ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বাঁশঝাড়ে গণপুষ্পায়ন

বাঁশঝাড়ে গণপুষ্পায়ন

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে মেলোকানা বাকিফেরা নামে এক প্রকার মুলি বাঁশ জন্মে, যাতে ৪৮ বছর পর ফুল ধরে

জায়েদ ফরিদ

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর -০০০১ | ০০:০০

 বাঁশ যে এক প্রকার ঘাস, তা ভাবতে বিস্ময়কর মনে হলেও সত্য। এই অতি প্রয়োজনীয় গাছটির শুধু অবয়বে নয়, স্বভাবেও আছে কিছু অদ্ভুত আচরণ। নানা প্রকার বাঁশঝাড়ে নানা সময়ে ফুল ধরে– কোনোটিতে ফি-বছর, কোনোটিতে তিন বছর, কোনোটিতে ৫০ বছর, কোনোটিতে বা ১০০-১২৫ বছর পরে। ভারতের মিজোরাম রাজ্য, মিয়ানমার, চীন আর বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে মেলোকানা বাকিফেরা নামে একপ্রকার মুলি বাঁশ জন্মে, যাতে ৪৮ বছর পর ফুল ধরে।

একই ঝাড়ের মেলোকানার বীজ বা রাইজোম নিয়ে যদি একই সময়ে লাগানো হয় আমেরিকা, ইউরোপ বা আমাজনের অরণ্যে, তবে একই সময়ে ফুল ফুটবে তাতে।

প্রসঙ্গত, বহু বছর পর যদি বাঁশঝাড়ে হঠাৎ একছড়া ফুল ফোটে, তাহলে প্রমাদ গোনে মিজোরামের দরিদ্র মানুষ। এই ফুল কয়েক বর্গমাইল এলাকাজুড়ে অবিরাম ফুটতে থাকবে দু-তিন বছর ধরে। পূর্বজদের অভিজ্ঞতা থেকে পুষ্পায়ন নিয়ে তাদের ভেতর প্রচণ্ড ভীতি ঢুকে পড়েছে। বাঁশঝাড়ে গিয়ে অশুভ ফুলের ছড়া কেটে ফেলে দেয় তারা পাগলের মতো। কোনো লাভ হয় না তাতে। আবার সেই একই জায়গা থেকে বের হয় সর্বনাশা ফুল।

এই ফুল থেকে ফল হয়, জলপাইয়ের চেয়েও বড়। ফল পড়ে গাছের তলা বিছিয়ে থাকে। আশপাশের সাত গ্রামের ইঁদুর আসে এই ফল খেতে। মাটি থেকে খায়; গেছো ইঁদুর হলে গাছে চড়েও খায়। এই ফলের পুষ্টিগুণ অনেক। উপরন্তু এটি আবার প্রচণ্ড ‘আফ্রোডিসিয়াক’, তাই ইঁদুরের বংশ বাড়তেই থাকে। হাজারে হাজারে লাখে লাখে। খাদ্যের সন্ধানে বাঁশতলা থেকে এবার ইঁদুরের দল মাঠে নেমে আসে; ফসলের দিকে মনোযোগী হয়। ফসল শেষ করে চলে যায় শস্যের ডোলে।সারারাত জেগে ইঁদুর তাড়িয়ে মাত্র দশ ভাগ শস্য– যা গ্রামবাসী উঠিয়েছিল শস্যাধারে– তাও শেষ হয়ে যায়। মিজোরা এবার শিকড়বাকড় কচু-ঘেঁচু আর মেটে আলু খায়। সেগুলো শেষ হলে প্রাণে বাঁচার জন্য ধরে ধরে ইঁদুরই খেতে থাকে চুলার ওপরে রোস্ট করে।

 এ সময় এলাকাবাসীর মধ্যে নানা রোগ ছড়িয়ে দেয় ইঁদুর– টাইফয়েড, টাইফাস, প্লেগ। রোগ আর পুষ্টির অভাবে দুর্বল শরীর নিয়ে তারা আর গাছের গোড়া খুঁড়ে কন্দজাতীয় খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। যৎসামান্য সরকারি রিলিফের খাদ্য আর ওষুধ আসার আগেই প্রাণহানি ঘটে অজস্র মানুষের। এরপর লাখ লাখ ইঁদুরও মরে যেতে বাধ্য হয় খাদ্যের অভাবে। বাঁশঝাড়ও মরে যায়। যে প্রচণ্ড শক্তি ব্যয় করে গাছ বংশ-ফসল ফলায়, তাতে তার আর জীবনীশক্তি অবশিষ্ট থাকে না।

বাঁশঝাড়তলায় লাখো ভুক্ত ফলের মধ্যে তখনও অলক্ষে লুকিয়ে থাকা অনেক ফল থেকে জন্ম নেয় নতুন বাঁশের চারা। আবার গড়ে ওঠে বাঁশের নতুন জনপদ। এই গণপুষ্পায়ন ও সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় নিয়ে টিভিতে ইন্টারভিউ দিয়েছেন পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ডানিয়েল জ্যানজেন। গাছ বংশরক্ষার জন্যই এমন কৌশল অবলম্বন করেছে বলে তাঁর বিশ্বাস। ভারতের মিজোরাম ও মণিপুর রাজ্যে বাঁশের গণপুষ্পায়ন হয়েছে ১৯৫৮-৫৯ সালে। এর ৪৮ বছর পর অর্থাৎ ২০০৬-০৭ সালেও এর প্রভাব দেখা গেছে ভারত, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের বান্দরবান, রাঙামাটি, মৌলভীবাজার ও খাগড়াছড়িতে। পরবর্তী পুষ্পায়ন হয়তো ২০৫৪-৫৫ সালের দিকে হবে। প্রকৃতিতে খাদ্য, পুষ্টি, বাসস্থান নিয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতে পরস্পরের মধ্যে নিদারুণ প্রতিযোগিতা চলে। হঠাৎ ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে যাওয়ার ঘটনা থেকে সাহিত্য ক্ষেত্রে রচিত হয়েছে রবার্ট ব্রাউনিং-এর অনন্য কাহিনি ‘হ্যামিলনের বংশীবাদক’, আলোচিত হয়েছে লন্ডন শহরের গ্রেট প্লেগ; ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের জন্য হেলিকপ্টার দিয়ে বিড়াল নামাতে হয়েছে মালয়েশিয়ার এক দ্বীপে। আমরা প্রকৃতির এক বিপুল অংশ। লুপ্ত প্রাণীর তালিকায় আমরাও রয়েছি বেশ ওপরের দিকে– ১১ নম্বরে। এই প্রতিযোগিতার মধ্যে সফলভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে আমাদেরও বেঁচে থাকতে হবে। 

আরও পড়ুন

×