড়কথা বাংলা আমি হাতে লিখে উঠতে পারতাম না। আমার কম্পিউটার ছিল। সেখানেই ইংরেজিতে লিখতে শুরু করেছিলাম) যে ফর্মটা আমি বেছে নিলাম আশ্চর্যজনকভাবে সেটা ছিল কবিতার ফর্ম। কিন্তু আমি তো কবিতা লিখি না! কবিতা কেন উপস্থিত হলো? সেই রাতে কবিতা ছাড়া আমাকে আর কিছুই আমাকে মুক্তি দিতে পারত না। আমি লিখেই যাচ্ছিলাম। একসময় সোলেমানের কথা শেষ হয়ে গেল। এরপর আমি নিজের কথা লিখে যাচ্ছিলাম। তখন আমি হক ভাইয়ের কাব্য শৈলী দিয়ে প্রভাবিত হয়েছি। লেখাটা কনভার্সেশন উইথ সোলেমান নামে বের হয়। ওটা ছিল আমার স্মৃতির স্মৃতিচারণ। হাসান হাফিজুর রহমান একজন মানুষকে বোধহয় আমি আমার বাবার চেয়ে বেশি ভালো বেসেছিলাম। তাঁর মৃত্যুতে আমি দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে গিয়েছিলাম, মাটিতে গড়িয়ে কেঁদেছিলাম। তিনি হাসান হাফিজুর রহমান। হাসান ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ ছিল আর কোনো মানুষের সঙ্গে ততোখানি ছিল না। আমরা সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতাম। কখনো তাঁর লেখা পড়ে বিশেষ কোনো অংশ ধরে বলতাম, ‘আপনার এই জায়গাটা হয়নি।’ হাসান ভাই পাল্টে দিতেন। এইরকম সম্পর্ক তো সবার সঙ্গে হয় না, হবেও না। হাসান ভাই যখন মারা গেলেন, আমি আর মাহফুজুল্লাহ ভাই বিচিত্রা অফিসে সারাদিন চুপ করে বসেছিলাম। তিনি আমাকে হাসান হাফিজুর রহমানের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন ইতিহাস প্রকল্পে চাকরিটা দেওয়ার জন্য। তিনি বলছিলেন, ‘মানুষ সবাই যায়। মানুষ সবাই যায়।’ মাহফুজুল্লাহ ভাইও একদিন চলে গেলেন। হাসান হাফিজুর রহমান মারা যাওয়ার পর মাহফুজুল্লাহ ভাই বলেছিলেন, ‘ছাদ চলে গেলে কেমন লাগে আমি জানি।’ আমিও অনুভব করছিলাম সেদিন, আমার ছাদটা আর নেই। আমার জীবনের সমস্ত শিক্ষা, অর্জন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে। আমার বেঁচে থাকা, কষ্ট করা, কষ্ট পেরিয়ে ওপরে ওঠা- সব মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ঘিরে। এটা হাসান ভাই না থাকলে হতো না। তিনি আমাকে সন্তানের মতো ভালোবাসতেন? আমি জানি না। তিনি আমাকে ভালোবাসতেন এটা আমি জানি। আর জানি, আমি তাঁকে ভালোবাসতাম।

আরও পড়ুন

×