ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ‘অন্তহীন রহস্যের প্রতিফলন’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে নবরাজ রায়ের চিত্রকর্মের সঙ্গে পরিচিতি ঘটায় দর্শকরা বিশেষ ঋদ্ধ অনুভব করবেন। কারণ, বিমূর্ত ও আধাবিমূর্ত চিত্রকলায় গ্রাম-শহরের মিথস্ক্রিয়াময় এমন মানব ও পাশব জীবনের ছবি মানুষ হয়তো খুব বেশি দেখেনি। শিল্পীর ভেতর তিন সত্তা রয়েছে বলেই মনে হয়, যারা একেক কালে বাস করে। তাঁর যে সত্তাটি অতীতে বাস করে, সে গুহাবাসী মানুষের সঙ্গে নিয়ত সংগ্রাম করে, শিকারে বের হয়, তাদের তাড়না, প্রেরণা, আঘাত, উপশম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। যে সত্তাটি বর্তমানে বাস করে, সে আদিম গ্রাম ও অধুনা শহর– এ দুইয়ের দ্বৈরথের ভেতর দাঁড়িয়ে, মানুষের মন পড়ে। আর তৃতীয় সত্তাটি কোনো এক আগামীর সূর্যাস্ত বা চন্দ্রাস্তের কাছে আমাদের নিয়ে যায়, যেখানে চলছে তুল্য-তুফান। সেখানে কোনো বস্তু কোনো ভিতের ওপর নেই এবং তারা স্থিরও নয়।
এই তিন ধারার চিত্রকর্মে মেজাজ ভেদে ব্যবহৃত হয়েছে উষ্ণ, উজ্জ্বল রং। কিছু ছবি দেখে শিল্পীর ভেতর একটা অতি-ইতিবাচক বিশ্ব রয়েছে বলেই মনে হয়। একেকবার মনে হয়েছে, তিনি নেতিবাচক কিছু এঁকেছেন, কিন্তু তাঁর বিষ, কাঁটা যেন দর্শককে স্পর্শ করছে না। এর দুটি অর্থ হতে পারে– এক, হতে পারে তিনি নেতিবাচকতা সঞ্চারিত করতে চান না, কিন্তু নিজমনে যে ক্ষত জমছে তাঁকে ব্যক্ত না করেও পারছেন না। দুই, নেতিবাচকতা তাঁর কাছে ভারসাম্যের আরেক দিক এবং একে শক্তিকে রূপান্তর করতে চাইছেন। তাঁর ইতিবাচক বিশ্বের খানিকটা পরিচয় পেতে তাঁর সঙ্গে আলাপ করে বিশেষ কিছু সত্য জানা যায়।
আর সমস্ত আশাবাদী প্রতিভাবানের মতো তাঁর মনেও মৃত্যুমিতা ক্লেদ জমে; যে ক্লেদ বাড়তে বাড়তে তাঁর বিপুলা দিগবিস্তারে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। সেই সময়টা শিল্পী সবচেয়ে বন্ধ্যা সময় কাটান। এবং জোসেফ ক্যাম্পবেলের “হিরো’স জার্নি” স্ট্রাকচারে লেখা গল্পের কোনো কুশীলবের মতো তাঁকে সত্যিই কোনো গুরুসঙ্গে কাটাতে হয়। গুরু তাঁকে অভিমন্যু হতে দেন না। শিল্পী-জীবনের বীভৎস যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যূহ ভেদ করে গুরু ঠিক শিল্পীকে কিংবা নায়ককে বের করে নিয়ে আসেন। আর সেই মুহূর্তের আগে ও পরে শিল্পী কিংবা নায়কের জীবন এক থাকে না। সুলতান ফাউন্ডেশন পুরস্কার বিজয়ী শিল্পী নবরাজ রায়ের ক্ষেত্রেও এমনই এক গুরুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিল্পী নিখিল রঞ্জন পাল।
শুরুতেই শিল্পীর ভেতরকার যে তিন সত্তার অনুমান আমরা করেছিলাম, সেই তিন সত্তা একটি সত্তায় ছিল সুপ্ত। তাদের আলাদা করে এরপর হাতে হাত ধরিয়ে দিয়েছেন শিল্পী নিখিল রঞ্জন পাল। রবীন্দ্রভারতীতে অধ্যয়নকালে যখন নবরাজ পালের ভেতরটা রাজনীতি, সমাজনীতির নানান বন্ধ্যা তত্ত্বে ও মানুষের প্রতিক্রিয়ায় জারিত হয়ে প্রাণশক্তি হারিয়ে বসছিল, সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল জন্মভূমিকে পেছনে ফেলে আসার কষ্ট ও শক্তিহীনতা, অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন পাল তখন প্রায় একটি বছরের চেষ্টায়, সঙ্গ দিয়ে, সখ্য দিয়ে সেই হারিয়ে ফেলা শক্তিকে ফিরিয়ে আনেন এবং জন্মভূমির প্রতি টানকে বিভবে পরিণত করে দেন।
এতেই নবরাজের নতুন রাজত্ব লাভ ঘটে এবং আগে ও পরের মানুষটি আর একই মানুষ থাকেন না। এবং শিল্পীর ভাষায় তাঁর চিত্রকর্ম কিছু গড়পড়তা ভাবনা ও কাজবলয় থেকে বেরিয়ে এসে নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে ক্রমশ নতুনত্বময় নিজেকে আবিষ্কার করেন। এই নতুন তাঁর ভেতর কেবল নিজ দেশই নয়, বরং উপমহাদেশীয় দর্শনের একটা শক্তিমাত্রা যোগ হয়। আর সেই শক্তির পূর্ণ প্রতিফলনটাই দৃষ্টি কাড়ে ‘অন্তহীন রহস্যের প্রতিফলনের’ পঁচিশটি শিল্পকর্মে।
শিল্পকর্মগুলোর ভেতর উল্লেখযোগ্য– …
মানুষের লোকজ জীবন, নগরজীবন, সেখানে প্রকৃতির আবির্ভাব, প্রভাব, বিকৃতি ও নিবৃত্তি চোখে পড়ে ছবিতে। অর্ধভেদ্য ঝিল্লি দিয়ে পৃথক করা গ্রাম আর শহর চোখে পড়ে; গ্রামে প্রবেশ করছে শহর, শহরে প্রবেশ করছে গ্রাম। চোখে পড়ে শিল্পীর লোকজ চিত্রকলার প্রতি ঝোঁকগ্রস্ত মনের সৃষ্টি আরও নানান বন্য প্রাণী ও পাখির মোটিফ। হঠাৎ চমকে উঠতে হয়, একটি প্রাণীর আকৃতির নেগেটিভ স্পেসে আরেকটি আকৃতিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফুটে উঠতে দেখে। বিমূর্ত ও আধাবিমূর্ত ছবির জগতে দর্শক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অর্থ আরোপ করবেন তো বটেই। এখানেই ছবিগুলো আলাদা আলাদাভাবে হয়ে উঠবে প্রত্যেকের। এবং রং ও মোটিফগুলোর অবস্থান-সজ্জার কারণে, এর সঙ্গে প্রাকৃত রহস্যময়তার যোগ ঘটবে। অভিনব অনুভব মনে জাগবে, সন্দেহ নেই।
রোববার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোয় এ প্রদর্শনী বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে। প্রদর্শনীর পর্দা নামবে ১২ সেপ্টেম্বর।