পরিবেশবান্ধব টেকসই আবাসন নির্মাণ জরুরি

ছবি : মামুনুর রশিদ
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ২২:২৮ | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ২২:৩৪
নগরায়ণে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। নগরায়ণে যেসব উপকরণ ব্যবহার হয়, সেগুলো পরিবেশবান্ধব নয়। অথচ প্রাকৃতিকভাবে সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে স্বল্প খরচে গৃহনির্মাণ করে এ বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। তাই দেশি প্রযুক্তিতে পরিবেশবান্ধব আবাসন নির্মাণ করতে হবে। বিশেষ করে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় সহজলভ্য উপকরণে স্বল্প খরচে গৃহনির্মাণ জরুরি। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। গত ১৬ নভেম্বর রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকালের সভাকক্ষে এক গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেন। ‘দুর্যোগ সহনশীল গৃহনির্মাণে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার: প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক এ বৈঠকের আয়োজন করে ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ ও সমকাল
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে (এইচবিআরআই) আমি একটি দায়িত্ব দিচ্ছি। আপনারা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে সমন্বয় করবেন। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বলা আছে, ২০২৫ সালের পর সরকারি কোনো কাজে আর মাটি দিয়ে পোড়ানো ইট ব্যবহার করা হবে না– এ বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য উপদেষ্টার সঙ্গে সমন্বয় করে রোডম্যাপ তৈরি করবেন। একই সঙ্গে সেটি কাজে লাগাতে হবে। কোনো ধরনের রোডম্যাপই নেই। শুধু একটি ‘পলিসি কমিটমেন্ট’ আছে। এটি সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়ও ছিল, অষ্টমেও আছে। কিন্তু এতে কোনো কাজ হচ্ছে না। প্রাথমিকভাবে এইচবিআরআইকে এ দায়িত্ব নিতে হবে। ইনস্টিটিউটকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে অংশীজনদের নিয়ে একটি সভার মাধ্যমে রোডম্যাপের আউটলাইন তৈরি করতে হবে। সরকার কোন কোন খাতে পোড়ানো ইট ব্যবহার করে, কোন কোন খাতে কত দিনের মধ্যে এই ইটের ব্যবহার ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা যায় এবং সেখানে প্রথাগত ইট যারা বানান, তাদের ভূমিকা কী হতে পারে– এ বিষয়গুলো রোডম্যাপে থাকতে হবে।
গণপূর্তের সঙ্গে সভায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় থাকবে। এ ছাড়া কাস্টমসকেও রাখতে হবে। কেননা ব্লক বানানোর প্লেট বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু দেখা যায়, কাস্টমস তা অনেক সময় আটকে দেয়। এতে আমদানিকারকদের ক্ষতি হয়। কাস্টমসকে এ বিষয়টি বুঝতে হবে। একইসঙ্গে ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউকে (এনবিআর) রাখতে হবে। বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনকেও রাখা যেতে পারে। তারা বাঁশ ও বেতের উৎপাদন বাড়াতে কাজ করবেন, মার্কেটিং করবেন। বর্তমানে অ্যাসবেস্টস নিয়ে কথা হচ্ছে। আমাদের কি এর ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা আছে? বিশ্বের অনেক দেশ তো অ্যাসবেস্টস নিষিদ্ধ করেছে। এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ভাবতে হবে। এ সভায় দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসনের কাজের সঙ্গে জড়িত বড় এনজিওগুলোকেও রাখতে হবে। সবার সঙ্গে কথা বলে আমাদের রোডম্যাপ তৈরি করতে তিন মাস সময় নেওয়া যেতে পারে। রোডম্যাপ অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। সরকারি সংস্থাগুলোকে শুধু প্রতিশ্রুতি দিলে হবে না, কাজ করতে হবে।
পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ। অন্যদিকে নিজেদের স্বার্থে প্লাস্টিকের ব্যবহার থেকে আমাদের আস্তে আস্তে সরে আসতে হবে। কিন্তু আমরা তো অনেক পলিথিন ও প্লাস্টিক জমিয়ে ফেলেছি। সেগুলো রাস্তা তৈরিতে কিংবা ভবন নির্মাণে বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে পারি কিনা, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এটি করা গেলে আবর্জনার পরিমাণ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
গবেষণার জন্য সব সময় সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না। কেন সবাই গবেষণার জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকবে? যারা গবেষণা করেন, তারা ফান্ডের জন্য চেষ্টা করবেন। সবকিছু সরকার করে দিতে পারবে না। গবেষকদেরও নিজেদের কাজ নিয়ে এগোতে হবে।
সরকার শুধু কাগজের গবেষণায় টাকা দেবে না। গবেষণা হতে হবে ‘অ্যাকশনবেজড’। সরকার যখন তার নির্মাণে ব্লক ব্যবহার করবে, তখন মানুষও উৎসাহিত হবে। সংকোচ বোধ করবে না।
রেজওয়ানুর রহমান
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ক্ষতিগ্রস্তদের আবাসনের ব্যবস্থা করে থাকে। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এখন আমরা ইটের জায়গায় ব্লকের ব্যবহার করতে পারি। উপকরণের সহজলভ্যতা এবং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এলাকাভেদে ভিন্নতা রয়েছে। উপকূলীয় এলাকা এক রকম, হাওর এলাকা আরেক রকম, আবার উত্তরাঞ্চলে অন্যরকম। গাজীপুর ও নরসিংদীতে অনেক মাটির বাড়ি রয়েছে। তারা এতেই অভ্যস্ত। এ বিষয়গুলো আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
কোন ধরনের বাড়ি টেকসই হবে এবং নির্মাণ খরচ কম হবে– এ নিয়ে গবেষণা করতে হবে। জেলা প্রশাসকরা ইটভাটার লাইসেন্স দিয়ে থাকেন। আবার নতুন ইন্ডাস্ট্রিকে উৎসাহ দিতে গেলেই দেখতে হয়, অন্যদের তুলনায় ভ্যাট বেশি হয়। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়, এনবিআর এবং জেলা প্রশাসকরা একসঙ্গে বসতে পারেন।
ড. মাহবুবা নাসরীন
আমি যখন দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় যাই, তখন সব বাড়িঘর পড়ে গেছে এমনটা দেখি না। খুব সম্প্রতি বাগেরহাটের রায়েন্দা ইউনিয়নে গিয়েছিলাম। সেখানে স্থানীয় উপকরণ দিয়ে বানানো বাড়িগুলো টিকে থাকতে দেখেছি। বাড়ি নির্মাণে প্রতিটি অঞ্চলে স্থানীয় জ্ঞানের চর্চা আছে। এই চর্চাকে ধরে রাখতে হবে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বাড়ি নির্মাণে স্থানীয় উপকরণ হারিয়ে যাচ্ছে। এই উপকরণগুলো কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। যেহেতু কংক্রিটে অনেক খরচ, সেহেতু স্থানীয় উপকরণ ফিরিয়ে এনে তা কাজে লাগাতে হবে। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে বাড়ি নির্মাণে কংক্রিটের ব্যবহার বাড়ছে। শহর তো বটেই, গ্রামেও এ প্রবণতা প্রকট আকার নিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশটা কংক্রিটসর্বস্ব হয়ে উঠবে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী
নদীর পাড়ের ক্ষয়রোধ করতে হবে। কূলগুলো এমনভাবে রক্ষা করতে হবে, যাতে পানি এসে ধাক্কা দিলে যেন পাড় ক্ষয় না হয়। এটি করা গেলে বারবার খরচ করতে হবে না। আমরা যদি কোনো গ্রামের চারপাশটা রক্ষা করতে পারি, তাহলে খরচ অনেক কমে আসবে। বাঁশের বাড়ি ১০০ বছর পর্যন্তও টিকে থাকে। আমরা কেন এই বাঁশ নিয়ে গবেষণা করছি না? আমরা কেন শুধু সিমেন্টের কথা বলছি? যেখানে সারাবিশ্বে বাঁশের বাড়ি বানানো হচ্ছে, আমরা কেন সেদিকে যাচ্ছি না? বাঁশের বাড়িতে খরচ অনেক কম। কিন্তু এতে আমরা বিনিয়োগ করছি না। বাঁশের চাষ হচ্ছে না। বাঁশ প্রক্রিয়া করে ১০০ বছর পর্যন্ত টেকানো সম্ভব। বন্যা, ভূমিকম্প এবং সাইক্লোন– সবক’টির ক্ষেত্রে আমরা যদি মাটিকে টিকিয়ে রাখতে পারি, তাহলে বাসাবাড়ির ক্ষতি কম হবে। এসব নিয়ে গবেষণা বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
ড. মোশতাক আহমেদ
সিলেটে প্রধান দুর্যোগ হলো ভূমিকম্প। ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে বড় ভবন নিয়ে গবেষণা হলেও দরিদ্রদের বাড়িঘর ভূমিকম্পে কীভাবে টেকসই করা দরকার– তা নিয়ে গবেষণা কম হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গবেষণা হলেও এ বিষয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করা দরকার। সব ধরনের বাসস্থান রক্ষা করতে হবে।
আগে সিলেটে ‘আসাম’ টাইপের ভবন নির্মাণ করা হতো। এখন জায়গার অভাবে শহরে সেটি সম্ভব নয়। কিন্তু গ্রামে এটি করা যেতে পারে। কারণ, এ ধরনের ভবন ভূমিকম্প সহনশীল। সিলেটে অন্যান্য দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে অতিবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা কিংবা হাওরের ঢেউ– এই দুর্যোগগুলো খুব বেশি হয়। এ জন্য আমাদের চিন্তা করতে হবে, কোন উপকরণ ব্যবহার করলে এসব দুর্যোগ থেকে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। সড়কের উপরিভাগের অংশ অনেক ক্ষয় হয়। এটি মেরামতে অনেক খরচ হয়। এটি দীর্ঘস্থায়ী করতে আমরা কী করতে পারি, তা নিয়ে ভাবতে হবে। হাওর এলাকায় ডুবন্ত রাস্তায় ব্লক ব্যবহার করা হলেও সেগুলো টিকছে না। পানির নিচে টিকে থাকবে এমন ব্লক তৈরি নিয়ে গবেষণা করতে হবে।
প্রাকৃতিকভাবে সহজলভ্য উপকরণে স্বল্প খরচে বাড়িনির্মাণ নিয়ে আমার এক গবেষণায় দেখিয়েছি, কংক্রিটের মধ্যে বাঁশ কিংবা বেত ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। এটি করলে যেসব বাড়ি বন্যায় নষ্ট হয়ে যায়, সেগুলো অন্তত ১০ বছর টিকবে। এটি অনেক ভালো একটি অপশন। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনি।
ভেঙে ফেলা ভবনগুলোর কংক্রিটগুলো পুনরায় ব্যবহার করে কংক্রিট তৈরি করা যেতে পারে। এতে করে বর্জ্য নিঃসরণ হবে, আবার সাশ্রয়ও হবে। কিছু কিছু প্লাস্টিক আছে, যার কোনো দাম থাকে না। গবেষণার অংশ হিসেবে সেগুলোকে কংক্রিটে ব্যবহার করে টয়লেটের রিং তৈরিতে ব্যবহার করেছিলাম। এতে ভালো ফলাফল এসেছে এবং সিলেটে এর ব্যবহারও হচ্ছে।
তালহা জামাল
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাত মোকাবিলায় টেকসই সবুজ সমাধান অপরিহার্য। শেল্টার নির্মাণে পরিবেশবান্ধব টেকসই উপকরণ ব্যবহার করা ইট এখন আর ঐচ্ছিক বিষয় নয়। কোনো একক প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার এবং সবার প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা একটি দুরুহ বিষয়। এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত। সব অংশীজনের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে সুন্দরভাবে এ কাজ করা সম্ভব। সরকার, এনজিও, একাডেমিয়া এবং প্রাইভেট সেক্টরগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এ কাজের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। বিভিন্ন উদ্ভাবনী পদ্ধতি বের করার সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ এ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। একটি পরামর্শমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ খাতে সম্ভাবনা, প্রতিবন্ধকতা পর্যালোচনাপূর্বক সামাজিক গ্রহণযোগ্য এবং সাশ্রয়ী সবুজ প্রযুক্তির জন্য গবেষণা ও অর্থায়ন ও বিস্তার করা যেতে পারে। ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ এই সকল উদ্যোগ গ্রহণে সরকারি ও অন্যান্য অংশীজনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগী হিসেবে কাজ করতে বদ্ধপরিকর।
মো. শামছুজ্জামান
দেশে মাথাপিছু কৃষিজমির পরিমাণ ১২ ডেসিম্যাল, যার প্রায় এক শতাংশ আমরা প্রতি বছর অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে হারাচ্ছি। আমাদের ভূমির উপরিভাগের মূল্যবান মাটি ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে নগরায়ণের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল ইট। একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান ক্রমেই অধিকতর হুমকির সম্মুখীন হয়েছে এবং হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, শুধু ২০২৪ সাল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সমগ্র দেশ বড় এবং মাঝারি মিলে পাঁচটি দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে। ফলে প্রায় সাত লাখ পরিবারের ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে দুর্বল অবকাঠামো এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আবাসনের ক্ষতিগ্রস্ততা শীর্ষে রয়েছে। হিসাব করলে দেখা যায় এই আবাসনের পুনর্নির্মাণ মূল্য প্রায় ১৭ মিলিয়ন ডলার। অথচ সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ মাত্র ১.৯ মিলিয়ন ডলার, যা প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ৯ গুন কম।
এ ছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে আমরা এক বিপর্যস্ত পরিবেশে বসবাস করছি। নগরায়ণে ব্যবহৃত কাঁচামাল পরিবেশের জন্য প্রচণ্ড হুমকিস্বরূপ। নগরায়ণের কাঁচামাল হিসেবে বছরে প্রায় ১৭.২ বিলিয়ন ইট ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এক মিলিয়ন ইট উৎপাদন করতে ২৪০ টন কয়লার প্রয়োজন। এই পরিমাণ ইট উৎপাদনের ফলে একদিকে যেমন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বাড়ছে, অন্যদিকে কৃষিজমির পরিমাণ কমছে।
সরকারের পলিসিগুলো মানুষের প্রান্তিকতার মূল কারণ কতোটা চিহ্নিত করতে পেরেছে বা আদৌ চিহ্নিত করতে পেরেছে কিনা তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত উপকরণের সহজলভ্যতার অভাব রয়েছে। একইসঙ্গে সামাজিক ও ঐতিহ্যগতভাবে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি আমাদের ভেবে দেখা উচিত। তদুপরি পরিবেশবান্ধব ও পরিকল্পিত আবাসনের নকশাও নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে ইটের পরিবর্তে যেসব কাঁচামাল ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলোর স্থায়িত্ব, গুণগত মান ও গ্রহণযোগ্যতা পরীক্ষামূলক উপস্থাপন করার দাবি রয়েছে।
মো. নাফিজুর রহমান
আমার কাছে প্রতি সপ্তাহে একজন-দু’জন করে উদ্যোক্তা আসেন। তারা ব্লকের ইন্ডাস্ট্রি করতে চান। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই ইট উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কেউ নন। ইটভাটার মালিকরা এ বিষয়ে জানেন, তাদের জায়গা আছে, সেটআপ আছে। তারা আসছেন না। ইটভাটার মালিকরা কেন আসছেন না? এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি ‘সফট ফিন্যান্সও’ আছে। তারপরও তারা আগ্রহী হচ্ছেন না। কারণ, ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে আগ্রহী হচ্ছে না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের একটা দায়িত্ব দিয়েছে, এ ধরনের ব্লক ইন্ডাস্ট্রি যারা করবেন, তাদের সার্টিফিকেট দেওয়া।
উপকূলীয় এলাকায় আমরা কয়েকটি এনজিওর সহায়তায় কিছু সাইক্লোন সহনশীল বাড়ি বানিয়েছি। এর চমৎকার প্রতিক্রিয়া এসেছে। স্থানীয় উদ্যোক্তাও তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা হলো ফান্ডিং। এসব ক্ষেত্রে ব্যাংক কিছু করে না। এ জায়গাটা আমাদের দেখতে হবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের মাত্র ৫ শতাংশ সুদে ফিন্যান্সিংয়ের একটা সুযোগ আছে। আমরা সনদায়নেরও ব্যবস্থা করেছি। এই সনদ নিলে অর্থায়ন পাওয়া সহজ হবে। ব্যাংকের মাধ্যমে না করে এনজিওর মাধ্যমে অর্থায়নটা করা যেতে পারে।
এফএম আনোয়ার হোসেন
আমাদের দেশে চার থেকে পাঁচ রকমের বাঁশ আছে। কিন্তু গৃহনির্মাণের জন্য যেমন শক্ত বাঁশ প্রয়োজন, তা এ দেশে হয় না। অনানুষ্ঠানিকভাবে চীনের কিছু বাঁশ দেশে এসেছে। কার্বন নিঃসরণ কমানো দেশের জন্য অতি জরুরি। আমাদের কার্বন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সিমেন্টের ব্যবহার কমাতে হবে। অন্যদিকে, স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তা কম। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছ থেকে একটি অনুমোদন নিতে হয়, যা পাওয়া খুবই কঠিন। এ ক্ষেত্রে সরকার স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব স্থাপনা তৈরিতে সহায়তা করলে ব্লক কিংবা ইট থেকে বেরিয়ে এসে টেকসই বাড়ি নির্মাণ সম্ভব। গ্রামে এখন চার-পাঁচ তলা ভবন হচ্ছে। এর জন্যও একটা নীতিমালা করা দরকার। জমি বাঁচিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে বাড়ি নিয়ে কীভাবে বাড়ি করা যায়, সেটি দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র থাকা দরকার।
ইঞ্জিনিয়ার মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন
দেশে বড় দুর্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে– বন্যা, সাইক্লোন, আগুন, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা এবং ভূমিকম্প। এ কয়েকটা ফ্যাক্টর চিন্তা করে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে আমরা অনেক চিন্তা করি। এ ক্ষেত্রে উপকরণের পাশাপাশি কৌশলগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। নিরাপদ বাড়ি বানানোর কৌশল এবং কম টাকায় দুর্যোগ সহনশীল বাড়ি করতে রাজমিস্ত্রী ও কাঠমিস্ত্রীর কতটুকু কাজ– সেই বিষয়গুলোও আমাদের চিন্তা করতে হবে। শুধু উপকরণই যথেষ্ট নয়। এ দুটি বিষয়ও লাগবে।
সিমেন্ট পরিবেশবান্ধব নয়। সে ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা করতে হবে প্রকৃতিতে এর বিকল্প কী আছে। এ ক্ষেত্রে বিকল্প হতে পারে চুন। মাটির সঙ্গে চুন মিশিয়ে ব্লক বানানো গেলে খুবই ফলপ্রসূ হবে। এ নিয়ে গবেষণা হতে পারে। উপকূলীয় এলাকায় সিজিআই শিট ব্যবহার করা হয়। লবণাক্ততার কারণে তাতে খুব কম সময়ে মরিচা ধরে যায়। সে ক্ষেত্রে ওই এলাকার মানুষজন অ্যাসবেস্টস বা সিমেন্ট শিট ব্যবহার করছে। এটি পরিবেশবান্ধব নয়। অ্যাসবেস্টস স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। অনেক দেশেই এসব শিট নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সিজিআই এবং সিমেন্ট শিটের বিকল্প দরকার। কেননা সাইক্লোনপ্রবণ এলাকায় সিজিআই শিটগুলো উপড়ে মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে। গ্রামের মানুষ ইট এবং টিনের ঘর খুব পছন্দ করে। কারণ, তাদের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের এটি নিয়ে কাজ করতে হবে। এ নিয়ে গবেষণার সুযোগ বাড়াতে হবে। সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে।
এ কে এম জহিরুল আলম
পোড়া মাটির ইটের জন্য কাঁচামাল হিসেবে কৃষিজমির উপরিভাগের ৬ কোটি টন মাটি উত্তোলন করা হয়। এটি আমাদের কৃষিকেও হুমকির মুখে ফেলছে। এ ছাড়া ৩০ লাখ টন জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করা হয়। আবাসন খাত থেকে ৩০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। তাই যে কোনো নির্মাণকাজ পরিবেশবান্ধব হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু পরিবেশবান্ধব করতে গিয়ে পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কাঠের ঘর পরিবেশবান্ধব হলেও খেয়াল রাখতে হবে যে এই শিল্পের প্রসার ঘটলে আমাদের বনের পরিধি কমে যাবে।
বাংলাদেশের ঘরগুলোকে চারটা ভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলো হলো– পাকাবাড়ি, সেমি-পাকাবাড়ি, কাঁচাবাড়ি এবং ঝুপড়িবাড়ি। এ দেশে কাঁচাবাড়ির সংখ্যাই বেশি। কাঁচাবাড়ি রয়েছে ২ কোটি ৩৬ লাখ ৬১ হাজার ৬৩৩টি। ঝুপড়ি আছে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৬৭টি। যদি ৫০ বছর পরের কথা চিন্তা করা হয়, তাহলে এ ঝুপড়িগুলোই একসময় পাকা কিংবা সেমি-পাকা হবে। এখন থেকেই আগামী ৫০ বছরের কথা চিন্তা করতে হবে। ভবিষ্যতে যারা এ ধরনের বাড়ি নির্মাণ করবে, যেন পরিবেশবান্ধব হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
ইঞ্জিনিয়ার মো: জাকির হোসেন
ইসলামিক রিলিফ ১৯৯১ সাল থেকে জরুরি ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশে কাজ শুরু করে। জরুরি ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে জরুরি গৃহনির্মাণ সামগ্রী প্রদান ও স্থায়ী গৃহনির্মাণ করে আসছে। সচরাচর শেল্টার নির্মাণ সামগ্রীগুলো পরিবেশবান্ধব নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ বর্তমানে শেল্টার নির্মাণে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহারে জোর দিচ্ছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম পরিবেশবান্ধব গৃহনির্মাণ উপকরণ সহজলভ্য নয়, ফলে অনেক দূর থেকে উপকরণ সংগ্রহ করতে খরচ অনেক বেড়ে যায়। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের ধারণা ইটের ঘর বেশি টেকসই। আবার, রাজমিস্ত্রীরা পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করে গৃহনির্মাণে অভ্যস্ত নন এবং তারা প্রচলিত ইট ব্যবহার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বাঁশ দিয়ে গৃহনির্মাণ করতে গিয়ে দেখলাম, যে পরিমান বাঁশ ব্যবহার করা হচ্ছে, সে পরিমাণ নতুন রোপণ না করার ফলে পরিবেশের বিপর্যয় বাড়ছে। অন্যদিকে এইসব গৃহে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ বরছে না। ব্লক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিবেশবান্ধব উপকরণে স্বল্পতা এবং পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাবে এইখাত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিস্তার করা দুরুহ হয়ে পড়েছে। এই খাতসংশ্লিষ্ট উংপাদক থেকে শুরু করে ব্যবহারকারী প্রত্যেক অংশীজনকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা এবং এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মাঝে তথ্যগুলো পৌঁছানো দরকার।
শেখ রোকন
বন্যাপ্রবণ এলাকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং আশ্রয়কেন্দ্র– সবই কংক্রিট দিয়ে তৈরি করা হয়। একটি স্কুল ভবন করতে হয়তো মানুষকে অনেক কাঠখড় পোড়ানো হয়। কিন্তু তা ভাঙনে এক নিমেষেই শেষ হয়ে যায়। ফলে নদীভাঙনপ্রবণ এলাকার স্থাপনাগুলো কাঠ এবং বাঁশ দিয়ে করা উচিত। এতে নাটবল্টুগুলো শুধু লোহার হবে। যাতে নদীভাঙন হলে সেই স্থাপনা খুলে অন্য জায়গায় নেওয়া যায়। এ বিষয়টি পলিসির ক্ষেত্রে চিন্তা করা যেতে পারে।
সুপারিশ
হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে (এইচবিআরআই) গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে অংশীজনের মতামত নিয়ে রোডম্যাপ করে দ্রুত কাজ শুরু করতে হবে।
‘অ্যাকশনবেজড’ গবেষণা বৃদ্ধি এবং এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
পরিবেশবান্ধব গৃহনির্মাণে আগামী ৫০ বছরের কথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
নদীভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলোর বাড়ি ও স্থাপনা সহজে স্থানান্তর করা যায়, সেভাবে তৈরি করতে হবে।
দুর্যোগ সহনশীলতা বিবেচনাপূর্বক লোকজ ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ টেকসই ও সহজলভ্য উপকরণ ব্যবহার করে অবকাঠামোগত পরিকল্পনা করতে হবে।
জনসচেতনতা ও কমিউনিটির সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে প্রকল্প বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ
করতে হবে।
প্রধান অতিথি
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
উপদেষ্টা
বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন
এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়
বিশেষ অতিথি
রেজওয়ানুর রহমান
মহাপরিচালক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর
আলোচক
ড. মাহবুবা নাসরীন
অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী
অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
ড. মোশতাক আহমেদ
অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
মো. নাফিজুর রহমান
প্রিন্সিপাল রিসার্চ অফিসার, হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই)
এফ এম আনোয়ার হোসেন
ট্রাস্টি, রিভারাইন পিপল
ইঞ্জিনিয়ার মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন
টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার (শেল্টার অ্যান্ড সেটেলমেন্টস), ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট সেক্টর
কারিতাস বাংলাদেশ
এ কে এম জহিরুল আলম
কো-অর্ডিনেটর
শেল্টার ক্লাস্টার বাংলাদেশ, আইএফআরসি
ইঞ্জিনিয়ার মো. জাকির হোসেন
টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর
ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ
ধারণাপত্র উপস্থাপন
মো. শামছুজ্জামান
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম, ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ
সভাপতি
তালহা জামাল
কান্ট্রি ডিরেক্টর, ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ
সঞ্চালনা
শেখ রোকন
সহযোগী সম্পাদক, সমকাল
অনুলিখন
মাজহারুল ইসলাম রবিন
স্টাফ রিপোর্টার, সমকাল
সমন্বয়
হাসান জাকির
হেড অব ইভেন্টস, সমকাল
সফিউল আযম
অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স কো-অর্ডিনেটর
ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ
- বিষয় :
- আবাসন ব্যবস্থা