ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

শিল্পকলা

শাহাবুদ্দিন রেট্রোস্পেকটিভ : শক্তির সঞ্চারপথ

শাহাবুদ্দিন রেট্রোস্পেকটিভ : শক্তির সঞ্চারপথ

শিল্পকর্ম : শাহাবুদ্দিন আহমেদ

হামিম কামাল

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

শাহাবুদ্দিন আহমেদ সারাবিশ্বের সেরা চিত্রকরদের একজন। আমাদের গৌরব তিনি। শাহাবুদ্দিন : রেট্রোস্পেকটিভ নামে তাঁর একটি চিত্রপ্রদর্শনী সম্প্রতি জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে সবার জন্য উন্মুক্ত হয়েছে।

শাহাবুদ্দিন বিরাট ক্যানভাসে আঁকতে পছন্দ করেন। তাঁর ছবির প্রধান দুই বৈশিষ্ট্য। এক, আকৃতি। দুই, গভীরতা। কোনো আঁকা বা লেখায় তখনই প্রাণ প্রবিষ্ট হয়, যখন তাতে গভীরতা সৃষ্টি করা যায়। শাহাবুদ্দিনের ছবিগুলোর গভীরতায় তলিয়ে যেতে হয়। প্রত্যেক শিল্পীরই পৃথক রং তৈরির কৌশল থাকে। শুধু আঁকার শৈলীতেই নয়, রংকে তারা বিনির্মাণ-অবিনির্মাণ করেন। এর সৌকর্য কেবল ছবির সামনে দাঁড়ালে অনুভব করা যায়। রঙের মিশ্রণ, প্রলেপের কোমলতা আর প্রয়োগের শক্তি এত অভিনব যে ছবির সামনে থেকে সরে এলেও বহুক্ষণ রেশ থেকে যায়। বাংলাদেশের আরেক প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী জামাল আহমেদের সঙ্গে শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ প্রসঙ্গে একবার খানিকটা কথা হয়েছিল। জামাল আহমেদ যাদের পথিকৃৎ জ্ঞান করেন, তাদের সর্বাগ্রে আছেন শাহাবুদ্দিন আহমেদ। শাহাবুদ্দিন আহমেদই তাঁকে প্রথম বলেছিলেন, “এভাবে হবে না। মানুষ আঁকতে হবে মানুষ!” শাহাবুদ্দিনের আঁকা ও বোঝাপড়ার কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। তাঁর আঁকা মানুষকে যখন আমরা দেখি, তখন চেনা মানুষের ভেতরের রূপটা ধরা পড়ে। যে রূপ আমাদের অচেনাই ছিল। এই অচেনা রূপ বিশেষ কিছু মুহূর্তে কেবল ধরা পড়ে। সেটা হতে পারে কোনো চরম সংকট মুহূর্ত। চরম মুহূর্তের পরম ত্রাতা শিল্পী। শিল্পী ঘটমান বাস্তবতার ভেতর থেকে এমন অদেখা প্রতি/পরা/অধিবাস্তবকে বের করে আনেন, যা চোখের আড়ালে ছিল। সেইসব রূপছবি মানুষের ‘আত্মার’ শক্তিকে জাগ্রত করে। ছবিগুলোয় শুধু যে দার্শনিক প্রাণ অনুভূত হয় তা নয়। কোনো ছবি দেখে মনে হয়, তার চরিত্রটি বুঝি নড়ে উঠল। এবং পদশব্দ শোনা গেল। কোলাহল শোনা গেল। শুধু দর্শনানুভূতি দিয়ে সমস্ত ইন্দ্রিয়ানুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারে শাহাবুদ্দিন আহমেদের ছবি। এই সংকটের প্রতি, বীরত্বের প্রতি তাঁর একটা ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। ছবিগুলো পুরুষ যতটা নান্দনিকতা নিয়ে এসেছে, নারীর ততটা নয় বলেই মনে হয়। পুরুষের বলিষ্ঠতা, যাত্রা, সংঘাত, উত্থান ও পরিণতি লাভ– তা বিজয়ে কিংবা মৃত্যুতে একরকম পরিপূর্ণতা নিয়ে ছবিগুলোয় উপস্থিত। নারীবোধক যে ছবিগুলো আছে তাদের ভেতর একটিই বিশেষ নজর কেড়েছে দর্শকদের। নারীরা সেখানে হাওয়ায় নড়া বৃক্ষের মতো দোলায়মান, আর্ত। ছবিটায় এমন করুণ নন্দন! তবে নারীর শক্তিকে তিনি ভিন্নপথে আবিষ্কার করেছেন। সেখানে তাদের কোমলতা, সৌন্দর্য আছে, আছে যাতনাবিকৃত মুখ। যে রকম চরিত্রই আসুক, যে পথেই সে নিজেকে ব্যক্ত করুক, প্রতিটি ছবি থেকে শক্তি উৎসারিত। এস এম সুলতানের পর এমন শাক্ত (শক্তির উপাসক) চিত্রকর আমরা আর পাইনি বলেই মনে হয়। ছবিগুলো তাদের স্বতন্ত্র উপস্থিতি দিয়েই নিজের নাম ঘোষণা করবে, শিল্পী বোধ হয় এই চেয়েছিলেন। তাই তাঁর ছবিগুলোর ভেতর ‘শিরোনামহীন’ নামের ছবিরই আধিক্য। সেইসব ছবি সজ্জা ও ভাষায় যুদ্ধ, প্রত্যাবর্তন, গমন, লড়াইয়ে মানুষের আবেগ এতটাই পুঞ্জীভূত ও অধীর যে নামের মুকুট তারা পরেনি। তবে সব ছবি শিরোনামহীন নয়। নামের কিরিট পরেছে ‘মুক্তিযোদ্ধা’, বঙ্গবন্ধুকে আঁকা ‘দ্য লিজেন্ড, কবিগুরুতে আঁকা ‘রবীন্দ্রনাথ’ প্রভৃতি। শাহাবুদ্দিন এত অমূল্য এক অমৃত, যাকে ধারণ করার মতো পাত্র আমাদের নেই বলেই মনে হয়। নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে ছবিগুলোর সজ্জা কিন্তু মনে স্বস্তি দেয় না। যথাযোগ্য মর্যাদায় ছবিগুলোকে আমরা রাখতে পারিনি ভোল্টে মনে হলো। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০২৩ সাল অবধি শতাধিক ছবির সেখানে স্থান হয়েছে। বেশ আঁটো। শ্বাসের স্থান নেই। ছোট একটা ঘরে অনেক মানুষ এলে যেমন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, ছবিগুলো সন্নিবেশ দেখেও তেমনি দম বন্ধ লাগে। কোনো কোনো ছবি প্রদর্শনীর বিজ্ঞানকে লঙ্ঘন করে বেশ ওপরে রাখা। তাদের অনুভব করা যায় কিনা, আমি সন্দিহান। তবে বেশির ভাগ ছবিই দূর থেকে দেখতে পাওয়ার অবকাশ আছে। ইতিহাসপ্রিয় শাহাবুদ্দিন আহমেদ কেবল চিত্রকলার জীবন্ত কিংবদন্তি নন; তিনি একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। অর্থাৎ দুটি দিক থেকে তিনি ইতিহাসের চরিত্র। গেরিলা যোদ্ধাদের অনেক দল-উপদলের মধ্যে অভিযানের বিচিত্রতার কারণে যে দলগুলোর নাম আমাদের সামনে বারংবার এসেছে, তাদের একটি– ক্র্যাক প্লাটুন। শাহাবুদ্দিন আহমেদ ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের একজন গেরিলা যোদ্ধা। চলতি প্রদর্শনীতে তিনি নিয়মিতই আসছেন। এবং তাঁকে ঘিরে ছোট শিশুদের একটা আসর বসে যাচ্ছে। সেখানে তিনি ছবি আঁকা আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলছেন। প্রতিবার বলা ঘটনাগুলো বিভিন্ন। তবে বিভিন্নতার ভেতর একটা মূল সুর আছে। দেশপ্রেম, যে দেশপ্রেমের প্রারম্ভিক বহিঃপ্রকাশ-বাক্য ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জয় বাংলা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।’ গেরিলা যুদ্ধে একেক অভিযানের সদস্যসংখ্যা ছিল স্বল্প। কিন্তু তারা গুলিবর্ষণ কিংবা আক্রমণের সময় এত কোণ থেকে এত স্বরে জয় বাংলা বলে উঠতেন যে শত্রুর মনে হতো তারা সংখ্যায় অনেক। জয় বাংলা ছিল রক্ষাকবচ। তাঁর যোদ্ধাসত্তা আর শিল্পীসত্তাকে এই জয় বাংলা অংশে আলাদা করা যায় না। সত্তরের দশক থেকে সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশক অবধি এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর তুলি চালনা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে। সবচেয়ে ঋদ্ধ সময়টা নব্বইয়ের ঘরে বাঁধা কিনা, বলা যায় না। তবে দশকেই অনবদ্য গতি-গল্পময় বিচিত্র সব ছবি বোধ করি সবচেয়ে বেশি আঁকা হয়। প্রায় পাঁচ দশকের এই সময়কালে আঁকার প্রকার বদলেছে, কিন্তু আদর্শ ছিল অটল। সেই আদর্শ তাঁর জয় বাংলা মন্ত্রের দান। শাহাবুদ্দিনের আঁকা, ব্যক্তি দ্বারা আহিত ছবির কথা যদি বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বোধ হয় সবচেয়ে বেশি আসবে। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, তাঁর দোর্দণ্ড রূপ থেকে মৃত্যুশয়ান শাহাবুদ্দিনের তুলিতে বারংবার এসেছে। শাহাবুদ্দিন : রেট্রোস্পেকটিভে স্থান পাওয়া ছবিগুলো বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা থেকে এনে জড়ো। বেশির ভাগ ছবিই উত্তমরূপে সংরক্ষিত, বলতেই হয়। শাহাবুদ্দিন আহমেদের সৃষ্ট সাদা, ধূসর, লাল রঙের অপাপবিদ্ধ সৌন্দর্য, তা কয়েক দশকের ব্যবধানেও অটুট। শাহাবুদ্দিনের স্বকীয় শৈলীর বাইরেরও কিছু নজরকাড়া ছবি এখানে দেখতে পাওয়া যাবে। যেখানে ইউরোপীয় শিল্পকর্মের প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। এ ছাড়া আছে কিছু জলরঙের কাজও। আছে দূর অতীতে আঁকা কিছু কাজ, যখন শাহাবুদ্দিন আহমেদ আজকের কিংবদন্তিটি নন। যিনি বিশ্বের পঞ্চাশ সেরা চিত্রশিল্পীর একজন, যিনি আমাদের স্বাধীনতা পদকে সম্মানিত, এমনকি যিনি একজন নাইট; ফরাসি সরকার তাঁকে এ উপাধিতে ভূষিত করেছে। মানুষের শিল্পপ্রিয় মন এ প্রদর্শনীতে এসে পূর্ণতা পাচ্ছে। শিশুরা গৌরবের গল্প নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। তরুণ শিল্পীদের জন্য এ প্রদর্শনী শক্তির অনিঃশেষ উৎস। আঁকা ছবিতে পূর্ণ গ্যালারিতে প্রবেশের আগে, প্রবেশপথে দেয়ালের দু’পাশে রয়েছে শাহাবুদ্দিন আহমেদের সারাজীবনের বিভিন্ন বিশেষ মুহূর্তের ছবি। কোথাও আত্মমগ্ন বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, কোথাও পরিবারের সঙ্গে উজ্জ্বল, কোথাও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, কোথাও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে প্রাঞ্জল। ভেতরে ও জাদুঘরের বাইরে চিত্রকলার বিস্ময় এই শিল্পীর এত বিপুল সংগ্রহ নিয়ে প্রদর্শনী দুর্লভ। ১৫ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী চলবে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত। দীর্ঘ এক মাসের অবকাশে প্রদর্শনীতে এসে তাদের দেখার জন্য ছবিগুলো আন্তরিক অনুরোধ পাঠাচ্ছে। 

আরও পড়ুন

×