নিবন্ধ
হারিয়ে যাওয়া টি-টোকেন

হোসাইন মোহাম্মদ জাকি
প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
ভারতবর্ষে পানীয়রূপে চায়ের আবির্ভাবের বিষয়টি ইতিহাসের এক অনন্য সামাজিক উপাদান। পাহাড়ের আবহাওয়া চা উৎপাদনের অনুকূল বিবেচনায় সিলেট, আসাম, কাছাড়, ডুয়ার্স ও দার্জিলিং-কে চা উৎপাদনের জন্য প্রাধান্য দেওয়া হয়। চায়ের এই অঞ্চলগুলো সুরমা, আসাম, বরাক ও ব্রহ্মপুত্র ভ্যালি নামে খ্যাত ছিল। এতদঞ্চলে চা উৎপাদনের শুরু উনিশ শতকের মাঝামাঝি। সেসময় চা-বাগানগুলোতে প্রচলিত সরকারি মুদ্রায় শ্রমিকদের মজুরি দেওয়াটা ছিল বাগান কর্তৃপক্ষের জন্য অলাভজনক। সে কারণে মজুরি হিসেবে শ্রমিকদের টি-টোকেন দেওয়া হতো। এতে করে বিশাল শ্রমিকগোষ্ঠীকে দৈনিক, সাপ্তাহিক বা মাসিক মজুরি প্রদানে সুবিধা হয়। এগুলো শুধু বিপুল পরিমাণ ক্ষুদ্র মুদ্রা সংরক্ষণের ঝামেলাই কমায়নি, বরং বাগান-সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের আর্থিক বোঝা কমিয়েছিল। পাই, পয়সা, আনার বিভিন্ন মানের টোকেন ছিল তখন। এগুলো হরেক গড়ন আর আকারের হতো; যেমন– গোলাকার, ডিম্বাকৃতি, ত্রিভুজাকৃতি, ষষ্টভুজাকৃতি ও অষ্টভুজাকৃতি। এগুলোর মুদ্রামান শ্রমিকদের বেতন হারের সাথে মিলিয়েই তৈরি করা হয়েছিল। টোকেনের ব্যবহার বাগানের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বাগান-সংশ্লিষ্ট সবাই এগুলোর মূল্যমান সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত থাকায় কোনো সমস্যার সৃষ্টি হতো না। প্রায় একশ বছর ধরে এই টোকেন চা-শ্রমিকদের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেকালের সাহিত্য-সাময়িকীতে অবশ্য এই বিষয়ক আলোচনা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মূলত মুদ্রা-সংশ্লিষ্ট জার্নালগুলো থেকে এসব টোকেন আবিষ্কারের কাহিনি ও বৃত্তান্ত জানা যায়। ব্রিটিশ ভারতে মুদ্রাব্যবস্থা চালু থাকার পরও চা-বাগানগুলোতে কেন এবং কীভাবে টি-টোকেনভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, সে বিষয়টি উঠে এসেছে আলোচ্য নিবন্ধে।
প্রাক-উপনিবেশ এবং উপনিবেশ পর্বের মুদ্রা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা
১৭৪২ সালে ইংরেজরা মোগলদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সর্বপ্রথম ‘আর্কট টাঁকশাল’ থেকে ‘আর্কট’ মুদ্রা প্রস্তুত শুরু করে। গবেষক ড. আবদুল করিমের তথ্য অনুযায়ী, সে সময়ে এই উপমহাদেশে প্রায় দুইশরও বেশি টাঁকশাল থেকে মুদ্রা প্রস্তুতের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন টাঁকশালের মুদ্রার ওজন সমান হতো না। ওজন ও ব্যবহৃত ধাতুর উৎকর্ষের ওপর নির্ভর করে মুদ্রার দাম নিরূপণ করা হতো। সরকারি রাজস্ব পরিশোধ করা হতো সিক্কায়। আর ব্যবসায়িক লেনদেন হতো আর্কটে। মুদ্রার বিনিময় প্রথার এ কৌশলকে কাজে লাগিয়ে শ্রফ, শেঠ ও পোদ্দাররা ঢাকায় বিকশিত হয়। রাজস্ব পরিশোধের জন্য এদের নিকট হতে আমজনতা থেকে শুরু করে জমিদারশ্রেণি ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকেও সিক্কা সংগ্রহ করতে হতো। বিভিন্ন মানের প্রচলিত মুদ্রা মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাট্টার পরিমাণের পার্থক্য হতো।

ছবি কৃতজ্ঞতা : Bourne and Shepherd Studio, Calcutta
সংকট মোকাবিলায় ১৮২৮ সালে গঠিত হয় ইউনিয়ন ব্যাংক। কিন্তু ১৮৪৮ সালে ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৪৬ সালে ‘ঢাকা ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৮৫৬ সালে এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গের ছয়টি জেলা নিয়ে গঠিত প্রেসিডেন্সি বিভাগে প্রতিষ্ঠিত ‘ব্যাংক অব বেঙ্গল’-এর পরিচালকরা ১৮৬২ সালে ‘ঢাকা ব্যাংক’ কিনে নেয়। ‘ব্যাংক অব বেঙ্গল’-এর কার্যক্রমও পোদ্দারদের অর্থলগ্নি ব্যবসায় খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। কারণ, সাধারণ লোকের ব্যাংকে আমানত রাখার সামর্থ্য ছিল না। আবার বিত্তবানদের ব্যাংকের ওপর ভরসা ছিল কম। পোদ্দারদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার পদ্ধতি সহজ থাকায় এদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা ছিল বেশি। ড. আরএম দেবনাথের তথ্য অনুযায়ী, ১৯১৩-১৭ সালের মধ্যে অবিভক্ত ভারতে ৭৮টি ব্যাংক বন্ধ হয়। এরপর ১৯২২-৩২ সালের মধ্যে বন্ধ হয় ৩৭৩টি ব্যাংক। ১৯৩৭-৪৮ সালের মধ্যে বন্ধ হয় ৬২০টি। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও এতদঞ্চলে ব্যাংক ব্যবস্থা শক্ত ভিত পায়নি। সিলেটে মুদ্রাব্যবস্থার চিত্র ছিল ভিন্নতর। ১৭৭৮ সালে রবার্ট লিন্ডসে ছিলেন সিলেটে নিয়োজিত ‘রেসিডেন্ট’। তিনি লিখেছেন, সে সময়ে সিলেটে রৌপ্য বা তাম্র মুদ্রার প্রচলন প্রায় ছিল না। কড়িতে রাজস্ব পরিশোধ করা হতো। সে সময় কড়ির গণনাবিধি ছিল : ৪ কড়ি = ১ গণ্ডা, ০৫ গণ্ডা = ১ বড়ি, ০৪ বড়ি = ১ পণ, ৪ পণ = ১ আনা, ৪ আনা = ১ কাহন, ১০ কাহন = ১ টাকা। ১৮২০ সালে এসে এই কড়ির প্রচলন বন্ধ হয়। আসাম প্রদেশের মুদ্রাব্যবস্থাও ছিল অনেকটা ঢাকার অনুরূপ। সেখানে প্রচলিত ছিল ব্রিটিশ মুদ্রা, নারায়ণী মুদ্রা, আর্কট, সিক্কা, রাজা-মোহরি। নানামুখী এই মুদ্রা বিনিময়ের জন্য বাট্টার হার ছিল ভিন্ন ভিন্ন।
প্রাক-উপনিবেশ এবং উপনিবেশ পর্বের যোগাযোগ ব্যবস্থা
রেলপূর্ব সময়কালে বাংলার যোগাযোগের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম ছিল নদীপথ। এ ছাড়া পরিবহন কাজে গরু ও মহিষের গাড়ি এবং হাতি ব্যবহার করা হতো। অনেক ক্ষেত্রে রাস্তার অবস্থা এমন ছিল যে, সেখানে হেঁটে যাওয়াও ছিল বেশ কষ্টকর। দিনাক সোহানী কবির রচিত ‘পূর্ব বাংলার রেলওয়ের ইতিহাস ১৮৬২-১৯৪৭’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সেসময় সিলেট থেকে কলকাতা পৌঁছাতে প্রায় ১৩ দিন সময় লাগত। দার্জিলিংয়ের তুলনায় আসাম এবং সিলেটের যোগাযোগ পরিস্থিতি আরও নাজুক ছিল। কারণ, ১৮৭৮ সালে দার্জিলিংয়ের পাদদেশ পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। অন্যদিকে আসাম-বেঙ্গল রেলপথ পূর্ণাঙ্গরূপে চালু হয় ১৯০৪ সালে। আর চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপিত হয় ১৯১০ সালে। ১৯১৬ সালের রেকর্ড অনুযায়ী কলকাতা আর্মেনিয়ান স্ট্রিট ঘাট থেকে স্টিমারে শিলচরে পৌঁছাতে আট দিন সময় লাগত। কলকাতা জগন্নাথঘাট থেকে স্টিমার সাত দিনে ধুবড়ি, ৯ দিনে গুয়াহাটি এবং ১৩ দিনে ডিব্রুগড় পৌঁছাত। সরু খালসহ অনেক স্থানেই স্টিমারের চলাচল ছিল না। বাকি পথ তখন অতিক্রম করতে হতো দেশি নৌকায়।

ধাতব মুদ্রা পরিবহনের ঝুঁকি ও ব্যয়
নৌকাযোগে মুদ্রা পরিবহন ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ১৮৪৭ সালের দুর্ঘটনা তার জলজ্যান্ত সাক্ষী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, কোচ রাজার দেওয়া নজরানার মুদ্রা গদাধর নদী দিয়ে ধুবড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় নৌকাডুবি হয়। সব মুদ্রাই পানিতে ডুবে যায়। এরূপ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পরবর্তী সময়ে মুদ্রাসমূহ অনেকগুলো ছোট ছোট থলেতে রেখে প্রতিটি থলে ভাসমান বাঁশের ভেলায় বেঁধে রাখা হতো। এতে করে নৌকা দুর্ঘটনাগ্রস্ত হলেও ভেলায় বেঁধে রাখা থলেগুলো উদ্ধার করা যেত। টাঁকশাল কর্তৃপক্ষ মুদ্রা পরিবহনে অধিকতর শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে। বিশাল কাঠের ক্রেটে ক্ষুদ্র মূল্যমানের মুদ্রা পরিবহন করা হতো। ক্রেটের ভেতরে ছোট ছোট প্যাকেটে এই মুদ্রাগুলো স্তূপ করা হতো। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই প্যাকেটগুলো প্যাকিং ও সিলগালা করে ক্রেটকে বিশেষ তার দিয়ে আড়াআড়ি বেঁধে তার ওপরে টাঁকশালের চিহ্ন খোদাই করে দেওয়া হতো। ধাতব মুদ্রা পরিবহন সেকালে কতটা ব্যয়বহুল ছিল, এই বর্ণনা থেকে তা অনুমান করা যায়।
বহুমাত্রিক টি-টোকেন ও তার ব্যবহার
মুদ্রাব্যবস্থা স্থিতিশীল হওয়ার পরে ব্রিটিশ ভারতে ব্যবহৃত মুদ্রার ক্ষুদ্রতম একক ছিল পাই। পাইয়ের ঊর্ধ্ব ধাপে ছিল পয়সা। তার ওপরে আনা এবং তারও ওপরে ছিল রুপি। এক রুপিতে ১৯২ পাই বা ৬৪ পয়সা। ১২ পাইতে এক আনা। আর ১৬ আনায় ছিল এক রুপি। শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে পাই, পয়সা ও আনার মতো ক্ষুদ্র মূল্যমানের মুদ্রার প্রয়োজন হতো। কিন্তু টাঁকশাল হতে পর্যাপ্ত পরিমাণে এসব মুদ্রার সরবরাহ না থাকায়, মুদ্রা সংগ্রহের জন্য বাগান কর্তৃপক্ষকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হতো এবং বড় অঙ্কের বাট্টা গুনতে হতো। এই সংকট নিরসনে চা-বাগান কর্তৃপক্ষের অনেকেই নিজস্ব বিনিময়ের মাধ্যম টি-টোকেনের ব্যবহার শুরু করে। এগুলো তৈরি হতো কাঁসা, জিঙ্ক, তামা ও টিন দিয়ে। ধাতব টি-টোকেন ছাড়াও রঙিন কার্ডবোর্ডের আট আনা মূল্যমানের টোকেন (আসাম কোম্পানির) ব্যবহারের নিদর্শনও খুঁজে পাওয়া যায়। কিছু টোকেনের অভিহিত মূল্য ছিল। আবার কাজের দর অনুযায়ী যেমন Quarter Hazri ধরনের টি-টোকেনও ছিল। টোকেনে ব্যবহৃত Hazri শব্দটি এসেছে হাজিরা থেকে। সেকালে পারিশ্রমিকের একটি পদ্ধতি ছিল দিনহাজিরা। দিনহাজিরার জন্য বিশেষ এক ধরনের কাজ দেওয়া হতো, যা এক দিনে সম্পন্ন হবে বলে ধরা হতো। এই কাজের জন্য নির্দিষ্ট হারে দৈনিক পারিশ্রমিক দেওয়ার নিয়ম ছিল। চা-বাগানের শ্রমিকদের পারিশ্রমিক পদ্ধতি অন্য শিল্প বা কৃষিক্ষেত্র থেকে আলাদা ছিল। ব্যক্তিগতভাবে নয়, বরং পরিবারগতভাবে বাগানে চাকরি দেওয়া হতো। পরিবারে বিদ্যমান স্বামী, স্ত্রী এবং নাবালক পুত্র-কন্যা সবাই কাজে চুক্তিবদ্ধ থাকত। টিক্কা অর্থাৎ অতিরিক্ত কাজের জন্য সামান্য বর্ধিত হারে পারিশ্রমিক দেওয়া হতো।
মুদ্রা সংগ্রাহক ও বিশেষজ্ঞ শঙ্করকুমার বসুর তথ্য অনুযায়ী, এ যাবৎ অবিভক্ত সুরমা (সিলেট) ভ্যালির ৫৪টিসহ আসাম, বরাক ও ব্রহ্মপুত্র ভ্যালির সর্বমোট ৮৫টি চা-বাগানের কয়েকশ টি-টোকেনের কথা জানা গেছে। এগুলো সাধারণত বিশ থেকে ৩২ মিলিমিটার চওড়া। অধিকাংশ টোকেনেই ইংরেজি অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। তবে অসমিয়া, এমনকি একটি টোকেনে বাংলায় ‘ছিলেট’ লেখাও দেখা যায়। কিছু টোকেনে শুধু একদিকে লেখা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুখ্য এবং গৌণ দু’দিকেই লেখা দেখা যায়। এসব টোকেনের কোনো কোনোটিতে মুদ্রামান লেখা নেই। শুধু চা-বাগানের নাম লেখা। সম্ভবত লেবার এনকোয়ারি কমিশনের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য অনেক চা-বাগানই তাদের টোকেনে অর্থমূল্য খোদাই করা থেকে বিরত ছিল। অনেক টোকেনে ইস্যুর বছর খোদাই করা হতো। তবে এসব টোকেনের অধিকাংশের মাঝেই রয়েছে গোলাকার ছিদ্র। পুরুষ, মহিলা ও শিশু শ্রমিকদের জন্য তিনটি ভিন্ন আকৃতির টোকেন ছিল। সাবালক পুরুষ শ্রমিকদের পারিশ্রমিকের হার ছিল সর্বোচ্চ। টি-টোকেনের জোগান দিত মূলত ম্যানেজিং এজেন্টরা। এরা মিন্ট ও বাগানগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করত। টাঁকশালে প্রয়োজনীয় মুদ্রা প্রস্তুতের অর্ডার হতে শুরু করে টোকেন সরবরাহের যাবতীয় দায়দায়িত্ব পালন করত এই এজেন্ট। এ কাজের জন্য শতকরা ৩ আনা হারে কমিশনের রেওয়াজ ছিল। এরা চা-বাগান কর্তৃপক্ষকে ব্যাংকের মতো প্রয়োজনে অর্থও ধার দিত। ম্যানেজিং এজেন্ট হিসেবে সিলেট অঞ্চলে খ্যাত ছিল ‘অক্টাভিয়াস স্টিল অ্যান্ড কোং’। সর্বমোট ২৮টি বাগানে তারা টোকেন সরবরাহ করত। এটি ডানকান ব্রাদার্সের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। তাদের নিজস্ব চা-বাগানও ছিল। সরকারি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুসারে, কলকাতা মিন্ট ও বার্মিংহাম মিন্ট চা-বাগানগুলোর চাহিদা অনুযায়ী টি-টোকেন জারি করত। বার্মিংহাম প্রথমে ছিল ব্যক্তিগত মালিকানার এক টাঁকশাল। তখন এর নাম ছিল ‘আর. হিটন অ্যান্ড সনস্’। পরবর্তী সময়ে কোম্পানিতে পরিণত হলে এর নাম হয় ‘Mint, Birmingham Ltd’। কোন চা-বাগান কবে এবং কত মূল্যের টোকেন তৈরির অনুরোধ করেছিল, সে বিষয়ক সমস্ত নথিপত্র এবং নমুনা R. Heaton & Sons এর সংগ্রহশালায় আজও সংরক্ষিত আছে।
প্রতিটি বাগানেই মহাজনের দোকান থাকত। সেখান থেকে শ্রমিকরা টোকেন দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করত। বাগান কর্তৃপক্ষের নিয়োজিত এজেন্ট সপ্তাহে একবার বিনিময় মূল্য পরিশোধ করে মহাজনদের কাছ থেকে টোকেনগুলো সংগ্রহ করে নিত। পারিশ্রমিক হিসেবে শ্রমিকদের এই টোকেন দেওয়ার দায়িত্ব পালন করত সাধারণত নিয়োগকারী সর্দাররা, যাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শ্রমিকরা কাজ করত। মাঝে মাঝে ইউরোপিয়ান বাগানবাবুরাও শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার কাজটি করত। অধিকাংশ বাগানেই দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি দেওয়া হতো। সকালের শুরুতেই আগের দিনের মজুরি বাবদ পাওনা টোকেন বিলি করা হতো। চা-বাগানগুলোতে টোকেন পদ্ধতি চালু থাকার পেছনে আরেকটি অন্তর্নিহিত কারণ ছিল। কঠোর পরিশ্রম, বৈরী পরিবেশ আর অতিনিম্ন মজুরির কারণে শ্রমিকরা প্রায়ই বাগান থেকে পালিয়ে যেতে চাইত। স্বজনদের দেখতে মন চাইলেও যাওয়ার উপায় ছিল না। কারণ, বাগানের বাইরে এসব টোকেনের কোনো বিনিময় মূল্য ছিল না। ফলে শ্রমিকরা চাইলেও বাগান ত্যাগ করতে পারত না। নাসিম আনোয়ারের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ধাতব টি-টোকেনের প্রচলন ঘটে ১৮৭০ সালে। সর্বশেষ টোকেন লটের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল ১৯৩০ সালে। টোকেন প্রথা টিকে ছিল ১৯৫০ পর্যন্ত। দেশ ভাগের পর মুদ্রার ব্যাপক প্রচলনে টি-টোকেন প্রথার ইতি ঘটলেও শ্রমিকদের সুখ-দুঃখ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার সাক্ষী হিসেবে টি-টোকেনগুলো রয়ে গেছে।
- বিষয় :
- নিবন্ধ
- হোসাইন মোহাম্মদ জাকি