সাক্ষাৎকার
বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর

শেখ ইউসুফ হারুন, নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ
জসিম উদ্দিন বাদল
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
সমকাল: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর স্থাপনের কাজ কবে শুরু হয়?
শেখ ইউসুফ হারুন : দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগের একটি হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। ২০১৪ সালের শেষ দিকে এই শিল্পনগর স্থাপনের জন্য জমি বন্দোবস্ত ও অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়। এরপর চলতে থাকে নানা পরিকল্পনা। ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর শিল্পনগর স্থাপনের মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। সে অনুযায়ী একে কয়েকটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। এরপর বিনিয়োগ উপযোগী করে গড়ে তুলতে শুরু হয় অবকাঠামো নির্মাণের যাবতীয় কাজ, যা এখনও চলমান।
সমকাল : এ শিল্পনগর নিয়ে বিনিয়োগকারীদের বেশ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে মূল কারণ কী?
শেখ ইউসুফ হারুন : অনেক কারণ আছে। বিনিয়োগ, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে যেসব সুযোগ-সুবিধা দরকার, তার সবই নিশ্চিত করা হচ্ছে। একে দেশের প্রথম পরিকল্পিত ও বৃহৎ শিল্পনগর হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে, যাকে আমরা স্মার্ট নগরী বলছি। শিল্প ছাড়াও একটি পূর্ণাঙ্গ শহরের সম্ভাব্য সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেই সেটিকে গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে হালকা, মাঝারি, বৃহৎ ও ভারী সব ধরনের শিল্পকারখানা থাকবে। জনজীবনে প্রয়োজন এমন সব ধরনের পণ্যই উৎপাদন হবে সেখানে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও সেখানে থাকবে আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, নগর কেন্দ্র, বিজনেস হাব, সার্ভিস জোন, প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও পুনর্বাসন এলাকা। পরিকল্পনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট এলাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সমুদ্রপথে আমদানি-রপ্তানির জন্য শিল্পনগরে অত্যাধুনিক জেটি এবং লজিস্টিকস সুবিধা দেওয়ার জন্য রাখা হয়েছে আলাদা এলাকা। এ শিল্পনগর হবে সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। মাল্টিমোডাল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। এসব কারণে দিন দিন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর।
সমকাল : এই শিল্পনগরে উৎপাদন কার্যক্রমের অগ্রগতি কতটুকু?
শেখ ইউসুফ হারুন : বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। উদ্যোক্তাদের জমি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। বর্তমানে সেখানে ২১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণাধীন। গত বছরের ২০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী চারটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক উৎপাদন এবং কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো নির্মাণের উদ্বোধন করেছেন। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করবে; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বসুন্ধরা কেমিক্যাল, এসকিউ, মডার্ন সিনটেক্স ও বাংলাদেশ অটো।
সমকাল : ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেজার ওয়ান স্টপ সার্ভিস আরও শক্তিশালী করা দরকার। এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
শেখ ইউসুফ হারুন : ওয়ান স্টপ সার্ভিস বা ওএসএস সেন্টারের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের নির্বিঘ্নে সেবা প্রদানের জন্য বেজার প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদে ওএসএস আইন পাস হয়। এখন ট্রেড লাইসেন্স, জমি নিবন্ধন, নামজারি, পরিবেশ ছাড়পত্র, নির্মাণ অনুমোদন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ, টেলিফোন-ইন্টারনেট সংযোগ, বিস্ফোরক লাইসেন্স, বয়লার সার্টিফিকেটসহ ২৭ ক্যাটেগরির সেবা এক জায়গায় পাওয়া যায়। ৫৩টি সেবা অনলাইনে প্রদানসহ প্রায় ১২৫টি সেবা ওএসএস সেন্টার থেকে দেওয়া হচ্ছে। যেসব সেবা এখনও অনলাইনের আওতায় নেই, সেগুলো দ্রুত অনলাইনে রূপান্তরের কাজ করছে বেজা।
সমকাল : সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সেবা পেতে এখনও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এ ব্যাপারে বেজা কীভাবে সহায়তা করছে বিনিয়োগকারীদের?
শেখ ইউসুফ হারুন : সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে ব্যবসা সহজীকরণে এবং সেবার মান উন্নয়নে বেজা প্রতিনিয়ত তৎপর রয়েছে। সব সংস্থার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয়সাধন ছাড়াও ব্যবসায়ীদের পক্ষে দেনদরবারও করছে বেজা। এ সমন্বয় চলছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়েও। যেসব প্রণোদনা ইতোমধ্যে চালু রয়েছে তা যথেষ্ট আকর্ষণীয়। তবুও তার মধ্যে পরিবর্তন, পরিমার্জন, আইনের সংস্কার, নীতিমালা প্রণয়ন ছাড়াও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়মিত সভা ও কর্মশালার আয়োজন করে আসছে বেজা। কাজেই বিনিয়োগকারীদের সহায়তা সবসময় অব্যাহত রয়েছে এবং তা ভবিষ্যতে থাকবে।
সমকাল : কোনো কোনো উদ্যোক্তা মনে করেন, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ইতোমধ্যে জমির দাম অনেক বেড়ে গেছে। জমির দাম কমালে বিনিয়োগ আরও ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করেন তারা। এ ব্যাপারে বেজার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
শেখ ইউসুফ হারুন : বেজার মূল লক্ষ্য দেশে বিনিয়োগ বাড়িয়ে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। সে জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেক কম দামেই জমিসহ অন্যান্য ইউটিলিটি সংযোগ দিচ্ছে। তবে বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। অর্থসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় উৎস সৃষ্টি করতে হয় বেজার। এরপরও যে দামে বিনিয়োগকারীদের জমি লিজ দেওয়া হচ্ছে, তা অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে এখনও অনেক কম। এ কারণে বেজার অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি বরাদ্দ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে।
সমকাল : জ্বালানি-অবকাঠামোসহ নানা সুবিধা কত দ্রুত আপনারা দিতে পারছেন? সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় কত দ্রুত চলছে?
শেখ ইউসুফ হারুন : অর্থনৈতিক অঞ্চলে গুণগত মানের গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহে বেজা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছে। আমরা বিনিয়োগকারীদের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ করে আসছি। বাস্তবায়নাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর, জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল, শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
সমকাল : বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাই। কেমন সাড়া মিলছে? বিদেশি বিনিয়োগকারীদের করোনায় যে স্থবিরতা ছিল, তা কি কাটতে শুরু করেছে?
শেখ ইউসুফ হারুন : এ যাবৎ আমরা মোট ৩২টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে ১৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছি, যার মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে। অস্ট্রেলিয়ার টিআইসি, জার্মানির সেগওয়ার্ক, সিকা, চীনের মিইগো, নরওয়ের জতুন, জাপানের হোন্ডা, ভারতের এশিয়ান পেইন্টস ও সাকাতা, জাপানের নিপ্পনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণাধীন রয়েছে। জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চলে তুরস্কের একটি প্রতিষ্ঠানের জয়েন্ট ভেঞ্চার বিনিয়োগ রয়েছে। এ ছাড়া জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বৈদেশিক বিনিয়োগে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। সেখানে জাপানের কোম্পানি ছাড়াও তুরস্ক, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, ইতালিসহ কয়েকটি দেশের প্রতিষ্ঠান শিল্পকারখানা নির্মাণে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে।
আমরা প্রচুর আশাবাদী এই বিশেষায়িত জিটুজি অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে। এটি বিশ্বমানের একটি আধুনিক অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে। অঞ্চলটি রাজধানীর নিকটবর্তী নারায়ণগঞ্জে হওয়াতে আগামীতে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হবে। সেই সঙ্গে সুদক্ষ জনবল তৈরি হবে এবং স্থানীয় ও রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য আনবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে আমরা এখন বিদেশি উদ্যোক্তাদের অধিকতর প্রাধান্য দিচ্ছি। কভিড মহামারিকালেও বেজা প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জসিম উদ্দিন বাদল
- বিষয় :
- সাক্ষাৎকার
- বিনিয়োগকারী
- বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর