ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সম্ভাবনার তুলনায় সেবা রপ্তানি অনেক কম

সম্ভাবনার তুলনায় সেবা রপ্তানি অনেক কম

আবু হেনা মুহিব

প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০

 বিশ্ববাজারের সেবা রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখনও অতিক্ষুদ্র বণিক। বিভিন্ন ধরনের সেবার বিশ্ববাজার এখন প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের। এ বাজারে বাংলাদেশের অংশ গড়ে ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি নয়, যা পণ্য রপ্তানি আয়ের ৮ থেকে ১০ শতাংশের মতো। বাস্তবতা অনুযায়ী সেবা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা কম করে ধরা হয়। সাধারণ এই লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করা সম্ভব হয়নি বিগত কোনো অর্থবছরে। বরং যেসব সেবা রপ্তানি করা যেত সেগুলোর কোনো কোনোটি এখন আমদানি করা হয়। মূলত, উদ্যোক্তা এবং নীতিনির্ধাকরদের কাছে পণ্য রপ্তানি যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে সেবা রপ্তানি ততটা মনোযোগ পায়নি। এছাড়া সেবার নিম্নমান, সহায়ক নীতি-কাঠামোর অভাব– এমন আরও কিছু কারণ রয়েছে নিরুত্তাপ সেবা রপ্তানির পেছনে।

 এ খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে অনেকদিন ধরেই। বাণিজ্য বিশ্লেষক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, সহায়ক নীতি-কাঠামো এবং সেবার মান উন্নত হলে এ খাতের রপ্তানি কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব। সেবা রপ্তানি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে ব্যবহার করা, সেবার মান উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা ও অবকাঠামোর মতো বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। অভ্যন্তরীণ সেবা খাত দাঁড়িয়ে গেলে একদিকে রপ্তানি থেকে বড় আয় আসবে, আবার আমদানিরও প্রয়োজন কমে আসবে। সরবরাহ চেইনে নতুন সেবা খাতকেও যুক্ত করার কথা বলছেন তারা। উন্নত দেশগুলোতে সব রপ্তানির সুযোগ তৈরিতে তারা বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) দেনদরবার আরও জোরদার করার কথাও বলছেন অনেকে। সেবা রপ্তানির তালিকায় থাকা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি খাতের মধ্যে রয়েছে– পরিবহন, পর্যটন, ব্যাংক-বীমা, টেলিযোগাযোগ, নির্মাণ, কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি, মেধাস্বত্ব ইত্যাদি। বিদেশি বিমান, জাহাজ কিংবা অন্যান্য পরিবহন বাংলাদেশ থেকে জ্বালানি নিলে সেটিও সেবা রপ্তানির অন্তর্ভুক্ত। জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২ অনুসারে অটোমোবাইল, এভিয়েশন, পরিবহন, যোগাযোগ, ওয়্যারহাউস, সুপারশপ, বিপণিবিতান, রেস্তোরাঁ, বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদিকে সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছে গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত সেবা রপ্তানির পরিসংখ্যান রয়েছে। তাতে সেবা রপ্তানির হতচিত্রই ফুটে ওঠে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে গত অর্থবছরের ১০ মাস পর্যন্ত সেবা রপ্তানি কমেছে ১১ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম হয়েছে ১৬ শতাংশের মতো। মাত্র ৬৩৫ কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের সেবা রপ্তানি হয়েছে। ওই সময় পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৫৪ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের মোট লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯০০ কোটি ডলার। কয়েক অর্থবছরের রপ্তানির তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা যায়, কোনো অর্থবছরেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি সেবা রপ্তানির। কোনো কোনো অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সেবার পরিমাণ ছিল ৬৩৪ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কমে হয় ৬০৮ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে হয়েছে ৬৬১ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের প্রায় ৯ শতাংশ বেশি। গত ২০২১-২২ অর্থবছর সেবা রপ্তানি আয় বেশ খানিকটা বেড়ে হয়েছে ৮৮৯ কোটি ডলার। তাও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ শতাংশের মতো কম। ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান সমকালকে বলেন, অতিমারি করোনাকালে বৈশ্বিক পরিবহন ব্যবস্থায় ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। এ কারণে ২০২০-২১ অর্থবছর পরিবহন সেবা রপ্তানি থেকে ভালো আয় সম্ভব হয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় এ খাতের বর্ধিত আয় আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কেন সেবার সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না জানতে চাইলে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান সমকালকে বলেন, সেবা রপ্তানিতে পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ নিম্নমান। সেবার মান বিশ্বমানের না হওয়ায় রপ্তানি সে হারে বাড়ছে না। তবে মান বাড়াতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদার ভিত্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে কাজ করছে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ফলে আগামীতে মানের সংকট হয়তো কেটে যাবে। তিনি বলেন, এটি ঠিক যে, রপ্তানিতে পণ্য নিয়ে যতটা আলোচনা-আগ্রহ সেবার ক্ষেত্রে ততটা নয়। সেবাসংক্রান্ত বিভিন্ন খাতের চাহিদার ভিত্তিতে কিছু কিছু সহায়তা রয়েছে সরকারের। তিনি জানান, এখনও অনেক সেবা খাত রয়েছে যেগুলো রপ্তানি তালিকায় নথিভুক্ত নয়। সেগুলো হিসাবে নিলে সেবা রপ্তানির প্রকৃত আয় আরও কিছুটা বেশি। ইপিবির সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, সেবা রপ্তানিতে মানের উন্নয়ন খুব বেশি জরুরি। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, দেশের চিকিৎসাসেবা উন্নত হলে এ দেশে সেবা নিতে আসত বিদেশিরা। এতে সেবা রপ্তানি বাড়ত। এখন হচ্ছে তার উল্টো। চিকিৎসাসেবা নিতে বিদেশে যেতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। এর অর্থ সেবা রপ্তানির পরিবর্তে আমদানি করা হচ্ছে। উচ্চশিক্ষাসহ অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। তাঁর মতে, ব্যবসায়িক স্বার্থে বেসরকারি খাতকেই এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে সেবা রপ্তানিতে খুব বেশি কিছু করার নেই। তবে বাণিজ্য নীতি-বিশ্লেষক ড. মোস্তফা আবিদ খান মনে করেন, উন্নত দেশগুলোতে সেবার বাজার সম্প্রসারণে ডব্লিউটিওতে দেন-দরবার চালিয়ে যেতে পারে সরকার। তিনি বলেন, সার্ভিস ওয়েভারের আওতায় বিভিন্ন দেশে সহজে সেবা রপ্তানির সুযোগ ছিল। তথ্যপ্রযুক্তি, হিসাব পেশা, নিরীক্ষা, পর্যটন খাতসহ প্রকৌশলী, স্থপতি, চিকিৎসক, সেবিকা ও আইনজীবীরা বর্তমানের চেয়ে সহজেই আরও বেশি হারে উন্নত দেশে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পেতেন। এ নিয়ে ডব্লিউটিওতে অনেক দেন দরবার হয়েছে। তেমন কোনো ফল হয়নি। এক পর্যায়ে ২৪টি দেশ সার্ভিস ওয়েভার নোটিফিকেশন করেছে। বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই। ওই নোটিফিকেশন কার্যকর হলে আরও বেশি হারে বিভিন্ন পেশাদার বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার কথা ছিল। সেবা রপ্তানি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে ব্যবহার করা, সেবার মান উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা ও অবকাঠামোর মতো বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। অভ্যন্তরীণ সেবা খাত দাঁড়িয়ে গেলে একদিকে রপ্তানি থেকে বড় আয় আসবে, আবার আমদানিরও প্রয়োজন কমে আসবে। সার্বিকভাবে সেবা রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে সেবার নিম্নমানের কথা বলেন তিনি। সেবা রপ্তানির সম্ভাবনা নিয়ে একটি গবেষণা করেছে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই)। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্ভাবনা অনুযায়ী সেবা রপ্তানি এখনও অনেক কম। অনেক খাত এখনও রপ্তানির সরবরাহ চেইনে যুক্তই হয়নি। সেবা রপ্তানি না বাড়ার পেছনে কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। যেমন, পণ্য রপ্তানির মতো সেবা রপ্তানি এত সহজ নয়। ডব্লিউটিওর জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্রেড অ্যান্ড সার্ভিসেসের বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থা বেশ সংরক্ষণমূলক। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ কিছু নিয়মনীতিও সেবার রপ্তানির পক্ষে সহায়ক নয়। সেবার নিম্নমানের কথাও উল্লেখ করা হয় এতে। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়– সঠিক নীতিমালা, সেবার মান উন্নয়ন, রপ্তানির সরবরাহ চেইনে সম্ভাবনাময় পণ্যকে যুক্ত করা হলে সেবা রপ্তানি অনেক বাড়ানোর সুযোগ আছে। ডব্লিউটিওতে এ বিষয়ে দেনদরবার চালিয়ে নেওয়ার সুপারিশও করেছে বিএফটিআই। সেবা রপ্তানি বাড়ানোর মাধ্যমে আয় বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জাতীয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জন সহজ হবে বলে আশা করা হয় প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) সেবা খাতের অবদান গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৫১ শতাংশ। আগের বছরগুলোতে এ হার আরও কিছুটা বেশি ছিল। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মাধ্যমে মোট ১ হাজার ১২৪টি বিনিয়োগ প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশিই সেবা খাতের। অন্যদিকে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাবের ৪৩ শতাংশই সেবা খাতে। ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অর্থবছরে ১০ মাসে সেবা রপ্তানি খাতে সবেচেয়ে বেশি আয় এসেছে পরিবহন সেবা থেকে, ৯২ কোটি ডলার। সমুদ্র, বিমান, রেল ও সড়ক পরিবহন থেকে এই আয় আসে। অফিস মেনটেইন্যান্স থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯০ কোটি ডলার এবং নির্মাণ থেকে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬৪ কোটি ডলার এসেছে। এছাড়া বড় খাতের মধ্যে টেলিযোগাযোগ সেবা থেকে ৫৬ কোটি ডলার এসেছে। বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার সার্ভিস রপ্তানি থেকে এসেছে ৪৬ কোটি ডলার। ভ্রমণ থেকে এসেছে ৩৭ কোটি ডলার।

আরও পড়ুন

×