সাক্ষাৎকার
ড্যাপ সংশোধন করতে হবে

কামাল মাহমুদ , প্রথম সহসভাপতি, রিহ্যাব
জসিম উদ্দিন বাদল
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
সমকাল : বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে বর্তমানে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম ঊর্ধ্বগতি। এমন পরিস্থিতিতে আবাসন খাতের ব্যবসার হালচাল কী?
কামাল মাহমুদ : একদম ভালো নয়। কারণ একদিকে বিশ্ববাজারের টালমাটাল অবস্থার কারণে নির্মাণসামগ্রীর আকাশচুম্বী দাম; অন্যদিকে ফ্ল্যাট-প্লটের অতিরিক্ত নিবন্ধন ফির চাপ। এর ওপর ড্যাপের নতুন নিয়ম আবাসন খাতের গতির ছন্দ পুরোপুরি এলোমেলো করে দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। তাদের অনেকে না পারছেন ব্যবসা ছাড়তে, না পারছেন ধরে রাখতে।
সমকাল : ক্রেতারা বলছেন, ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে। দাম আসলে কতটা বেড়েছে?
কামাল মাহমুদ : গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই নির্মাণসামগ্রীর দাম হুহু করে বেড়েছে। ফলে ফ্ল্যাটের দাম এক দফা বেড়েছে। ডলার সংকট ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে নতুন করে রড, সিমেন্টসহ প্রায় সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে। এ কারণে আরেক দফা বাড়তে চলেছে ফ্ল্যাটের দাম। সব মিলিয়ে ফ্ল্যাট কেনা আরও দুঃস্বপ্নের হতে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের জন্য। আবাসন খাতের সব উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছর কোম্পানি ও এলাকাভেদে নতুন প্রকল্পে ফ্ল্যাটের দাম প্রতি বর্গফুটে ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা বেড়েছে। অদূর ভবিষ্যতে দাম আরও বাড়বে। ড্যাপের নতুন নিয়মের কারণে ভবনের উচ্চতা কমে যাচ্ছে। এতে ফ্ল্যাটের চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা তৈরি হচ্ছে।
সমকাল: রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো কীভাবে এ সংকট মোকাবিলা করছে? এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় কী?
কামাল মাহমুদ : এখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে গেছে। ক্রেতাদের সঙ্গে আগে চুক্তি করা প্রকল্পগুলো চলমান আছে। গেল এক বছরে নতুন করে কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। কোনো চুক্তিও করা হয়নি। কোম্পানিগুলো কোনোমতে টিকে আছে। যার কারণে আগামীতে ফ্ল্যাটের একটা ঘাটতি তৈরি হবে। সরকারের উচিত দ্রুত ভবনের উচ্চতা বিষয়ে ড্যাপে সংশোধনী আনা। ভবনের উচ্চতা না বাড়ানো হলে আবাসন খাতের ব্যবসা হুমকিতে পড়বে। বেকার হবেন লাখ লাখ শ্রমিক। আমাদের এই ব্যবসার সঙ্গে ৪০ লাখ লোক সরাসরি জড়িত। পরোক্ষভাবে জড়িত দুই কোটি মানুষ। ঢাকাকে আমরাই নান্দনিকভাবে তৈরি করেছি। মূল ঢাকায় ভবনের উচ্চতা যদি না বাড়ানো হয়, তবে ফ্ল্যাটের সংকট তৈরি হবে। তখন ঢাকায় ব্যাপক হারে সাবলেট তৈরি হবে। এতে বসবাস করার পরিবেশ আরও বিশৃঙ্খল হবে।
সমকাল : ফ্ল্যাট-প্লটে নিবন্ধন ফি বাড়ার কারণে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে আবাসন খাতে?
কামাল মাহমুদ : চলতি অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জমি-ফ্ল্যাটের নিবন্ধনে উৎসে কর দ্বিগুণ নির্ধারণ করেছে। এতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধনে আগ্রহ কমে গেছে ক্রেতাদের। শুধু ঢাকা ও আশপাশের এলাকাতেই জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধন এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। ফলে এ খাত থেকে রাজস্ব আদায়ও প্রায় এক-তৃতীয়াংশে নেমেছে। আমরা বাজেট পাসের আগে বারবার দাবি জানিয়েছিলাম নিবন্ধন ফি কমানোর জন্য। এনবিআর উল্টো আরও বাড়িয়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। লোকজন ফ্ল্যাট ও জমি কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এতে রাজস্ব আদায় কমছে সরকারের। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, চলতি বছর নিবন্ধনে উৎসে কর আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। গত দুই মাসে আদায় হয়েছে ১২০ কোটি টাকার কাছাকাছি, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩ শতাংশেরও কম। বুঝতেই পারছেন কী ধরনের প্রভাব পড়েছে। সরকারকে অবশ্যই নিবন্ধন খরচ কমাতে হবে। খরচ কমালে রাজস্ব আদায় বাড়বে।
সমকাল : নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার ফলে উদ্যোক্তারা কী কী সমস্যা মোকাবিলা করছেন?
কামাল মাহমুদ : আপনারা জানেন, ডেভেলপার অধিকাংশ সময় ফ্ল্যাট তৈরির আগে কিছু বুকিং মানি নিয়ে সেটা বিক্রি করে দেন। নির্মাণসামগ্রীর দাম অস্বাভাবিক বাড়ায় ভয়াবহ সমস্যা তৈরি হয়েছে। ডেভেলপাররা যে দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন, সেই দামের চেয়ে নির্মাণ খরচ বেশি। ফলে ক্রেতাদের সঙ্গে ডেভেলপারদের তৈরি হয়েছে এক ধরনের জটিলতা। অনেকে চুক্তি অনুযায়ী মূল্য সমন্বয় করেছেন। আবার অনেকে চুক্তির কারণে মূল্য সমন্বয় করতে পারছেন না। ফলে লভ্যাংশ ছাড়াই ফ্ল্যাট তৈরি করতে হচ্ছে।
সমকাল : গত অর্থবছরে কতগুলো ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে আর কতগুলো ফ্ল্যাট অবিক্রীত রয়েছে?
কামাল মাহমুদ : রিহ্যাবের সদস্যরা প্রতি বছর গড়ে ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট বিক্রি করেন। এক দশক ধরে বেচাবিক্রির পরিসংখ্যান প্রায় এমনই। কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় গত বছর ফ্ল্যাট বিক্রির সংখ্যা ব্যাপক আকারে কমে গেছে। বলা চলে, বিক্রি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। মাত্র ১০ হাজারের মতো ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। নির্মাণাধীন প্রায় পাঁচ হাজার ফ্ল্যাট রয়ে গেছে। তবে কোনো রেডি ফ্ল্যাট হাতে নেই। কারণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে কম। ড্যাপের কারণে নতুন প্রকল্প নিতে পারেনি ডেভেলপাররা, যার কারণে ফ্ল্যাট তৈরির সংখ্যা কমেছে।
সমকাল : আবাসন খাতে নতুন প্রকল্প বাড়ছে কেমন? পুরোনোগুলো কীভাবে চলছে?
কামাল মাহমুদ : আগেই বলেছি, গেল এক বছরে ডেভেলপাররা নতুন কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগ করেননি। যেখানে আগে ভবন নির্মাণে উচ্চতা পাওয়া যেত ৮ বা ৯ তলা, সেখানে এখন পাওয়া যাচ্ছে ৪ বা ৫ তলা। এই ৪-৫ তলা উচ্চতা নিয়ে বিল্ডিং তৈরি করে কীভাবে টিকে থাকা সম্ভব? এ জন্য বলছি, ড্যাপ অবশ্যই সংশোধন করতে হবে এবং সেটা নাগরিকদের জন্যই। দেশ ও ব্যবসার স্বার্থে সরকারকে ভাবতে হবে, আবাসন খাতে ধস নামলে অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় হোঁচট খাবে। বাধাগ্রস্ত হবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের কার্যক্রম।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জসিম উদ্দিন বাদল
- বিষয় :
- সাক্ষাৎকার
- ড্যাপ সংশোধন
- ড্যাপ